ইদানিং লা লীগায় পেনাল্টি বিতর্ক চরমে উঠেছে! পেনাল্টি দেয়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক অবশ্যই থেকে যাবে। কিন্তু পেনাল্টি থেকে গোল দেয়া সহজ বা সস্তা বলতে চাইলে আপনাকে আগে ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের সাথে একটু বসতে হবে!
ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলকে সব সময়ই ট্রলের শিকার হতে দেখেছি। দায়টা মূলত ইংলিশ মিডিয়ার। তারা নিজেদের দলকে উপরে ওঠাবার সময় বাকি দলগুলোকে গোনাতেও আনে না। তো ধরা খাবার পর ট্রল খায় তাদের জাতীয় দল। একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে ১৯৫০ এর বিশ্বকাপ। সেবার গ্রুপ পর্বে অ্যামেচার দল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইংল্যান্ড ০-১ এ হেরেছিল। খবর পৌছুবার পর ইংল্যান্ডের মিডিয়াগুলো তা ভুল মনে করে পরদিন সংবাদপত্রে ছাপিয়ে দেয় ইংল্যান্ড ১০-১ যুক্তরাষ্ট্র। তারা মনে করেছিল যে, ০ এর আগে ১ লেখা হয়নি ভুলে। হাস্যকর তবে এই ঘটনাটা আসলে একটি মিথ্। এমনটা সত্যিকার অর্থে ঘটেনি যে ইংলিশ মিডিয়া ০-১ কে ১০-১ বানিয়ে ছাপিয়েছিল। তো ব্যাপারটা এমন যে ইংলিশ মিডিয়া করে ওভাররেট আর অন্যান্যরা আন্ডাররেট।
ইংল্যান্ড নিজেদের নামের সুবিচার খুব কমই করতে পেরেছে। একটা কারণ হচ্ছে- টাইব্রেকার ও এর যাবতীয় দিকগুলো। অবশেষে রবার্ট ব্রুসকে গুরু মেনে বিশ্বকাপ+ইউরো মিলিয়ে ৭ম বারের প্রচেষ্টায় প্রথম টাইব্রেকারে জয়লাভ করলো গত বিশ্বকাপে। ফিফা '৯০ সেমিতে জার্মানি, ইউরো '৯৬ সেমিতেও জার্মানি, ফিফা '৯৮ রাউন্ড অফ সিক্সটিন এ আর্জেন্টিনা, ইউরো '০৪ কোয়ার্টার ফাইনালে এ পর্তুগাল, ফিফা '০৬ কোয়ার্টার ফাইনালেও পর্তুগাল এবং ইউরো '১২ কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির কাছে টাইব্রেকারে পরাজিত হয় ইংল্যান্ড। প্রায় আড়াই যুগের অভিশাপ মোচন করলো ইংল্যান্ড গত বিশ্বকাপেই।
পেনাল্টিতে গোল করলেও ট্রল, আবার মিস্ করলেও ট্রল। অদ্ভূত আমরা! ট্যাকনিকাল ব্যাপারগুলো বাদ দিয়ে এক মানসিক দিকটাই তো সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। ম্যারাডোনা তার ক্যারিয়ারের একটা সময়ে টানা ৫টি পেনাল্টি মিস্ করেছিল। তবুও ম্যারাডোনা ম্যারাডোনাই, ওটা ছিল- 'শিট হ্যাপেনস্'। মারটিন পালের্মো তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়টাতে- ২৬ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালের কোপা আমেরিকায় কলোম্বিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচেই ৩টি পেনাল্টি মিস্ করে গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকের এক লজ্জাজনক রেকর্ডে নাম লেখায়। আর্জেন্টিনা ম্যাচটি হারে ০-৩ এ। গ্রুপের পরের ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে গোল করে জিতিয়েছিল সে, টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার পক্ষে সর্বোচ্চ ৩ গোল করেছিল- কিন্তু সে বছরই মাত্র ৭টি ম্যাচেই জাতীয় দলে তার ইতি ঘটে। দেশেও থাকতে পারছিল না। প্রতিনিয়ত 'ফুটবল কি আর খেলবেন?' প্রশ্ন সইতে না পেরে দেশ ছেড়ে স্পেনে চলে গিয়েছিল। ৪ বছর পর নীরবে ফিরে আসে ভালোবাসার বোকা জুনিয়রর্সে, বনেছিল বোকার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ১০ বছর পর সবাইকে চমকে দিয়ে ফিরেছিল জাতীয় দলে। পেরুর বিপক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের ইনজুরি টাইমে গোল করে '১০ বিশ্বকাপে তোলে আর্জেন্টিনা কে। প্রথম বারের মত বিশ্বকাপে খেলে পালের্মো। ম্যারাডোনার অধীনে সেই বিশ্বকাপে গ্রীসের বিপক্ষে গোল করে ম্যারাডোনাকে সরিয়ে বিশ্বকাপে গোল করা সবচেয়ে বয়স্ক আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় হয় সে। এটা একজন খেলোয়াড়ের নিজের অভিশপ্ত ছায়াকে জয় করার গল্প।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পেনাল্টি দক্ষতায় প্রশ্ন তোলার প্রশ্নই আসে না। একই কথা মেসির ক্ষেত্রেও খাটে। উভয়ের ক্যারিয়ারে পেনাল্টি কনভার্সন রেট ৮০% এর উপর। পেলের ক্যারিয়ারে পেনাল্টি মিসের প্রমাণ নাকি নেই। আমি আমার ক্যাম্পাস ক্যারিয়ারে ১৭ পেনাল্টি থেকে ১৫টি গোল করেছি। ক্যাম্পাস ক্যারিয়ারের শেষের দিকে নেয়া শেষ ২টি পেনাল্টি শটের ২টিই মিস্ করে প্রমাণ করেছি আমিও মানুষ! ওই সময়ে অন্যান্য ম্যাচ যোগ করলে ৪ পেনাল্টির ৩টিই মিস্ করেছি। মানসিকতার কথা বলছিলাম- ক্যাম্পাসে বিজয় দিবস ফুটবল ম্যাচের ফাইনালে ০-১ এ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় ম্যাচ শেষ হবার মাত্র মিনিট তিনেক আগে যখন দলের প্রাপ্ত পেনাল্টি নিতে হেঁটে এগোচ্ছিলাম তখন প্রতি পদে মানসিকতার আত্মবিশ্বাস-দুর্বলতা অংশদ্বয়ের টানাহেঁচড়ার যে সঙ্কট চলছিল, তার বর্ণনা শুধুমাত্র পেনাল্টি নেয়া লোকেরাই বলতে পারবে।
বিশ্বকাপে পেনাল্টি থেকে সবচেয়ে বেশি ৪টি গোল করেছে পর্তুগালের ইউসেবিও, নেদারল্যান্ডস্ এর রোব রেনসেনব্রিঙ্ক- উভয়ই এক আসরেই এবং আর্জেন্টিনার বাতিস্তুতা দুই আসর মিলে। প্রত্যকেরই হিসাব টাইব্রেকার বাদে। বিশ্বকাপে হ্যারি কেইনের পেনাল্টি গোল ইতিমধ্যে ৩টি (টাইব্রেকার বাদে)। সৃষ্টিকর্তা তাকে পাঠিয়েছেন ইংলিশদের টাইব্রেকার মাসাকার্ থেকে মুক্তি দিতে- কেইন তাই গত বিশ্বকাপের রাউন্ড অফ সিক্সটিন এ কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে ইংলিশদের হয়ে প্রথম শটটা নিয়ে উপলক্ষ্যটা তৈরি করে দিয়েছিল।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন