যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবো, ব্যাপারটা খুব সুন্দর। তবে, এর জন্য আপনার একটা র্যাশনাল মাইন্ড থাকতে হবে। অর্থাৎ, এমন মানসিকতা নিয়ে পড়া শুরু করবেন যে, আপনি কী বিশ্বাসে বিশ্বাসী সেটির কোন প্রভাব যাতে এই লেখাটি পড়বার সময়ে আপনার মনে না পড়ে।
(১) ফার্মেসির দোকানে গেলে সবাই বড় গলায় কথা বলে ব্যাপারটা তা নয়। স্যানিটারি প্যাড কিনতে যাওয়া মেয়েটি চিচি করে জানায় যে তার প্যাড লাগবে। ছেলেটি ফিসফিস করে কখনও বা ইশারা ইঙ্গিতে বোঝায় যে তার বড়বেলায় খেলার বেলুন লাগবে। ফার্মেসিওয়ালারাও প্যাড, কনডমকে নিষিদ্ধ অস্ত্র জ্ঞান করে খয়েরি রঙ্গা কাগজে মুড়ে দেয়, যাতে কেউ না দেখে, কেউ যাতে না জানে! কি এক ভয়ংকর ব্যাপার! যেনো একটা মেয়ের পিরিওড হবে এটা কেউ জানে না! ১৭ কোটি মানুষের দেশে কনডম ইউজ করা পাপই বোধ হয়, না হলে এতো লুকাছুপির তো কিছু থাকবার কথা নয়! যে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবো, ব্যাপারটা খুব সুন্দর। তবে, এর জন্য আপনার একটা র্যাশনাল মাইন্ড থাকতে হবে। অর্থাৎ, এমন মানসিকতা নিয়ে পড়া শুরু করবেন যে, আপনি কী বিশ্বাসে বিশ্বাসী সেটির কোন প্রভাব যাতে এই লেখাটি পড়বার সময়ে আপনার মনে না পড়ে।
দক্ষিণ ভারতের দিকে যদি আপনি তাকান, খুব চমৎকার কিছু স্ট্যাটিস্টিক্স দেখতে পাবেন। সারা ভারতের গড় শিক্ষিতের হার যেখানে ৭৪%, সেখানে এক দক্ষিন ভারতের শিক্ষিতের হারের গড় একাই ৮০%, আর কেরালার কথা বললে তো আলাদা করেই বলা লাগে, ৯৩ শতাংশেরও বেশী! অর্থাৎ, দক্ষিন অংশ বাদ দিলে গড় ৭৪% কিন্তু মুখ থুবড়ে পরবে! ভারতের এই অংশ শিক্ষিত হবার কারণে তারা বহুবিদ সুবিধা পাচ্ছে! শিক্ষা যে কতো দরকারি, সেটা এখানে তাকালে বোঝা যায়। সারা ভারতের দরিদ্রতার হার ৩৮%, অথচ দক্ষিনাংশের ক্ষেত্রে তা মাত্র ১৯%। ভারতের পার ক্যাপিটা ইনকাম প্রায় সব জায়গাতেই গড়ে ১৩০ মার্কিন ডলার, অথচ সাউথে তা ২৮০ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ দ্বিগুনেরও বেশী। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, মাতৃস্বাস্থ, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস সম্পর্কে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল পুরণ করবার কথা ভারতের ২০১৫ এর মধ্যে, সেখানে সাউথ ইন্ডিয়ার স্টেট গুলো ২০০৯ তেই তা পুরণ করে ফেলেছে। এই হলো শিক্ষার হার বৃদ্ধির সুফল।
(২) এতক্ষন সাউথ ইন্ডিয়ার একটা ছোটখাটো পরিচয় দিলাম। এবার তাদের একটি সুন্দর রিচুয়াল বা সংস্কৃতির একটা উৎসব এর ব্যাপারে বলি। সাউথ ইন্ডিয়ানরা তাদের কন্যাদের জীবনের প্রথম মাসিক বা রজঃচক্রের প্রথম দিনটিকে ঘটা করে পালন করেন, ঠিক যেনো বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো করে! যেহেতু এই রজঃচক্রের মধ্যে দিয়ে তাদের মেয়েটি বয়সন্ধিকালে প্রবেশ করছে, একটি নতুন জীবন পৃথিবীতে আনবার সক্ষমতা অর্জন করেছে, তাই এই দিনটিকে আনন্দের দিন হিসেবে পালন করে তারা। ব্যাপারটাকে শুধু আনন্দের দিন বললে একটু সাদামাটা হয়ে যায়। রীতিমতো কয়েকদিন ব্যাপি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়!
প্রথম দিনে, মেয়েটিকে গোসল করানো হয়। সবাই মিলে মেয়েটিকে গোসল করিয়ে দেয়। এরপর তাকে একটি আলাদা ঘরে নেয়া হয়। কয়েকদিনের জন্য সে ঘরে কোন পুরুষ প্রবেশ করতে পারে না। এ সময়টায় তাকে খুব স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো হয়। এসময় আরও কিছু পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। আগেরদিনে ১৫দিন এই ঘরে তাকে রাখা হতো, তবে সেটি এখন বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ৭দিনে নেমে এসেছে। ৭দিন পর বিশাল আয়োজন করা হয়। আত্মীয় স্বজনদেরকে দাওয়াত দেয়া হয়। চমৎকার অনুষ্ঠানের, খাওয়াদাওয়া পর্বের আয়োজন করা হয়। এই দিন হলুদ ও নিম এর পানি দিয়ে আবার গোসল করানো হয় এবং প্রথমবারের মতো উৎকৃষ্ট মানের সিল্কের শাড়ি পরিধান করানো হয়। সাথে ফুল, সুন্দর অলংকার থাকে, ঠিক যেনো নতুন বৌ! এ সময় আত্মীয় স্বজন সকলে তাকে আশীর্বাদ করেন ও উপহার দেন। এরপর গান বাজনার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। তবে শুধু সাউথ ইন্ডিয়া না, ভারতের উড়িষ্যাতেও এই অনুষ্ঠান দেখা যায়, এটাকে তারা বলে রজঃপর্ব। সেটিও কোন অংশে কম রোমাঞ্চকর নয়!
৩) লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, র্যাশনাল মাইন্ড সেট আপ নিয়ে লেখাটি পড়তে, না হলে অশান্তি লাগতে পারে। এ ক্ষেত্রে এসে আপনার মনে হতে থাকে, ওরা হিন্দু! এসব ওরা করবেই, আমরা কেনো এইসব করবো? প্রশ্ন হলো, আপনি কী করেন না? আপনি গায়ে হলুদ করেন, নতুন করে শুরু করেছেন মেহেদী নাইট। আপনি জামা কাপড় নকল করতে পারেন। আপনি সিনেমা নকল করতে পারেন। পারলে হিন্দীতে কথাও বলতে পারেন। পারেন না খালি ভালো কিছু গ্রহণ করতে। আপনাকে আমি বা কেউই বলছি না, সাউথ ইন্ডিয়ানদের মতো করে গোসল করানো বা তাদের রিচুয়ালগুলো পালন করতে। আপনাকে বলছি, কনসেপ্টটার দিকে তাকান।
এই যে আপনি, আমি, আমার বাবা কী করেছে? একটা ছেলে সন্তানের শিশ্নের অগ্রভাগের চামড়া কাটাকে কেন্দ্র করে হুলস্থুল নাড়াচাড়া ফেলে দেই আমরা! ধর্ম, তর্ক কিংবা বিজ্ঞানের খাতিরে আমি যতোই ধরে নেই যে এটার বেনেফিট বেশী, কিন্তু সত্য এটাই- এটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ। একটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করে কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করে, হাজার লোক দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছেন। অথচ, সেই শিশ্ন ব্যবহৃত হয় দুই কাজে। এক, প্রস্রাব করা। দ্বিতীয়ত, এটা একটু মহিমান্বিত কাজ, যৌন কর্মে অংশগ্রহন। তো, যৌন কাজে অংশ নেয়ার জন্যই যে যন্ত্রকে শান দেয়া আর শান দেয়া উপলক্ষে দুনিয়াকে জানিয়ে খাওয়া দাওয়া করানো, সেই একই কাজে অংশ নিবে একটি যোনীও। তো, সেখানে প্রকৃতিবিরুদ্ধ তো নয়ই, বরং প্রকৃতি নিজে পরিস্ফুট হচ্ছে, সেটি নিয়ে আপনার এতো লজ্জা, এতো ফিসফিস! এটা শুধু সাউথ ইন্ডিয়ানরা না। সাউথ আফ্রিকা, জাপান, ফিলিপাইন, কানাডা, মেসিডোনা, ক্রোয়েশিয়া, ইসরায়েল, ইতালি, ব্রাজিল, আইসল্যান্ড সহ আরও অনেক দেশেই এ ধরণের রিচুয়াল আছে, তারাও তাদের কন্যার জীবনের রজঃচক্রের প্রথম দিনটিতে আনন্দের সাথে, উৎসব করে, উদযাপন করে।
৪) আমাদের দেশে এই ধরণের কনসেপ্টে অনুষ্ঠান করবার মাধ্যমে একটি মেয়েকে তার জীবনের খুব গুরুত্বপুর্ণ একটি ভ্রমনের শুরুকে আনন্দদায়ক করা যায় কি না, সেটি ভেবে দেখা যেতে পারে। তবে, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এই ধরণের কোন উৎসব শুরু করলেও, সেটি শুরু হওয়া উচিৎ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের ঘর থেকে। যদিও যে কোন বিদেশী জিনিস আমদানী সাধারণত উচ্চবিত্তের হাত ধরেই ঘটে (যেমনঃ হ্যালোইন, কমিক-কন ইত্যাদি), তবে আমি খুব করে চাই এটি মধ্য/নিম্ন মধ্যবিত্তের হাত ধরে প্রবেশ করুক। কারণ, উচ্চবিত্তের হাত ধরে প্রবেশ করলে নিম্নবিত্তের কাছে সেটি গ্রহনযোগ্য নাও হতে পারে, তারা বিভিন্ন দিক থেকে সেটিকে নাল এন্ড ভয়েড করে দিতে পারে। যেমন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে কিংবা, শ্লীলতার মাপকাঠিতে অথবা, ধনিক শ্রেণির প্রতি এক ধরণের রেবেল মানসিকতা থেকে। কিন্তু, ব্যাপারটা মধ্যবিত্তের হাত দিয়ে আসলে, ইমিডিয়েট নেক্সট শ্রেণি হিসেবে নিম্নবিত্ত শ্রেণি সেটিকে লুফে নিবে আশা করা যায়, যেভাবে পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, বইমেলা ইত্যাদি উৎসবগুলো তারা গ্রহন করেছে সাদরে। মধ্যবিত্তের এই উৎসবটিকে উচ্চবিত্তের লোকেরা লুক্রেটিভ, ল্যাভিশ আবরণে সজ্জিত করে গ্রহন করবে কিন্তু নিজেদের মতো করে। শ্রেণি বিভাজন ঘটলেও, আখেরে লাভ আমাদের কন্যাদেরই, সে শিল্পপতির কন্যা হোক আর গার্মেন্টস কন্যাই হোক।
পিরিওড কিংবা মাসিক হবে একটি আনন্দের ব্যাপার, ট্যাবু ভাঙবে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পিরিওড নিয়ে কথা বলবার যে জড়তা, সেটি কাটবে। জানি, এক দিন, এক মাস কিংবা এক বছরে এটি হবে না। তবে, আমি আশাবাদী। ভারত থেকে ফেন্সিডিল আনতে পেরেছি, ন্যাংটো, সেক্সুয়াল এক্সপ্লিসিট গান, সিনেমা আনতে পেরেছি। আজ হোক, কাল হোক, চেষ্টা করলে এরকম দারুণ একটি উৎসবও আনতে পারবো, এই আশা আমি, আমরা রাখতেই পারি। একটি মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে জন্ম দেয়ার মতো ক্ষমতা আমাকে, আমার বাবাকে কিংবা আমার ছেলে সন্তানকে স্রষ্টা কিংবা প্রকৃতি যেহেতু দেয়নি, সেহেতু এটা মেনে নেয়াই যায় যে এটা বিশেষ কিছু। তো, এই বিশেষ ব্যাপারটা ঘটুক আনন্দের সাথে, চাপা ভয়ের সাথে নয়। আর, আমরা বাঙ্গালীরা তো চান্স খুজি ভালো মন্দ খাওয়ার! একদিন না হয় পোলাও-মাংস খাওয়ার একটা সুযোগ বাড়লোই, খারাপ কী!