
“বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব। তুমি বলেছিলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের প্রশ্রয় দিও না, তুমি বলেছিলে সুযোগ পেলেই তারা এ দেশ কেড়ে নেবে, আমি তাদের প্রশ্রয় দেবো না”
নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমার প্রথম দিকের একটি দৃশ্য। সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। এই দৃশ্যে সিরাজউদ্দৌলা তার প্রয়াত নানা বাংলা বিহার উড়িষ্যার আলিবর্দি খানের সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি বলেছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রশ্রয় দেননি কখনো। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার পরিনামে নবাব কোম্পানির কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন।
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন, আজ থেকে ঠিক ২৬০ বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ। আট ঘন্টা ব্যাপী যুদ্ধে মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাব যুদ্ধে হেরে যান, যার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। বাংলাকে বরণ করতে হয়েছিলো দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসন।
যেভাবে রচিত হয়েছিল যুদ্ধের পটভূমি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে ১৬৫০ এর দশকের শুরুর দিকে। মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের অনুমতি দেয় মোঘল শাসকরা। দ্রুতই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। একসময় তারা বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও নাক গলানোর চেষ্টা চালায়। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তাদের অনুপ্রবেশ বাংলার সুবাহদার শায়েস্তা খানও ইংরেজদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৭৪০ সালের সময়টায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়। ভারতবর্ষে তাদের একচেটিয়া আধিপত্যে ফরাসিরা বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে তারা এটা ভালোভাবে নেয়নি। বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশ-ফরাসি দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। ওই সময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দি খান চাননি ব্রিটিশ ফরাসি ঝামেলায় নিজ রাজ্যের অবস্থাও অন্যদের মতো হোক। তাই তিনি ইংরেজদেরকে কলকাতায় দূর্গ তৈরির অনুমতি দিলেন। দূর্গের নাম ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ।
কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি নামে তিনটি গ্রাম কিনে ইংরেজরা প্রথম জমিদারি প্রতিষ্ঠিত করে ভারতবর্ষে। এর বিনিময়ে অবশ্য আলিবর্দি খান মোটা অংকের করও আদায় করেছিলেন ইংরেজদের কাছ থেকে। জমিদারি ক্রয় ও ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য মারাত্মক একটি লাভজনক সিদ্ধান্ত ছিলো। তারা দেখলো তাদের স্বার্থ হাসিল হচ্ছে খুব ভালো করেই। বাংলার সম্পদ ও ভৌগলিক অবস্থান যে বাণিজ্যের পক্ষে সুবিধাজনক সেটা তারা বুঝতে পেরেছে। তারা কলকাতার আশেপাশে আরও জমিদারি (৩৮ টি গ্রাম) কেনার বুদ্ধি করে। কিন্তু এইদিকে তাদেরকে যে বাণিজ্যিক সুবিধা দেয়া হয়েছিলো তা অপব্যবহার করার ফলে বাংলার নবাবদের সাথে ইংরেজদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। এভাবেই তৈরি হতে থাকে পলাশী যুদ্ধের ক্ষেত্র।
সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসন গ্রহণ
১৭৫৬ সালে আলিবর্দি খান মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর নাতি সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন আলিবর্দি খানের বিপরীত। বয়স কম, রক্ত গরম টাইপের লোক। তিনি প্রথমবারের মতো বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবৈধ কার্যক্রমের তীব্র প্রতিবাদ জানান। ফলে নবাবের সাথে ইংরেজদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর তিনটি প্রধান অভিযোগ ছিল- অনুমতি ব্যতীত ফোর্ট উইলিয়মে প্রাচীর নির্মাণ ও সংস্কার, ব্যক্তিগত অবৈধ ব্যবসা ও কোম্পানির কর্মচারীদের দ্বারা দস্তকের নির্লজ্জ অপব্যবহার এবং নওয়াবের অবাধ্য প্রজাদের বেআইনিভাবে আশ্রয় প্রদান।
সিরাজউদ্দৌলা প্রথমে আহ্বান জানান এসবের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে। কিন্তু, ইংরেজরা তার দূতকে অপমান করে। ফলে তিনি রেগে যান, এবং অভিযানে বের হন। কাশিমবাজার দূর্গ দখল করে নেন এমনকি কলকাতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এ পরাজয়ের পর বাংলায় কোম্পানি কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দুইটি উপায় মাত্র খোলা ছিলো। এক. নবাবের নিকট আত্মসমর্পণ করা অথবা পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। তারা বাংলায় অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর জন্য খবর পাঠায় মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জে। রবার্ট ক্লাইভও এডমিরাল ওয়াটসনের অধীনে একদল ব্রিটিশ সৈন্য বাংলায় পাঠানো হয়। ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি। রবার্ট ক্লাইভের চতুর বুদ্ধিমত্তায় অতর্কিত আক্রমণে নবাবের প্রায় সাড়ে ৬০০ সৈন্য মারা যায়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
অন্যদিকে ইংরেজদের মাত্র ৫৭ জনের মৃত্যু হয়। এটা দেখে নবাব সিরাজ কিছুটা ভয় পেলেন। ইংরেজদের সাথে আলীনগর চুক্তি করলেন। তাদেরকে দূর্গ তৈরির কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ক্লাইভ তখন ফরাসিদের চন্দরনগরও ধ্বংস করলেন। ফরাসিদের শক্তি কমে গেলো অনেকটাই।

যুদ্ধের আবহাওয়া
এই দিকে নবাবকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র হচ্ছিলো বাংলায়। কারণ, নবাবের অল্প বয়সেই সিংহাসনে বসা অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। তাছাড়া, নবাব নিজেও জানতেন তার বহিঃশত্রুদের চেয়ে ঘরেই শত্রুর অভাব নেই। ফলে নবাব পরিবারের মধ্যেই একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিলো। এই দ্বন্দ্বের ব্যাপারে ইংরেজরা জেনে যায়। ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখে জগৎশেঠ।
ইংরেজরা জগৎশেঠের মাধ্যমে মীর জাফরকে মসনদে বসানোর চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন ঘষেটি বেগম, মীর জাফরের পুত্র মীরন, মীর জাফরের জামাতা মীর কাশিম, রাজা রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, মীর খোদা ইয়ার খান লতিফপ্রমুখ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ১৭৫৭ সালের ৫ জুন মীর জাফরের একটি গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয়। মীর জাফর চান বাংলার নবাব হতে, আর ইংরেজরা চায় নির্বিঘ্নে বাণিজ্য করার সুবিধা।
পলাশীর যুদ্ধ
১৪ জুন রবার্ট ক্লাইভ নবাবকে যুদ্ধের ঘোষণা বার্তা পাঠান। কীভাবে যেন নবাব জেনে যান, মীর জাফর এই গোটা ষড়যন্ত্রের অংশ। কিন্তু, ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তির বিষয়ে অবগত হয়েও মীর জাফরের অনুগত সেনাদের সংখ্যা ও যুদ্ধাস্ত্রের পরিমাণ বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে নবাব কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বরং, তার সাথে সন্ধি করলেন। মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কোরানে হাত রেখে মীর জাফর নবাবের কাছে শপথ করলো- সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। ওদিকে কোরান হাতে রেখে মীর জাফর ইংরেজদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল, সে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। হায় রে!

২৩ জুন, ১৭৫৭
যুদ্ধের দিন। রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যরা পলাশীতে এসে জড়ো হয়। মাত্র তিন হাজার সৈন্য তার। অপরদিকে নবাবের সৈন্য সংখ্যা ৬০ হাজার প্রায়। তার মধ্যে সামনের দিকেই দাঁড়িয়ে আছে নবাবের বিশ্বস্ত মীরমদন আর মোহনলালের প্রায় ১২ হাজার সৈন্য। পেছনে ৪৫ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, আর রায়দুর্লভ। সবাই মিলে যুদ্ধ করলে ক্লাইভের সৈন্যরা পাত্তাই পেতো না নবাবের বাহিনীর কাছে।
যুদ্ধ শুরু হলো। মীর মদনের আক্রমণে পিছু হটলো ক্লাইভ। এর মধ্যেই শুরু হলো বৃষ্টি। ইংরেজরা গোলা বারুদ বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখলো। কিন্তু নবাবের সৈন্যরা বোকামি করলো। তাদের অস্ত্র গোলা বারুদ গেলো ভিজে। বৃষ্টি শেষ হলে যখন আবার ইংরেজদের আক্রমণ করা হলো তখন মীর মদন নিহত হলেন। মীর মদনের মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে যান নবাব। মুষড়ে পড়েন তিনি। মীর জাফর ছিলেন নীরব। নবাব তার নীরবতায় কষ্ট পেলেন।
নিজের পাগড়ি তার পায়ের কাছে রেখে অনুনয় করলেন, ‘তুমি আমার পাগড়ি রক্ষা করো।’ মীর জাফর এমন ভাব ধরলো, এই যুদ্ধে নবাবকে জিতিয়ে দেয়াই তার মূল লক্ষ্য। কিন্তু বেঈমানি করলো। অবস্থা দেখে রায় দুর্লভ নবাবকে বললেন, তাঁবুতে থাকা তার জন্য নিরাপদ নয়, মুর্শিদাবাদের দিকে যেন চলে যান। নবাব তা-ই করলেন। এইদিকে মীর জাফরের সৈন্যরা যুদ্ধে অংশ নিলো না। জয় হলো ইংরেজদের। হেরে গেলেন নবাব, হেরে গেলো বাংলা।
২৯ জুন তাকে পলাতক অবস্থায় স্ত্রী-কন্যাসহ আটক করা হয় নবাবকে। এরপর ৩ জুলাই মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে। সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর সাথে সাথে অস্তমিত হয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতা। শুরু হয় ব্রিটিশ শাসন। ১৯০ বছর তারা বাংলাকে শাসন করে গেল শুধু ক্ষমতালোভী কয়েকজন বেঈমান ঘাতকের কারণে!