একবারও ভাবছি না যে একটা মিথ্যা কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে, আমার ভুলে একজন ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে গেলে কতশত রোগী প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

ঘটনা এক

রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের (সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) সার্জারী বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন এক রোগী। ভর্তির সময় তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোত্থেকে এসেছেন তারা। সবাই জানিয়েছিলেন, তারা মাদারীপুর থেকে এসেছেন। কিন্তু অস্ত্রোপচার শেষে জ্ঞান ফেরার পর রোগীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন! জ্বী, করোনাভাইরাসের ক্লাস্টার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে যে জায়গাটাকে, সেখান থেকেই। নারায়ণগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে আসাটা অপরাধ নয়, কিন্ত সত্যি উত্তরটা দিলে হয়তো চিকিৎসকরা বাড়তি সতর্কতা ব্যবহার করতে পারতেন অপারেশন করার সময়।

যে চিকিৎসক এবং নার্সরা সেই রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে কোভিড-১৯ টেস্ট করার সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিন জানা যায়, রোগী করোনা পজিটিভ। তখনই মিটফোর্ডের ইমার্জেন্সি ওটি এবং পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড লকডাউন করা হয়। একদিন পরে রিপোর্ট এলো চিকিৎসকদের, সেই রিপোর্ট হাতে পেয়ে চমকে উঠলো সবাই। চারজন চিকিৎসক, চারজন নার্স ও তিনজন বয় কোডিভ পজিটিভ! সংক্রমিত হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন হাসপাতালে কর্মরত সার্জারি ও গাইনি বিভাগের পাঁচজন চিকিৎসক, চারজন নার্স ও তিনজন অন্য স্বাস্থকর্মী।

ঘটনা দুই

পহেলা বৈশাখের দিন ভোরবেলায় বারডেম হাসপাতালে এক রোগীকে আনা হলো শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে। রোগীর স্বজনদের দাবী, আগে থেকেই নাকি তার হার্টের সমস্যা আছে, এই বলে তারা রোগী ভর্তি করাতে চাইলেন। করোনা সম্পর্কিত সব প্রশ্নের জবাবেই তারা না না করে উড়িয়ে দেয়। লক্ষণ দেখে চিকিৎসকদের সন্দেহ হলেও, স্বজনদের জোরাজুরিতে সেই রোগীকে ভর্তি করাতে একরকম বাধ্য হন তারা।

অথচ রাতে স্বজনরা ডাক্তারদের জানান, রোগী করোনা পজিটিভ, আইইডিসিআর থেকে আসা মোবাইল মেসেজও দেখান প্রমাণ হিসেবে! সেই মেসেজেই স্পষ্ট লেখা আছে, রোগীকে আইসোলেশনে রাখার কথা, আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে বলেও জানানো হয়েছে সেই মেসেজে। এরপরেও রোগীর স্বজনদের তোর সয়নি, তথ্য গোপন করে তারা রোগীকে নিয়ে এসেছেন বারডেম হাসপাতালে, যেটা কিনা করোনার জন্যে স্পেশালাইজড কোন হাসপাতাল নয়। ফলাফল? যেসব ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী সেই রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে!

বারডেমের সেই রোগীর রিপোর্ট

ঘটনা তিন

সুনামগঞ্জের এক প্রসূতি মা জরুরী প্রসবকালীন চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সুনামগঞ্জে ডেলিভারী ট্রায়াল দিয়ে ব্যর্থ হবার পরে রোগীকে নিয়ে আসা হয়েছিল সিলেটে। হাসপাতালে তার সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছিল। প্রসবের পরে করোনার উপসর্গ জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে কোভিড ১৯ সাসপেক্ট হিসেবে টেস্ট করা হয় এবং রিপোর্ট পজিটিভ আসে। চিকিৎসা, অপারেশন, পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার সহ চিকিৎসার প্রয়োজনে ১৯ জন চিকিৎসক উনার সংস্পর্শে আসেন। এই ঘটনায় ১৯ জন চিকিৎসক, ১৪ জন নার্স ও ১১ জন স্টাফ সহ মোট ৪৪ জন ফ্রন্টলাইন কোভিড-১৯ ফাইটারকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।

না, সেই প্রসূতি মা’কে আমরা দোষ দিচ্ছি না। দোষটা তার স্বামীর। সেই ভদ্রলোক (!) সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জে ফিরেছেন। নারায়ণগঞ্জ- যে জায়গাটা করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, শ’খানেক মানুষ আক্রান্ত হবার পরে পুরো জেলা লকডাউন হয়েছে, সেই মৃত্যুকূপ থেকে তিনি পরিবারের কাছে ফিরেছেন ভাইরাস নিয়ে, কোয়ারেন্টাইনের ধার না ধরে স্ত্রীর সংস্পর্শে এসেছেন, তাকেও আক্রান্ত করে ফেলেছেন। এবং পুরো ঘটনাটাই গোপন করে গেছেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

ঘটনা চার

গাজীপুর জেলা লকডাউন করা হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে। সেই লকডাউনের মধ্যেই এক শ্রীমান গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার লকডাউনকৃত এলাকা থেকে পালিয়ে চলে এসেছেন ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি হয়ে সেই রোগী জনাকয়েক ডাক্তারকে উনার হিস্ট্রি বলেছেন- ১ মাসের জ্বর, তল পেট ব্যাথা। একবারের জন্যও বলেননি যে তার কাশি আছে, তার বাড়ি লকডাউন করা, এমনকি করোনা সন্দেহে তার নমুনা পর্যন্ত কালেক্ট করে কোভিড পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে শ্রীপুর থেকেই। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই রোগীকে পেটের ব্যাথার জন্য আল্ট্রাসাউন্ড করানো হয় ওয়ান স্টপে। নিয়ে যাওয়া হয় হুইল চেয়ার বা ট্রলিতে লিফটে করে। তার আল্ট্রা করার পর ওই একই টেবিলে আরো কয়েকশো আল্ট্রা হয়েছে। ওই ট্রলি দিয়েও ২০-২৫ জন কমপক্ষে আনাগোনা করেছেন।

এরপর তিনি তো নিশ্চয়ই ওয়ার্ডে বিচরন করেছেন, টয়লেটেও গিয়েছেন। বেশ কয়েকজন ডাক্তার-নার্স তাকে দেখেছেন। তথ্য গোপন করে এভাবে চিকিৎসা পাওয়ার পর দ্বিতীয় দিন (গতকাল) জানা গেছে সেই রোগী কোভিড-১৯ পজিটিভ। উনিই শুধু নন উনার স্ত্রীও পজিটিভ। পেশায় গার্মেন্টস কর্মী ওই রোগীর তথ্য গোপনের কারণে এখন তিনি যে ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন, সেই ওয়ার্ডের ৬ চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীসহ মোট ১৮ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড লকডাউন করা হয়েছে। সেই ওয়ার্ডের ১২ জন রোগীকেও আলাদাভাবে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।

একের পর এক ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে যেতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীদের বলা মিথ্যার কারণে

ঘটনা পাঁচ

ঢাকার যাত্রাবাড়ির আজগর আলী হাসপাতালে শ্বাসকষ্টের কথা গোপন করে ভর্তি করা হয়েছিল মুফতি আবদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে। অথচ তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন, যেটা পরে জানা গেছে। আজগর আলী হাসপাতাল থেকে স্বজনরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানেও তারা করোনার লক্ষণগুলোর কথা কিছু জানাননি ডাক্তারদের। ফলে দুই হাসপাতালেই একাধিক ডাক্তার এবং বেশ কয়েকজন নার্স, যারা সেই রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন- তাদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।

পাঁচটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম, যেগুলো আমান্দের কানে এসেছে, মিডিয়া জেনেছে, খবর হয়েছে। অথচ বাস্তবে এরকম ঘটনা পাঁচশো-এক হাজার হলেও অবাক হবার কিছু নেই। সব গল্প তো আর ফেসবুকে ভাইরাল হচ্ছে না। ে পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া ডাক্তার-নার্সেরে সংখ্যাটা প্রায় দুইশোর কাছাকাছি। করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে আমরা বারবার ডাক্তার-নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র’ হিসেবে উল্লেখ করছি, আবার নিজেরাই এই ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়রদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দিচ্ছি। নির্লজ্জ-ইতরের মতো আমরা নিজেদের কথাটাই ভাবছি শুধু, এটা একবারও ভাবছি না যে একটা মিথ্যা কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে, আমার ভুলে একজন ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে গেলে কতশত রোগী প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

সারাক্ষণ ‘আমি আমি আমি’ নিয়ে ব্যস্ত থাকা স্বার্থপর আমরা বুঝতে পারছি না, বা বোঝার চেষ্টাও করছি না যে, সত্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কীভাবে নিজেদের জালে আত্মঘাতি গোল দিচ্ছি বারবার। এমনটা চলতে থাকলে একের পর এক হাসপাতাল বন্ধ হবে, ডাক্তারেরা দলে দলে কোয়ারেন্টাইনে যাবেন। যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকেরা থাকবেন না, আমাদের ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়রেরা অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকবেন বিছানায়, সেটা হলেই মনে হচ্ছে ভালো হবে। এমন ইতর আর বর্বর মনোবৃত্তি যারা লুকিয়ে রাখে, যারা চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কথা না ভেবে, অন্য রোগীর কি হবে সেটা মাথায় না এনে শুধু যে কোন মূল্যে মিথ্যে বলে হলেও নিজের চিকিৎসাটাই করাতে চায়- তাদের আসলে ট্রিটমেন্ট পাওয়ারই যোগ্যতা নেই!

বিশেষ দ্রষ্টব্য- ফিচার্ড ইমেজটি প্রতীকি। ইনি করোনায় আক্রান্ত রোগী নন। 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা