করোনার ভ্যাক্সিন তো আবিষ্কার হবে, কিন্তু পার্ভার্ট-ধর্ষকদের ভ্যাক্সিন কি আসবে কখনও?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে বের হলে যতজন পুরুষকে দেখবেন, তার আশি শতাংশই পারভার্ট। ধর্ষকদের চেহারাটা দেখলেই বুঝবেন রাস্তাঘাটে এই চেহারা প্রচুর কমন। এরকম এগ্রেসিভনেসও। শুধু সুযোগের অভাবে সবাই ভদ্র।
সাপোজ আপনি সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, রাস্তার দুপাশে কাশফুল দুলছে, আকাশে সাদা মেঘ - সবমিলিয়ে একটা চমৎকার রোমান্টিক পরিবেশ। ভালোবাসার মানুষটির ছোট্ট কোমল মুখের দিকে চেয়ে ভাবছেন পৃথিবীতে এইমুহুর্তে আপনার চেয়ে সুখী কেউই নেই। অতঃপর আলতো করে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেলেন পরম মমতায় একটা চুমু খাবেন বলে।
ঠিক এমনসময়েই ঘটনাস্থলে আবির্ভাব ঘটলো কিছু হালফ্যাশনের তরুণের। আচমকাই শুরু করে দিলো জেরা। এখানে কি, কি দরকার, সাথে মেয়ে টা কে, কি করেন, আমাদের চিনেন, কেন চিনেননা এসব। ওদের এগ্রেসিভ ইন্টারোগেশন সামলাতে না সামলাতেই দেখলেন আপনাকে ঘিরে ধরেছে তাদের পুরো গ্যাং। আপনার স্ত্রীর পাশেও দাঁড়িয়ে গেছে কয়েকজন।
তাদের হাবভাব দেখে আপনি আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছেন। বারবার মনে হচ্ছে সাথে আরো কয়েকজনকে আনা দরকার ছিল। কিন্তু এটা তো ছোট্ট একটা ট্রিপ, তারওপর জায়গাটাও মোটামুটি সেফ, মানুষের চলাচল থাকে, কখনো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। তাই নিঃসঙ্কোচে আসা। এরকম হবে কিছু ভাবেননি। কিন্তু এবার আপনার ভুল ভাঙছে। একলহমায় স্বর্গীয় ভালোবাসা থেকে নারকীয় ভয় ঘিরে ধরেছে আপনাকে। আপনি সহজসরল মানুষ। এসব মারপ্যাঁচ জানেননা। অতএব সময় থাকতে নিরাপদে সরে যাবার জন্য পা বাড়ালেন। কিন্তু ওরা সেই সুযোগ দিলে তো!
আচমকা বামগালে এক রামচড় আর চোখের নীচে এক শক্তহাতের ঘুষি খেয়েই আপনি লুটিয়ে পড়লেন। চোখে অন্ধকার দেখছেন ততক্ষণে। বসা অবস্থাতেই পেট বরাবর ক্যাডসের লাথি কষালো আরেকজন। অতঃপর প্রবল যন্ত্রণার ভেতরেই বিস্ফোরিত চোখে দেখলেন আপনার স্ত্রীকে চারপাশ থেকে জাপটে ধরেছে জনাছয়েক তরুণ। তারপর হাতপাবেঁধে শাড়িসায়া ছিঁড়ে মাটিতে ফেলতে কতক্ষণ!
আপনার স্ত্রী, আপনার ভালোবাসার অতি আদরের সম্পদ, যাকে আপনি মন্ত্র পাঠ করে, অগ্নি সাক্ষী মেনে, কবুল বলে সাক্ষীসাবুদ রেখে ঘরে তুলেছেন, যার সাথে জোছনা দেখে বৃষ্টিতে ভিজে কাটিয়েছেন বিনিদ্র রজনী, যাকে চটপট কবিতা বলে অবাক করিয়েছেন, তারপর সেই অবাক অবাক দুটা ডাগর চোখে হারিয়ে গিয়েছেন ঘন্টার পর ঘন্টা, আপনার সেই স্বপ্নমাখা প্রেয়সী, যার গায়ে আজতক একটা ধুলাও লাগতে দেননি, তাকে নির্দ্বিধায় রাস্তায় ফেলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ধর্ষণ করে চলেছে একাধিক যুবক!
আপনার হঠাৎ মনে হলো এসব বাস্তব নয়, এসব দুঃস্বপ্ন! আপনি তাদের কোনো ক্ষতি করেননি। তারা কে জানেনও না। এবারই প্রথম সাক্ষাৎ। কিন্তু আপনার কোনো অপরাধ না থাকলেও একমাত্র অপরাধ আপনি সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে তাদের এরিয়ায় এসেছেন। এলাকা ওদের বাপের। অতএব আপনার স্ত্রীর রেহাই তো নেই ই, আপনাকেও খালি চোখে দেখতে হবে এই পাশবিক নির্যাতন। এই দেশে এইটাই ল, এইটাই মোদ্দাকথা। কি? স্বামীর চোখের সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ, ভাবতেই গা গুলাচ্ছে না? বুক ভর হয়ে আসছে না? মনে হচ্ছে না আমার সাথেও হতে পারে?
মনে হওয়া দরকার। যারা ফেবুতে প্রেম বিরহ ভালোবাসা নিয়ে গল্পকবিতা পোস্ট লিখে, ফ্যান্টাসিতে ভুগে, তারা আদৌ জানে দেশে তারা স্ত্রী প্রেমিকাসহ কতটা অনিরাপদ? আপনার যত রোমান্টিসিজম সব এই অনলাইনে সীমাবদ্ধ। রাস্তায় আপনি তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক মাত্র। স্ত্রী নিয়ে বের হবেন, প্রেমিকাকে নিয়ে রিকশায় চড়বেন, যার যা ইচ্ছা এসে ধরে নিয়ে যাবে, মলেস্ট করবে টিজ করবে আর আপনি হাবার মত দেখে থাকবেন। বিচার পাবেননা। উল্টা আপনাকে সবাই শোনাই দিবে এসব মেয়েদেরই দোষ, বাজে ড্রেস পড়ে বের হবার শাস্তি!
এসবের সহজ সংজ্ঞা হল মগের মুল্লুক। সব কিছু সম্ভব। রোমান্টিসিজমের র না বুঝলেও রেপের র নিয়ে ভালোই পিএইচডি আছে এদেশের মানুষের। রাস্তায় মা বোন স্ত্রীকে নিয়ে সাবধানে চলাফেরা করা, আশপাশের অমানুষের চোখ থেকে হাত থেকে আগলে আগলে রাখা প্রত্যেকটা ছেলেই জানে এই যন্ত্রণা কি। "চোখ দিয়ে গিলে খেতে চাওয়া" বাগধারাটার উৎপত্তির কারণও বুঝা যায়।
আমি নারীদের এক্সপেরিয়েন্সের কথা বলব না। ওটা বললে বিশাল মহাভারত হবে। জাস্ট একটা বাসে সিট ধরার সময়ই হেল্পারের হাত ড্রাইভারের টিটকিরি প্যাসেন্জারদের হাতের থাবা ঘেষাঘেষিসহ একশোটা সমস্যা ফেস করতে হয় তাদের। এসব নিয়ে বলতে গেলে যে বক্তব্য হবে তা সাতদিন পড়েও শেষ হবেনা। তাই কেবল ছেলেদের বিষয়টাই বলছি।
বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে বের হলে যতজন পুরুষকে দেখবেন, তার আশি শতাংশই পারভার্ট। কিংবা আরো বেশি। কেউ সুযোগ পেয়ে প্রকাশ করে, কেউ সুযোগের অভাবে ভদ্রলোক। হোক সে অতি স্মার্ট হাই ফ্যাশনের শার্ট সানগ্লাস কেডস পড়া ফিটফাট যুবক অথবা নিতান্তই গেঁয়ো চেহারার লুঙ্গি স্যান্ডেল পড়া শ্রমিক কিংবা সুর্মা আতর দেয়া নূরানি চেহারার মুরব্বি। নারী মলেস্টেশনে কেউ পিছিয়ে নেই।
রুয়েটের সেই প্রফেসরের কথা মনে আছে? স্ত্রীর টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় যাঁকে রাস্তার ওপরেই ফেলে পিটিয়েছিলো কিছু যুবক? চিন্তা করে দেখেন, রুয়েটের পিএইচডি করা প্রফেসর, মার খাচ্ছেন রাস্তার ওপর, আর মানুষ দেখে চলে যাচ্ছে। শেষমেশ ফেসবুকে পোস্ট করে এটেনশন আদায় করতে হয়েছিলো প্রশাসনের। গতকালের সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের ঘটনাটা এটার উন্নত আরেকটা সংস্করণ ছাড়া কিছুই না। ধর্ষকদের চেহারাটা দেখলেই বুঝবেন রাস্তাঘাটে এ চেহারা প্রচুর কমন। এরকম এগ্রেসিভনেসও। শুধু সুযোগের অভাবে সবাই ভদ্র।
তনু রূপা নুসরাতদের ঘটনায় যেহেতু বিচার হয়নি, এটাও হবেনা। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা আর রাজনীতির খেল সবাইকে বাঁচিয়ে দিবে। তবে যেটা করা যায় সেটা হল, এদের ছবি জনসমক্ষে প্রকাশ করা, রাস্তায় ব্যানারে পোস্টারে টাঙিয়ে দেয়া, বাসার সামনে বড় বড় করে ধর্ষকের বাড়ি লিখে আসা, সকল সামাজিক সুযোগসুবিধা দেয়া বন্ধ করা। তাতেও যদি কিছু হয় আরকি।
পরিশেষে নীলা হত্যায় গ্রেপ্তারকৃত মিজান কিংবা আদিবাসী বোন ধর্ষণে গ্রেপ্তার নয়জন সেটেলার সম্পর্কেও একই কথা খাটে। এরা বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় বেরিয়ে যাবে। অতঃপর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে আবারো। আপনি আমাদের যত প্রতিবাদ সব অল্পতে সীমাবদ্ধ।
অতএব প্রেমিকা স্ত্রী নিয়ে বেশি রোমান্টিসিজম ছেড়ে দিন, বুঝতেই পারছেন আশা করি রাস্তায় স্ত্রীসহ বৃষ্টিতে ভেজা বা ধানখেতের আল ধরে হাঁটা কিংবা শিউলি কুড়ানো কতটা লেম এবং রিসকি এদেশে! সুতরাং স্বপ্ন দেখা বাদ দিন। বিয়ের পর মেইন ডিউটি হবে অর্ধাঙ্গীর ইজ্জত বাঁচানো!
এটাই শেষ কথা। বাই দা ওয়ে, সেটেলার বলায় যদি কারো আঁতে ঘা লাগে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে সুকৌশলে বাঙালিদের সেটল করিয়ে আদিবাসী সংস্কৃতি ধ্বংসের যে মাস্টারপ্ল্যান জিয়া বানিয়েছিলেন, যে প্ল্যান এখনো আদিবাসী বোনদের ধর্ষণ, জমিদখল ও বিতারণের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, সে প্ল্যান সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। আদিবাসী নারীদের নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগা ধ্বজভঙ্গ তো কম নেই দেশে। নিজেই প্রমাণ পেয়েছি অনেকবার।
করোনার চিকিৎসা তো একটা না একটা সময় ঠিকই আসবে। কিন্তু এই পারভার্ট রেপিস্টদের চিকিৎসা কখন আসবে? কুকুররা যে এসব শুনলে নিজেরাই লজ্জায় থুথু ফেলে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে!
ছবি কৃতজ্ঞতা- ঢাকা ট্রিবিউন, প্রথম আলো
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন