"দুইদিন আনালে-বিনালে থাইকা ক্ষুধায় তো কাতর হইয়া পড়লাম। বিকালে বিশ্বাস করেন ভাই মাথাটা ইমুন চক্কর দিলো যে আমি তো মাটিতে বইস্যা পড়লাম।"

বইমেলায় মারজুক রাসেলের বই নিয়ে এবার বেশ হৈ-হুল্লোড় হচ্ছে। কয়েক ঘন্টায় কয়েকশো, আর কয়েকদিনে হাজার হাজার কপি বিক্রি হচ্ছে। যেখানে কবিতার বই কয়েক কপি বিক্রি হলেই বর্তে যায়। সেখানে মারজুক রাসেলের বই ঘন্টা না পেরোতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ৯ দিনে ৯ হাজার কপি! উনাকে নিয়ে মেলায় মিছিল হচ্ছে শুনলাম। এতে অনেকে নাখোশ হয়েছেন। নাটকের অভিনেতার কবি হিসেবে জনপ্রিয়তা দেখে বোধহয়।

কিন্তু আমার অনেক ভালো লাগছে এসব দেখে। কতখানি কবিতাপ্রেমিকরা উনার বই কিনছেন- এই বিতর্ক পাশ কাটিয়েও বলা যায়- কবি মারজুক রাসেলের জন্য এটি একটি অনন্য স্বীকৃতি। নাট্যভিনেতা কিংবা অন্যকিছু না। কেবল কবিতা লিখবেন বলে যে তরুণ ছেলে পরিবার থেকে পালিয়ে- গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন নব্বই দশকে। আজ এতদিন পর মানুষ তার কবিতায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।

মারজুক ঢাকায় এসেছিলেন যার হাত ধরে, তাদের একজন ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের স্মৃতির জোনাকিরা সিরিজ পড়তে গিয়ে মারজুক রাসেলের এই জার্নিটা জেনেছিলাম। রিটন ভাই তাঁর লেখায় জানাচ্ছেন- মারজুক রাসেল গোপালগঞ্জের ছেলে। প্রায়ই গোপালগঞ্জের টুংগিপাড়ায় বংগবন্ধুর সমাধির পাশাপাশি ঘুরাফেরা করতেন। কেননা ঢাকা থেকে যাওয়া বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকরা নব্বই দশকে জাতির জনকের সমাধি জিয়ারত করতে যেতেন। সেই মফস্বলের নাম না জানা তরুণ মারজুক রাসেল সেখানে গিয়ে তাদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতেন। আলাপ-সালাপ, ফুট ফরমায়েশ করে পরিচিত হয়েছেন বিখ্যাত অনেকের সাথে।

মারজুক রাসেল 

সেই সূত্রে পরিচয় হয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, কবি রফিক আজাদ আর কবি মোহন রায়হান ইনাদের সাথে! তারপর সেই কোনোদিন ঢাকা না আসা মফস্বলি তরুণ ঢাকায় এসে ছাপাখানায় কাজ নেন। কিন্তু ভিশন আর এম্বিশন- কবিতা লেখা। রাতে এলিফ্যান্ট রোডের সেই ছাপাখানায় ঘুমানোর জায়গা হলো। প্রেসটা চালান কবি ফারুক মাহমুদ। মারজুক রাতে ঘুমাতেন ওখানে। আর কাজ শেষে ঘুরে বেড়াতেন ঢাকা শহরের লেখক-কবিদের আড্ডায়, পত্রিকা অফিসে।

সন্ধ্যায় আজিজ মার্কেটে ফারুক মাহমুদ মারজুককে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। মারজুকের মাথায় চে গ্যেভারার লাল ক্যাপ। শাহবাগের পরিচিত বিখ্যাত কবিতার কবিরা ঠাট্টা করে মারজুককে ‘বাংলা কবিতার নাইট গার্ড’বলেন। মারজুক ফ্যালফ্যাল করে হাসেন। আর অন্যদের আলাপ শুনেন।

এভাবেই কবি হতে আসা মারজুক রাসেল একদিন গান লিখতে শুরু করেন। নাটকে-সিনেমায়-বিজ্ঞাপনে অভিনয়ের সুযোগ পান। ঘনিষ্ঠতা হয় নগর বাউল জেমসের সাথে। পরিচালক মোস্তফা সারয়ার ফারুকীর সাথে। তারপর তো আমরা সবাই চিনি উনাকে।

কিন্তু রিটন ভাইয়ের স্মৃতিচারণে মারজুক রাসেলের ঢাকায় আসার স্মৃতিচারণ আছে। মারজুক ছড়াকার রিটন ভাইকে বহুদিন পর আবেগী হয়ে জানান তাঁর গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসার গল্প। আর মারজুকের ভাষায় তাঁর শুরুর দিনের স্মৃতিচারণ-

"টুঙ্গিপাড়ায় আপনারে রিটন ভাই আমার এতোই ভালো লাগছিলো যে; আমি গোপালগঞ্জ থিকা ফাইনালি ঢাকা চইলা আসলে বিপদে পড়লে আপনের কাছেই আইসা দাঁড়ামু; এইরকম একটা চিন্তা আমার মাথার মইধ্যে ছিলো। কবি হইতে হইলে ঢাকায় আইতেই হইবো। চান্স খুঁজতেছিলাম। ফ্যামিলির লগে লাগলো ক্যাঁচাল। আইসা পড়লাম ঢাকায়।

দুইদিনেই পকেটের ট্যাকা শেষ। যাই কই আর খাই কী? দুইদিন আনালে বিনালে থাইকা ক্ষুধায় তো কাতর হইয়া পড়লাম। বিকালে বিশ্বাস করেন ভাই মাথাটা ইমুন চক্কর দিলো যে আমি তো মাটিতে বইস্যা পড়লাম। চোখে আন্ধার দেখি। খাইতে হইবো। কিন্তু কে খাওয়াইবো! আঁতকা বস আপনের কথা মনে হইলো। আপনে ঠিকানা কইছিলেন বাংলা মোটর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। তো চইলা আসলাম আপনের উদ্দেশ্যে। আইসা দেখি ব্যাপক ঘটনা।

বিখ্যাত-অখ্যাত মানুষে ভর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। খিদায় মাথাটা আরেকবার চক্কর খাইলো। পৃথিবীটা দুইল্লা উঠলো। যদি আপনেরে না পাই! কিন্তু বস আপনেরে পাইয়া গেলাম কয়েক সেকেন্ডের মইধ্যেই। আপনে বন্ধুবান্ধব লইয়া ব্যস্ত আছিলেন। আমারে চিনবেন কিনা সেইটাও একটা টেনশন ছিলো। কিন্তু আমারে আপনে চিনলেন তো চিনলেনই, কিছু কওনের আগেই আমারে চেয়ারে বসাইয়া নিজের হাতে খাওনের প্লেট আগাইয়া দিলেন। আপনে খেয়াল করেন নাই আমি কী রকম বুভুক্ষের মতন খাইতেছিলাম।

বিশ্বাস করেন এতোই ক্ষুধার্ত ছিলাম যে এক প্লেটে আমার পেট ভরে নাই। আমি আপনের কাছে আরেক প্লেট চামু ভাবতে ভাবতেই দেখি আপনে আইসা জিগাইলেন- আরেক প্লেট খাইবা নি? আমি হ কইলাম। আপনে আরেক প্লেট আইন্না দিলেন আমার হাতে। তারপর চইল্লা গেলেন। বিশ্বাস করেন ভাই আমার চোখ ঝাপসা হইয়া যাইতেছিলো। আমি লুকাইয়া কানতেছিলাম। আপনে ক্যাম্নে বুঝলেন যে আমার খিদা লাগছে!’

মারজুক রাসেলকে ঘিরে পাঠকদের ভিড়

সেই স্বপ্ন বুভুক্ষ কবি মারজুক রাসেল আজ বই মেলায় কবি হিসেবে বেস্ট সেলার হচ্ছেন, এটা দেখে ভালো লাগছে। কবি হিসেবে স্বীকৃতির আগেও তার অর্জন কম না। জেমসের 'মীরাবাঈ' গানটা কিংবা ফারুকির সিনেমায় 'বাহির বলে দূরে থাকুক, ভিতর বলে আসুক না'; এইরকম লিরিক লিখতে পারেন যে গীতিকবি; তার আর কবিতা না লিখলেও চলে। কিন্তু মারজুক আরও লিখুক। বহুদিন পর, এত লম্বা জার্নির পর, বহু কবিতার বইয়ের পর কবি মারজুক রাসেলকে নিয়ে এইভাবে উদযাপন চলুক। এই উদ্দাম উদযাপন ডিজার্ভ করে লোকটা।

আরও পড়ুন- মারজুক রাসেল: স্রোতের বিপরীতে চলা অন্যরকম একজন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা