সময় কেটে গেছে। ছাব্বিশতম জন্মদিনের মাত্র তিনদিন আগে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিলেন আপনি। আমরা বড় হবো, বুড়ো হবো, আপনার বয়স বাড়বে না, ছাব্বিশ বছর পূর্ণ হবে না কোনদিন। ফ্রেমে বাঁধা ছবিতে বয়সটা আটকে থাকবে আপনার। শুভ জন্মদিন ফিলিপ হিউজ!

এক

কর্ণ শর্মার বলটা কাভারের দিকে ঠেলে দিয়েই ছুটলেন ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নার। প্রান্ত বদল করলেন একবারের জন্যে, স্কোরবোর্ড তখন বলছে, তিন অঙ্কে পৌঁছে গেছেন অস্ট্রেলিয়ার বামহাতি ওপেনার। ওয়ার্নার একটা লাফ দেন, তাঁর ট্রেডমার্ক উদযাপন; হেলমেট খুলে আনেন মাথা থেকে, চুমু খান তাতে। দু'হাতে ব্যাট-হেলমেট উঁচিয়ে ধরেন আকাশের দিকে, নিস্পলক চোখে তাকান ভেসে যাওয়া মেঘের ভেলায়, অসীম শূন্যতার মাঝে কোথাও হয়তো খুঁজে ফেরেন আপনাকে!

হ্যাঁ ফিলিপ হিউজ, অ্যাডিলেডে সেই মায়াবী রোদের ঝিকিমিকি খেলার মাঝে আপনার কথাই তো সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছিল সবার! মাইকেল ক্লার্ক এসে জড়িয়ে ধরলেন ওয়ার্নারকে, সেই আলিঙ্গন যেন ছাড়ার নয়। আবেগের বুনো স্রোত ওয়ার্নারের গলা বেয়ে উঠে আসে ওপরের দিকে, সেই স্রোতকে বাধা দেয়ার শক্তি তো আপনার বন্ধুর নেই! মাইকেল ক্লার্ক মাথায় হাত বুলিয়ে দেন ওয়ার্নারের।

রানপাহাড়ে চড়তে থাকলো অস্ট্রেলিয়া, সেঞ্চুরী পেলেন মাইকেল ক্লার্ক, তাদের পথ অনুসরণ করলেন স্টিভেন স্মিথও। শতকের পরে স্মিথ ধীরপায়ে হেঁটে গেলেন মাঠের একপাশে, সেখানে সাদা রঙে বড় করে লেখা আপনার টেস্ট ক্যাপ নম্বরটা- ৪০৮! স্মিথ আকাশের দিকে তাকান, ওয়ার্নারের মতো তিনিও বুঝি আশায় থাকেন, মেঘের ফালি সরিয়ে কোথাও উঁকি দেবে আপনার চিরচেনা হাসিমুখটা!

ফিলিপ হিউজ, অ্যাডিলেডে সেদিনের সবটুকু আলো এক নিভে যাওয়া তারা হয়ে কেড়ে নিয়েছিলেন আপনি। সবাই খেলছেন আপনার জন্যে, যে যা করছেন মাঠে, সেটা ফিফটি হোক, সেঞ্চুরী হোক, প্রতিপক্ষের একটা উইকেট হোক- সবাই জানেন, সবার অলক্ষ্যে আপনি দেখছেন সেগুলো। ওয়ার্নারের বাস্পসিক্ত চোখ, ক্লার্কের চেপে রাখা ঠোঁট কিংবা স্মিথের চোখের উদাস দৃষ্টি জানে আপনাকে হারিয়ে ফেলার বেদনাটুকু।

দুই

সাড়ে পাঁচফুটের ছোট্ট শরীর আপনার, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে খানিকটা বেমানান। অথচ বুকভরা আগুণের ফুলকি নিয়ে ব্যাট চালান আপনি! অভিষেক সিরিজ দক্ষিণ আফ্রিকায়, স্টেইন-এনটিনি-মরকেলদের নাম শুনলেও বুকে কাঁপন জাগে ডাকাবুকো ব্যাটসম্যানদের, সেই আগুণের তোপ ছুঁড়ে মারা বোলারদের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে আপনি সাইমন ক্যাটিচকে বললেন, স্ট্রাইক নিতে চান আপনি!

ক্যাটিচ বোধহয় কয়েক সেকেন্ডের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন। কি ভেবেছিলেন আপনাকে? আত্মবিশ্বাসী তরুণ? নাকি দুঃসাহসী এক বোকা? সেই টেস্টে পঁচাত্তর রানের দারুণ একটা ইনিংসে অভিষেক রাঙানোর পরে আপনাকে বোকা ভাবার কথা নয় কারো।

অভিষেক টেস্ট খেলতে নামার সময়ে আপনার হাতে বাঁধা ছিল কালো আর্মব্যান্ড; পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর জঙ্গী হামলায় হতাহতদের প্রতি শোক জানানোর জন্যে। আপনি জানতেন হিউজ, একদিন এই শোক, এই কালো আর্মব্যান্ড অন্যেরা পরবেন আপনার জন্যে? নিজের দ্বিতীয় টেস্টেই এই গতিদানবদের সামলে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরী তুলে নিয়েছিলেন আপনি, খালিপায়ে এভারেস্ট জয়ের চেয়ে কম কিছু নয় সেই কীর্তি! পন্টিং এসে পিঠ চাপড়ে দিলেন আপনার।

সেদিন সন্ধ্যায় হোটেলরুমে মাইকেল ক্লার্ক যখন বিয়ারের ক্যান খুলছিলেন আপনার পাশে বসে, ক্লার্কের সূদূরতম ভাবনাতেও ছিল না হয়তো, কয়েক বছর পরে মাইক্রোফোনের সামনে বসে আপনার মৃত্যুর খবরটা জানাতে হবে সবাইকে!

তিন

২০১৩ অ্যাশেজের পর আর জাতীয় দলে সুযোগ মেলেনি, পেরিয়ে গেছে পনেরোটা মাস। ব্যাগী গ্রীন টুপিটা আবার মাথায় দেয়ার ক্ষুধা নিশ্চয়ই খুব জোরেসোরে অনুভব করছিলেন মনের ভেতর। শেফিল্ড শিল্ডে রান পাচ্ছিলেন আপনি, মাইকেল ক্লার্কও তখন ইনজুরীর কারণে মাঠের বাইরে। ভারত সিরিজ কড়া নাড়ছে দুয়ারে, পত্রিকায় খবর আসে নির্বাচকদের চিন্তাভাবনায় ভালোভাবেই আছে আপনার নামটা।

সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ, নভেম্বরের মিষ্টি রোদের আলোয় ঝলসে উঠেছিল আপনার ব্যাট। স্কোরবোর্ডে ফিলিপ হিউজ নামটার পাশে তখন লেখা- নট আউট ৬৩! শর্ট বলে শুরু থেকেই দুর্বলতা ছিল আপনার, সেজন্যেই দলে থিতু হতে পারেননি একটানা। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার পেসার শন অ্যাবোট তাই বোধহয় বাউন্সারেই ভড়কে দিতে চেয়েছিলেন আপনাকে।

এমন কত বাউন্সার মোকাবেলা করেছেন আপনি, হুক খেলেছেন, পুল করে সীমানার বাইরে নিয়ে গেছেন, কখনও হয়তো ডাক করেছেন। এদিন হলো না ঠিকঠাক। মাথার পেছনে লাগলো বলটা, হেলমেট খুলে ফেললেন আপনি। তারপর বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করেই মাঠের মধ্যে! শন অ্যাবোটই সবার আগে ছুটে এলেন, ওয়ার্নার-হ্যাডিনরাও আপনাকে ঘিরে দাঁড়ালেন চোখের পলকে।

মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে ফেলার চেষ্টা করলেন কেউ একজন, মাঠে তখন যান্ত্রিক স্ট্রেচার প্রবেশ করেছে। আপনি সাড়া দিলেন না কারো ডাকে, কেউ তখনও জানে না, আর কোনদিন সাড়া পাওয়া যাবে না আপনার! স্ট্রেচারের সঙ্গেই উঠে বসলেন ওয়ার্নার, আপনার হাতটা নিজের হাতের তালুতে নিয়ে হয়তো অভয় দিতে চেয়েছিলেন আপনাকে, বলতে চেয়েছিলেন, তিনি পাশে আছেন। আপনি শুনতে পেয়েছিলেন হিউজ?

সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালের সামনে ক্রিকেটারদের ভীড়, সাংবাদিকদের জটলা। একটাই শুধু গুঞ্জন, হিউজি কেমন আছে? সবার একটাই জিজ্ঞাসা, হিউজের জ্ঞান ফিরেছে তো? দু'টো দিন আপনাকে নিয়ে লড়াই করলেন ডাক্তারেরা, নিজেদের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে। ফেরাতে পারলেন না আপনাকে, আপনি তখন এক অন্তহীন যাত্রায় নেমে পড়েছেন, যে যাত্রাপথের শেষ নেই কোন!

মাইকেল ক্লার্ক অশ্রুসিক্ত চোখে সাংবাদিকদের জানান, তার আদরের হিউজি আর নেই! লক্ষ লক্ষ ক্রিকেটপ্রেমী যার যার ধর্মের ঈশ্বরের কাছে দুটো দিন ধরে প্রার্থনা করেছে আপনার সুস্থতার জন্যে, অথচ ওদের ভালোবাসা, ওদের প্রার্থনাকে ব্যর্থ করে দিল নিয়তি! ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, যন্ত্রণাহীন মৃত্যু হয়েছে আপনার। আসলেই কি তাই? শারিরীক যন্ত্রণার কথা নাহয় বাদই দিলাম, পরিবার, ভালোবাসার ক্রিকেট, এসবকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়নি আপনার? যে ওয়ার্নার আপনার হাত ধরে বসে ছিলেন হাসপাতালে নেয়ার পুরোটা সময়, সেই ওয়ার্নারকে বিদায় না বলেই চলে গেলেন আপনি, খারাপ লাগেনি একটুও?

গ্রেগ হিউজের মনে পড়ে যায় অনেক বছর আগের স্মৃতি। ছোট্ট হিউজিকে তিনি মাঠে নিয়ে যাচ্ছেন, ছেলের দিকে বল ছুঁড়ে দিচ্ছেন। গ্রেগের কাঁধে হিউজের লাশবাহী কফিন, দুনিয়াতে সবচেয়ে ভারী বস্তু নাকি পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ, সে ভারী বোঝাটা গ্রেগ হিউজ বয়ে চলেন, কফিনের অন্যপাশগুলো শক্ত করে ধরে আছেন ক্লার্ক-ওয়ার্নার-ফিঞ্চরা। কফিনের ভার নাহয় সয়ে নিলেন ওরা, আপনাকে অকালে হারানোর কষ্টটা কি করে সইবেন?

সময় কেটে গেছে। ছাব্বিশতম জন্মদিনের মাত্র তিনদিন আগে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিলেন আপনি। আমরা বড় হবো, বুড়ো হবো, আপনার বয়স বাড়বে না, ছাব্বিশ বছর পূর্ণ হবে না কোনদিন। ফ্রেমে বাঁধা ছবিতে বয়সটা আটকে থাকবে আপনার। ক্লার্ক ক্রিকেট ছেড়েছেন, ডেভিড ওয়ার্নার-স্মিথরা এখন বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের দলে। ওরা সেঞ্চুরী করেন, ম্যাচ জেতেন, ড্রেসিংরুমে বিয়ারের ক্যান খোলা হয়, শ্যাম্পেন পার্টি চলে। কিন্ত কোথাও একটা শূন্যতা থেকে যায়।

সাজঘর জমিয়ে রাখতে তুলনা ছিল না আপনার, সেই প্রানখোলা হাসি, সেইসব রসিকতা ওয়ার্নার মিস করেন খুব। ভিক্টোরী সং গাওয়ার সময় আপনার গলাটা কানে বাজে স্মিথের। চমকে পেছনে ফিরে তাকান ওরা, দেখেন, কোথাই কেউ নেই! পূর্বসূরি ডোনাল্ড ব্র‍্যাডম্যান, ভিক্টর ট্রাম্পারদের সঙ্গী হয়েছেন আপনি, আপনার চলে যাবার ক'দিন বাদে তো রিচি বেনোও গেছেন সেখানে। আমাদের একজনও আছেন আপনার সঙ্গে, মানজারুল ইসলাম রানা। ওদের সাথে নিয়ে আসছে জন্মদিনের কেক কাটুন; না ফেরার সেই দেশে খুব ভালো থাকুন হিউজ, যতোটা ভালো থাকা যায়।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা