যে মানুষটা এগিয়ে না এলে সুন্দরবনের পথহারা কিশোরদের ফেরা হতো না ঘরে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকার জঙ্গলে ঢুকে পুলিশের দুঃসাহসী অভিযানের গল্পটা অনেকেই জানেন। কিন্ত জানেন না নেপথ্যের এক যোদ্ধার গল্প, যিনি না থাকলে হয়তো সেই কিশোরদের কখনও খুঁজে পাওয়া যেতো না...
নিষেধ অমান্য করে সুন্দরবনে অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে গিয়ে মরতে বসেছিল ছয় কিশোর। শ্বাসরুদ্ধকর এক অভিযানে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে তাদের সবাইকে, বাঘের পেটে না গিয়ে বিপজ্জনক এলাকা থেকে জীবিত অবস্থায় তারা ফিরে এসেছেন পরিবারের কাছে। সেই কিশোরদের উদ্ধার করতে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকার জঙ্গলে ঢুকে পুলিশের দুঃসাহসী এবং কৌশলী অভিযানের গল্পটা অনেকেই জানেন। কিন্ত জানেন না নেপথ্যের এক যোদ্ধার গল্প, যিনি না থাকলে হয়তো সেই কিশোরদের লাশগুলোও খুঁজে পাওয়া যেতো না। তার নাম পপি আক্তার, জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯- এর একজন কল সেন্টার কর্মী তিনি।
প্রতিদিনকার মতো সেদিনও ডিউটিতে ছিলেন পপি আক্তার। বিপদে বা অসুবিধায় পড়ে কেউ সাহায্য চেয়ে ফোন করলে সেই ফোনকলটা যথাযথ থানা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে দেয়া তার দায়িত্ব। ঈদের পরদিন, ২৭ তারিখেও অফিসেই ছিলেন পপি। আসরের আজানের খানিক পরে একটা কল রিসিভ করলেন তিনি, কিশোর একটা কণ্ঠ তাকে জানালো, তারা ছয়জন বন্ধু মিলে সুন্দরবনে ঢুকেছিল। কিন্ত এখন পথ হারিয়ে ফেলেছে, ফেরার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না।
জরুরী সেবা ৯৯৯- নম্বরে প্রতিদিন অজস্র ভুয়া কল আসে। শুধু নারী কলসেন্টার কর্মীদের কণ্ঠ শোনার জন্যেও অনেকে উড়ো কল দেয়, আজেবাজে কথাবার্তা বলে। এরকম অভিজ্ঞতা পপি আক্তারের নিজেরও হয়েছে। তবে সেদিন তার মনে হলো, ফোনের ওপাশ থেকে সত্যিকারের বিপদগ্রস্ত কেউই সাহায্য চাইছে, ফাজলামি করছে না অযথা। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তিনি ব্যাপারটা জানালেন স্থানীয় শরণখোলা থানা, বন বিভাগ এবং এসপি বাগেরহাট-কে। পপির হাত ধরেই শুরু হলো রোমাঞ্চকর এক উদ্ধার অভিযানের গল্প।
পপিকে বলা হলো, কিশোরদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে। সেটাই করলেন তিনি। নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকলেন তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোন ডিভাইসগুলোকে ট্র্যাক করে লোকেশন খুজেঁ বের করার। সুন্দরবনের সেই এলাকায় তখন আঁধার ঘনিয়ে আসছে, বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। এদিকে কিশোরদের কাছে থাকা একটা ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেল। তারপর শেষ হলো ব্যালেন্স। শুনে সঙ্গে সঙ্গে পপি আক্তার নিজের মোবাইল থেকে তাদের নাম্বারে রিচার্জ করে দিলেন, যাতে কোন অবস্থাতেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়।
এদিকে শরণখোলা রেঞ্জের পুলিশ ততক্ষণে কাজে নেমে পড়েছে। কিশোরদের অবস্থান আন্দাজ করে তারা বনের ভেতরে ঢুকেও পড়েছে। দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার প্রচেষ্টা শেষে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে পুলিশের সদস্য এবং বনরক্ষীরা। উদ্ধার করা হয়েছে ছয় কিশোর জয়, সাইমুন, জুবায়ের, মাঈনুল, রহিম ও ইমরানকে। কন্ট্রোল রুমে বসে খবরটা সবার আগে শুনেছেন পপি আক্তার, পুরো লড়াইয়ে তিনিও শামিল ছিলেন, বিজয়ের হাসিটা তিনিও তাই উচ্চস্বরেই হেসেছেন, স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কৃতজ্ঞচিত্তে।

পপি আক্তার যেটা করেছেন, সেটা তার কর্তব্য ছিল। কিন্ত এই সময়ে নিজের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করে কজনে? সেখানে পপি বরং দায়িত্বের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন, ছেলেগুলোর ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে শুনে কারো অপেক্ষায় না থেকে নিজের ফোন থেকে তাদের নাম্বারে রিচার্জ করে দিয়েছেন। পুলিশ যেমন কিশোরদের উদ্ধার করাটাকে মিশন হিসেবে নিয়েছিল, ব্যাপারটা একইরকম ছিল পপি আক্তারের কাছেও। ইমার্জেন্সি ফাস্ট রেসপন্ডার হিসাবে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা আর আন্তরিকতা ছিলো কিশোরদের উদ্ধার তৎপরতা শুরু করার জন্য।
পপি আক্তারের এই চেষ্টাকে সম্মানিত করার জন্যে তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ক্রেস্ট। ছয় কিশোরের প্রাণ বাঁচানোর বিনিময়ে এটা হয়তো কিছুই নয়, কিন্ত পপি আক্তারকে একটা ধন্যবাদ তো দেয়া গেছে অন্তত। অমানুষ আর দায়িত্ব এড়িয়ে চলা লোকজনে ভরা পৃথিবীতে পপি আক্তাররা বড্ড ব্যতিক্রম, এই মানুষগুলো আমাদের কাছ থেকে অনেক বেশি সম্মান আর ভালোবাসা ডিজার্ভ করেন...