বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও আজ আপনাকে দেখে আত্মবিশ্বাসী মনে হলো ভীষণ, একজন নেতার জন্যে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকারী।

আপনার প্রতি অভিমান জন্ম নিয়েছিল, সেটা কেটে গেছে বলব না। ভালবাসার জায়গাটা ধীরে ধীরে দখল করছিল বিরক্তি। করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্ব, বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে এই আপদ, জাস্টিন ট্রুডো থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, সবাই বারবার আসছেন মানুষের সামনে, নরেন্দ্র মোদির মতো সাম্প্রদায়িক নেতাকে গত ছয় বছরের মধ্যে এই প্রথম জনগনের জন্যে কাজ করতে দেখছি- অথচ পুরো সময়টায় আপনাকে কোথাও দেখা গেল না! 

যাও বা একবার ক্যামেরার সামনে এলেন, সেখানেও ভাষণের চিত্রনাট্য ভীষণ দুর্বল। দলকানা হলে এমন ভাষণে হাততালি দেয়া যায়, প্রশংসার স্তবক রচনা করা যায়- কিন্ত সেটা তো আমাকে দিয়ে হয় না! আপনার নিয়োগ দেয়া মন্ত্রীরা একের পর এক ভুলভাল কথা বলে যাচ্ছে, হাস্যরসের যোগান দিচ্ছে, অথচ করোনার এই দিনগুলোতে কমেডিয়ানের চেয়ে সেন্সিবল মানুষের দরকার বেশি ছিল। আপনার ওপর অভিমান কেন হবে না, বলুন তো? 

একজন নেতাকে নাকি চেনা যায় দুর্যোগের সময়ে, বিপদের সময়ে। কঠিণ সময় যেমন নেতা তৈরী করে, তেমনই নেতার গুণের পরীক্ষাও নেয়। সেই পরীক্ষায় আজ সকাল পর্যন্ত আপনাকে পাশ মার্ক দেয়া যাচ্ছিল না। তারপর আপনি এলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন, তাদের দিকনির্দেশনা দিলেন, ডাক্তারদের পিপিই, দিনমজুরের অসহায়ত্ব, সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য- সবকিছুই উঠে এল আপনার ভাষণে। বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও আপনাকে দেখে আত্মবিশ্বাসী মনে হলো ভীষণ, একজন নেতার জন্যে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকারী। 

তিন মাস সময় পেয়েছিল আপনার সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন করোনাকে সিরিয়াসলি নেয়নি, এই প্রশ্নটা স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে করা উচিত আপনার। সঙ্গে জুড়ে দেবেন ডাক্তারদের কাছে কেন পিপিই নেই- এই প্রশ্নটাও। কেন মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালককে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অনুরোধ করতে হয়, চিকিৎসকেরা যাতে নিজ নিজ মাস্ক এবং সেফটি ইকুইপমেন্ট নিজেরাই কিনে নেন- এই প্রশ্নটাও ছুঁড়ে দেয়া উচিত আপনার মন্ত্রীদের মুখের ওপর। প্রশ্নের শেষ নেই, উত্তরের আশা নেই, তবুও আজকের দিনটা দেখে অন্তত আশা করতে চাই, আপনার দেয়া নির্দেশ মতো যার যার কাজ সবাই করবে, করোনার বিপক্ষে আমাদের লড়াইটা একপেশে হবে না। 

আপনি দিনমজুরদের খোঁজ রেখেছেন, ভালো লেগেছে শুনে। কৃষক, চা শ্রমিক, হিজড়া, বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি কষ্ট পাচ্ছে। তারা দৈনন্দিন কাজে যেতে পারছে না- এগুলো আপনার মাথায় আছে জেনে খুশি হয়েছি। আপনি নির্দেশ দিয়েছেন তাদের কাছে সাহায্য ও খাদ্যদ্রব্য পাঠানোর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবাইকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর। প্রতিটি ওয়ার্ড অনুযায়ী তালিকা করার। সেই অনুযায়ী সবাই যাতে সাহায্য পায়। কেউ যাতে বাদ না পড়ে।’ 

ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী

সেইসঙ্গে আপনি হুঁশিয়ারীও উচ্চারণ করেছেন, ‘কোনও রকম দুর্নীতি হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দুঃসময়ে কেউ সুযোগ নিলে, কোনও অভিযোগ পেলে আমি কিন্তু তাকে ছাড়বো না।’ দুর্নীতির শেকড় ছড়িয়ে পড়ার দিকে আপনার নজর আছে, এসব ত্রাণের ব্যাপারগুলো নিয়ে যে নয়-ছয় হয়, সেটা আপনি জানেন দেখে ভালো লাগলো। আপনি বলেছেন, ‘মানুষের দুঃসময়ে কেউ সুযোগ নিলে আমি কিন্তু তাকে ছাড়বো না।’ আমি আশ্বস্ত হতে চাই, সরকারের তরফ থেকে অসহায় মানুষের জন্যে যেটুকু সাহায্য বরাদ্দ করা হবে, সেটার পুরোটাই যাদের জন্যে পাঠানো হয়েছে তারা পাবেন। আপনার দলের নেতাকর্মী বা সরকারী কর্মকর্তারা মধ্যস্বত্ত্বভোগী হয়ে সিংহভাগ জিনিস মেরে খাবেন না- এই নিশ্চয়তাটুকু চাই আমরা। আপনার মুখের কথাটা খানিকটা হলেও ভরসা দিয়েছে আমাকে। 

আপনার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পিপিই শব্দটা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেন না, সেই পিপিই'র খোঁজ আপনি রেখেছেন, এজন্যে ধন্যবাদ। আপনি বলেছেন, 'রোগীর সেবা যারা করবেন তারাই পিপিই পাচ্ছেন না, কিন্তু অনেকেই ঘরে-বাইরে এটা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর থেকে বিরত করা দরকার। করোনাভাইরাসের রোগী, আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটারে পরার মতো মানসম্মত পিপিই আমরা তৈরি করবো। কথা বলেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি। গার্মেন্টস মালিকদের সঙ্গে কথা হয়েছে।' 

আপনার কথা থেকে আমরা আশ্বস্ত হতে চাই, হাসপাতালের ডাক্তাররা নিজেদের নিরাপদ মনে করে রোগীর সেবা করতে পারবেন, আক্রান্ত রোগীকে কোন হাসপাতাল ফিরিয়ে দেবে না, পাঁচ-ছয়টা হাসপাতাল ঘুরে খালি হাতে ফিরে এসে কোন রোগীকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে না। 'গার্মেন্টস মালিকদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে' এটুকুতে সীমাবদ্ধ না থেকে দ্রুত কাজ শুরু করে পিপিইগুলো যে আমাদের ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়রদের হাতে তুলে দেয়া উচিত, সেটা নিশ্চয়ই আপনিও জানেন। তবু আমি স্বান্তনা পেয়েছি, কাজ শুরু হয়েছে এটুকু জেনে।

আপনার মন্ত্রীরা যারা লোক হাসাচ্ছেন, আবোল তাবোল বকছেন, সম্ভব হলে তাদের চুপ থাকতে বলুন। এমন অকর্মা আর অপদার্থদের দিয়ে মন্ত্রীসভা ভারী না করে কাজের মানুষকে বসান প্লিজ। আপনাকে হয়তো জানতে দেয়া হয় না, এই লোকগুলোর কারণে মানুষ কি পরিমান বিরক্ত আপনার ওপর। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লিগ আর আপনার আওয়ামী লিগে অনেক পার্থক্য, তবুও বিশ্বাস করি, এই দলটাতে এখনও যোগ্য মানুষের অভাব নেই। তাদের দায়িত্ব দিন, পরিস্থিতি বদলাবে নিশ্চয়ই। 

নেতা হিসেবে এই বিপর্যয়ের সময়টায় আপনাকে লেটার মার্ক দেয়া যাবে কিনা- সেটা কথা আর কাজের মিল থেকেই বোঝা যাবে। সময় জানিয়ে দেবে সব প্রশ্নের উত্তর। আপনার কথায় আমরা এখনও ভরসা রাখি, আমরা বিশ্বাস করতে চাই আপনার অধঃস্তনেরা আপনার দেয়া নির্দেশগুলো পালন করবেব, অসহায় মানুষ ভোগান্তির মুখে পড়বেন না, পরিস্থিতির কারণে বেকার হয়ে যাওয়া মানুষটা পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরবেন না। এটুকু ভরসা দেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ শেখ হাসিনা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা