হাজারো মানুষের জীবন বাঁচিয়েও যিনি জেল খাটছেন আজ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

'রুয়ান্ডা গনহত্যা'র মধ্যেও বারোশো মানুষকে বাঁচিয়ে হিরো বনে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেলো কিছু অদ্ভুত তথ্য। তিনি হিরো না ভিলেন, তা নিয়েও শুরু হলো সন্দেহ...
অস্কারের জন্যে মনোনীত 'হোটেল রুয়ান্ডা' সিনেমা নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন। রুয়ান্ডায় টুটসি বাহিনীদের উপরে হুটুদের নির্যাতন ও মাসকিলিং এর যে বর্বরতা, সেটি সিনেমায় উঠে এসেছিলো খুব অসাধারণভাবেই। তবে 'হোটেল রুয়ান্ডা' সিনেমায় এই গনহত্যার সাথেসাথেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো এক মানুষের গল্প। যার নাম পল রুসেসআবাগিনা, যিনি এই গনহত্যার সময়ে বাঁচিয়েছিলেন এক হাজারেরও বেশি মানুষকে। যে ঘটনার কারণে সারাবিশ্ব তাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে। যার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ হলিউডে ভাস্কর্যও আছে। ডম শ্যামলার যেই মানুষটির চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে 'হল অব ফেইম' এর আরেকটু উপরের স্তরেই উঠে গিয়েছেন। সেই মানুষটিই গ্রেফতার হলেন সম্প্রতি।
পল রুসেসআবাগিনার গ্রেফতারের ঘটনাতে যাওয়ার আগে রুয়ান্ডার সেই গনহত্যা নিয়ে একটু জানা যাক। ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল তারিখে রুয়ান্ডার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানার বিমান বহরে হামলা করে অজ্ঞাত আততায়ীরা। এই হামলায় প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা ও তাঁর সঙ্গে থাকা বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সহ আরও আটজন নিহত হন৷ প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা ছিলেন হুটু জনগোষ্ঠীর সদস্য। ধারণা করা হয়, টুটসি জনগোষ্ঠীর আতঙ্কবাদীরা এই হামলা চালিয়েছে৷ এই হামলার পরদিন থেকে ধরে ধরে টুটসি'দের মারা শুরু হয়। প্রায় ১০০ দিন ধরে চলা গণহত্যায় প্রাণ যায় প্রায় আট লক্ষ মানুষের৷ মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, রাজনীতিক কেউ রেহাই পায়নি এই হত্যাযজ্ঞের নির্মমতা থেকে।
গনহত্যা নিয়ে খুব বেশি বিস্তারিত বলার কিছু নেই। যারা 'হোটেল রুয়ান্ডা' দেখেছেন তারা বর্বরতার অনেকটুকুই জানেন, বা, যারা এখনো জানেননা- গুগলে জেনে নিতে পারেন৷ তবে এক কথায় যদি বলা হয়- নরক নেমে এসেছিলো যেন রুয়ান্ডার বুকে তখন।
যাই হোক, হুটুরা গনহত্যা শুরু করার পর টুটসিরা যে চুপচাপ বসে থেকেছে বিষয়টা তা নয়। টুটসি বিদ্রোহীদের দল আরপিএফ'ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলো যুদ্ধ শুরুর পরপরেই। এবং শেষে এসে তারা রাজধানী কিগালির নিয়ন্ত্রণ নিয়েও ফেলে। কিগালির দখল নেয়ার পর আরপিএফ নেতা মেজর জেনারেল পল কাগামে ১৯৯৪ সালের ১৮ জুলাই যুদ্ধ শেষের ঘোষণা দেন৷ তিন মাস ধরে চলা গণহত্যার সমাপ্তি ঘটে৷ এরপর থেকে অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে কাগামে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
এই হচ্ছে গনহত্যার ইতিহাস। এবার আমরা ফিরি পল রুসেসআবাগিনার দিকে, যিনি গ্রেফতার হয়েছেন সম্প্রতি। রুয়ান্ডার তদন্ত ব্যুরো জানায়- রুসেসআবাগিনাকে অপহরণ, হত্যা, সন্ত্রাসবাদ এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সহিংস ও সশস্ত্র চরমপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। তবে অনেকেই জানাচ্ছেন, এই গ্রেফতারের একমাত্র কারণ- তিনি প্রেসিডেন্ট কাগামের অনেক বড় সমালোচক। আর সমালোচককে নিকেশ করে ফেলাই তো রাজনীতিবিদ'দের প্রধাণ কাজ।
তবে পল রুসেসআবাগিনা রুয়ান্ডাতে ছিলেননা। গনহত্যার পরপরই তিনি দেশ থেকে চলে যান। কারণ, তার উপরেও হত্যার হামলা চালিয়েছিলো অজ্ঞাত আততায়ীরা। এ ঘটনার পরেই তিনি চলে যান বেলজিয়াম। বেলজিয়াম ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে তিনি ছিলেন এত বছর। এবং প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন। প্রেসিডেন্ট 'কাগামে'কে 'স্বৈরশাসক' সহ নানারকম কথাবার্তাই বলেছেন রুসেসআবাগিনা, বিভিন্ন প্রসঙ্গে। সুতরাং, এ আটক যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই তা একরকম নিশ্চিতই ছিলো।
সেখানেও সমস্যা ছিলো না। এরকম একজন 'ন্যাশনাল হিরো'কে কেন গ্রেফতার করা হলো, সে নিয়েও আফসোস হচ্ছিলো। কিন্তু তখনই কয়েকটা টুকরো টুকরো ইতিহাস মনে পড়ে যায়। যেই ইতিহাসের সাথে হলিউডের 'রুয়ান্ডা হোটেল' সিনেমার কাহিনীতে বিস্তর ফারাক। সিনেমাতে আমরা দেখি, পল রুসেসআবাগিনা, যিনি ছিলেন একজন হুটু এবং বিয়ে করেন একজন টুটসিকে, যুদ্ধকালীন সময়ে তার নিয়ন্ত্রিত 'হোটেল দেস মিলে কলিনেস' এ প্রায় ১২০০ জন মানুষকে আশ্রয় দেন এবং তাদের উপর যাতে কোনোরকম হামলা হয়, সেটির জন্যে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
মজার ব্যাপার হলো, সিনেমাতে পল রুসেসআবাগিনা'র এই গ্লোরিফিকেশন বাস্তবে অনেকটাই ফিকে হয়ে যায় যখন ইতিহাস আমাদের জানায়, ঐ হোটেলটি ছিলো তখন রুয়ান্ডার সবচেয়ে বেশি ফোকাসে। আন্তজার্তিক গনমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানেরা নজর রেখেছিলো ঐ হোটেলটিতে। কারণ বিভিন্ন দেশের শয়ে শয়ে মানুষ ছিলেন ঐ হোটেলটিতে। এখন উগ্রপন্থীরা যদি ঐ হোটেলে আক্রমণ করতো, তাহলে আন্তজার্তিকভাবেই একটা ম্যাসাকার হতো। সব দেশই তাদের নাগরিককে বাঁচানোর জন্যে সৈন্য পাঠাতো। যেটা হতো ভয়ঙ্কর এক কাজ। তাছাড়া, হুটু ও টুটসি দুই দলেরই বহুসংখ্যক রাজনীতিবিদ ছিলেন এই হোটেলটিতে। তাই আক্রমন করাটা রিস্কি ছিলো। সবচেয়ে বড় কথা- আমেরিকা থেকে খুব স্পষ্ট বার্তা ছিলো- এই হোটেলটিতে কোনো আক্রমণ করা যাবেনা। এতগুলো কারণের ফলশ্রুতি হচ্ছে এই হোটেলের মানুষগুলোর জীবিত থাকা। এখন সিনেমায় যেভাবে একজন মানুষের অবদানকেই সবচেয়ে বড় করে দেখানো হয়েছে, সেটি সমস্যার।
তাছাড়া অনেক মানুষজন, যারা এই হোটেলে যুদ্ধের সময়ে আটকে ছিলেন, তারা অভিযোগ করেছেন, রুসেসআবাগিনা তাদের থেকে মোটা অঙ্কের ভাড়া চাইতেন। এটা অবাক করেছিলো সবাইকেই। যে মানুষটি আশ্রয় দিচ্ছেন মানুষজনকে, তিনি আবার মোটা অঙ্কের টাকা কীভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন, তা বোধগম্য হয়নি অনেকেরই।
তাছাড়াও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিলো, বিদ্রোহীদের মদদ দিচ্ছেন তিনি। এছাড়াও গনহত্যা শুরুর আগের দিনও তাকে আর্মিদের খাবার ও ওয়াইন সরবরাহ করতে দেখা যায়। যদিও এই ঘটনাগুলোকে 'কাগামে'পন্থীদের অপপ্রচার বলে বরাবরই চালিয়েছেন রুসেসআবাগিনার সমর্থকেরা।
তবে যেটাই হোক না কেন, রুসেসআবাগিনার এই রহস্যজনক গ্রেফতার যেমন প্রশ্ন তুলছে সবার কাছে, তেমনি যুদ্ধকালীন সময়ে তার মানবতাবাদী কাজ আসলে কতটুকু ঠিক ছিলো আর কতটুকু লোক দেখানো, সে প্রশ্নও রয়ে যায়। অনেক প্রশ্নের মীমাংসা হওয়ার আগেই তাকে কেন ল্যান্টোস হিউম্যান রাইটস প্রাইজ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদকে ভূষিত করা সহ অজস্র মানবাধিকার পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, সেটি অনেকের মনেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সবমিলিয়ে তৈরী হয়েছে বেশ অন্যরকম এক ধোঁয়াশার।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন