'ফিউচার স্টার্টআপ' এই অ্যাপ নিয়ে মন্তব্য করেছে, ঢাকা শহরের দৃশ্যপট পালটে দেয়ার ক্ষমতা রাখে 'পার্কিং কই' নামক এই উদ্যোগ। যানজটের এই শহরে পার্কিং সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে উদ্যোগটিকে আশীর্বাদ বলা যায়।

পার্কিং নিয়ে এরকম যে হবে এটা আগেই জানতাম। আগেও একবার এমন হয়েছে। ঘটনাটা খুলেই বলি। টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। এমন সময়ে হুট করে শাহীন ভাই ফোন করলেন। উদ্বেগ এবং আতংক নিয়ে বললেন, ভাই তাড়াতাড়ি গাড়ির সামনে আসেন, বিপদ আছে! অর্ধেক কাপ চা রেখেই হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির সামনে গেলাম। এইদিকে এসেছিলাম ব্যাংকের একটা কাজে৷ গাড়িটা পার্ক করার জায়গা ছিল না। পুরানা পল্টনের এক গলিতে গাড়িটা পার্ক করে রেখেছিলেন শাহীন ভাই। আশেপাশে পার্কিংয়ের কোনো জায়গা খুঁজে পাননি। তাই, রাস্তার উপর এভাবে গাড়ি পার্ক করে রাখা ঠিক না জেনেও তাকে রাখতে হয়েছে। তাছাড়া, এইদিকে এভাবে গাড়ি রাখার আরো ঝামেলা আছে। মাঝে মধ্যে পুলিশ এসে মামলা দিয়ে দিতে পারে। কখনো র‍্যাকার বিল ধরিয়ে দিতে পারে। সম্ভবত সেটাই হয়েছে। আমি গাড়ির সামনে গিয়েই বুঝলাম মূলত পুলিশের ভয়েই শাহীন ভাই তটস্থ। তিনি গাড়ি স্টার্ট দিয়েই রেখেছিলেন। আমি গাড়িতে বসার সাথে সাথেই ব্যাক গিয়ারে গলি থেকে বের হয়ে বলতে লাগলেন, বড় বাঁচা বাইচা গেলাম। র‍্যাকার লাগাইলে খবর আছিলো!

অবৈধ পার্কিংয়ে সারি সারি গাড়ি। যা যানজটের অন্যতম কারণ।

মেজাজটা খারাপ লাগছিল অন্য কারণে। শাহীন ভাই গলিতে পার্ক করেছিলেন গাড়ি, প্রধান সড়কেও রাস্তার দুইপাশে ভবনগুলোর সামনের রাস্তায় সারি সারি গাড়ি পার্ক করে রাখা থাকে। শহরের যেদিকেই তাকান, একই দৃশ্য দেখবেন। এই শহরের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণাগুলোর একটা হলো, যানজট সমস্যা। রাস্তার তুলনায় গাড়ি বেশি, গাড়ির তুলনায় মানুষ তারচেয়েও বেশি। এর মধ্যে সড়কের একটা অংশ পার্কিং করা গাড়ির দখল যানজটকে আরো বাড়ায়। এইভাবে পার্কিং করা আসলে অবৈধ কিন্তু সবাই ইচ্ছা করেই রাস্তায় গাড়ি রাখেন তাও নয়, অনেকেই নিরুপায়। তারা জানেন না, আশেপাশে কোথায় পার্কিংয়ের নিরাপদ জায়গা আছে। তাদের কাছে তথ্য নেই যে, ঠিক কোথায় গাড়ি রাখলে গাড়িও নিরাপদে থাকবে এবং রাস্তার উপর অবৈধভাবে পার্কিং করে প্রতি মুহূর্তে দুশ্চিন্তা নিয়ে থাকতে হবে না। সমাধান আছে? আছে! সেদিন বাসায় এসেই গুগলে সার্চ করলাম। পার্কিং সমস্যা নিয়ে কোনো ধরণের কাজ হয়েছে কিনা দেখার জন্যেই গুগল করলাম। সাথে সাথে বেশ অবাক হলাম এটা জেনে, পার্কিং সমস্যার মতো এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা টেকনোলজির ব্যবহার করেই সমাধান সম্ভব। হাতে স্মার্টফোন থাকলে যে কেউ নিজের গাড়ির জন্যেও পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজে পেতে পারেন। একটা এপস ব্যবহার করেই আপনি আশেপাশে ব্যবহারযোগ্য পার্কিং স্পেস সম্পর্কে তথ্য পেয়ে যেতে পারেন।

সিদ্ধান্ত আপনার! 

তার চেয়ে বিস্ময়কর লেগেছে, এই সমস্যার সমাধান নিয়ে স্টার্টআপ আছে খোদ বাংলাদেশেই, যারা পার্কিং সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে খুব সিম্পল কিন্তু কার্যকর এক সমাধান নিয়ে এসেছেন। গুগল থেকে খোঁজ পেলাম অ্যাপসটির। 'ফিউচার স্টার্টআপ' এই অ্যাপ নিয়ে মন্তব্য করেছে, ঢাকা শহরের দৃশ্যপট পালটে দেয়ার ক্ষমতা রাখে 'পার্কিং কই' / 'Parking Koi' নামক এই উদ্যোগ। যানজটের এই শহরে পার্কিং সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে উদ্যোগটি আশীর্বাদ বলা যায়। রাফাত রহমান 'পার্কিং কই' স্টার্টআপের উদ্যোক্তা। রাফাত রহমান সম্পর্কে একটু বলা যাক। তিনি ২০০৭ সালে আমেরিকায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। ডিজনিতে কনফিগারেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবনে পা রাখেন। এখানেই শেষ নয়, এই মানুষটির আছে ইন্টেল, এইচপি জেপিমরগ্যান, ব্যাংক অফ আমেরিকার মতো বিশ্বের প্রথম সারির বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা।

কিভাবে এলো 'পার্কিং কই' অ্যাপটির আইডিয়া? রাফাত রহমান নিউইয়র্কে গিয়ে একবার লক্ষ্য করলেন, এখানে বাঙ্গালি পাড়ায় মানুষ পার্কিং নিয়ে সমস্যায় পড়ছে। তিনি যখন দেশে ফিরলেন নিজেও পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজতে হিমশিম খান। তার উপলব্ধি তৈরি হয়, পার্কিং নিয়ে উন্নত দেশগুলোতে সমস্যা এখনো আছে এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার বাংলাদেশে এই সমস্যা আরো প্রকট। কারণ, এখানে পার্কিং এলোমেলো করার কারণে তার প্রভাব পড়ে যানজটে। তখন তিনি এই প্রজেক্ট নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ 'পার্কিং কই' স্টার্টআপ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। 

রাফাত রহমান, সিইও, পার্কিং কই

'পার্কিং কই' কিভাবে কাজ করে? 

এই অ্যাপসটি মূলত আপনাকে অব্যবহৃত পার্কিং স্পেস খুঁজে দেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। ধরুন, সামনে কোরবানির ঈদ আসছে। আপনি গরুর হাটে যাবেন। কিন্তু গাড়ি রাখবেন কোথায় এই ভেবে হয়রান। অ্যাপস আপনাকে আইডিয়া দিবে সেই জায়গার আশেপাশে কোথায় খালি স্পেস আছে, যেখানে আপনি আপনার গাড়ি নিরাপদে রাখতে পারেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যস্ত শপিংমলের সামনে অনেকসময় আগেই এত গাড়ি পার্ক করে রাখা থাকে যে, আপনি ভেবে পান না গাড়িটা কোথায় রাখবেন। এলেমেলো ভাবে রাখতে গিয়ে জ্যাম বেঁধে যাওয়ার টেনশন থাকে, তার সাথে মামলা খাওয়ারও ভয়। এতো ভয় নিয়ে থাকা মুশকিল। এমনিতেই এই শহরে দুশ্চিন্তা করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। 'পার্কিং কই' সেই দুশ্চিন্তার জায়গাটি দূর করতে সাহায্য করবে। স্বল্প খরচে আপনি অব্যবহৃত পার্কিং স্পেস ব্যবহার করতে পারবেন। 

'পার্কিং কই' অ্যাপের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ

এছাড়া আপনার যদি নিজেরই বাড়ি থাকে, যেখানে আপনার গ্যারেজে পার্কিং স্পেস ফাঁকা পড়ে আছে, চাইলে আপনি 'পার্কিং কই' উদ্যোগের সাথে নিজের স্পেসটাকে যুক্ত করে কিছু ইনকামও করতে পারেন। সেটা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশি হতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো, কিছুদিন আগে পুরান ঢাকার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথাটা। বাড়িওয়ালা স্পেস ভাড়া দিয়েছিলেন ক্যামিকেল রাখার কাজে। সেই ক্যামিকেলে আগুন ছড়িয়ে কি ভয়ানক অবস্থা হলো, কতগুলো প্রাণ ঝরে গেল।

ঢাকায় এধরণের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আন্ডারগ্রাউন্ড বা গ্রাউন্ডফ্লোর ভাড়া দেয়ার চাইতে, পার্কিং প্লেস হিসেবে ভাড়া দিলে কিন্তু দুই দিকেই নিরাপত্তা। অগ্নিকাণ্ডের ভয় নিয়েও থাকতে হয় না৷ আর্থিক ক্ষতি হবে এই চিন্তাও করতে হয় না। একই সাথে যানজটের সমাধানে কন্ট্রিবিউশানও রাখা যায়। সব মিলিয়ে অসাধারণ একটা উদ্যোগ মনে হয়েছে 'পার্কিং কই' স্টার্টআপটাকে। অ্যাপটি গত এক বছরে শহরে অনেকের প্রিয়ও হয়ে উঠেছে, সেটা বোঝা গেল, রাফাত রহমানের দেয়া তথ্যে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ একবার হলেও এই অ্যাপ ব্যবহার করে পার্কিং সুবিধা নিয়েছেন। সংখ্যাটা বাড়ছে ক্রমশ।

যোগ হয়েছে নতুন সার্ভিস- টুলবক্স

‘পার্কিং কই’ পার্কিং খুঁজে দেয়ার পাশাপাশি চালু করেছে নতুন এক সেবা, যার নাম ‘টুলবক্স’। টুলবক্স আপনার গাড়ির সব ধরনের সমাধান দিবে। যেখানেই সমস্যা সেখানেই সমাধান। উদাহরণস্বরূপ, গাড়ির টায়ারের সমস্যা হলে হয়তো আপনি ভাবেন যে, অনেক দূরে যেয়ে লোক নিয়ে আসতে হবে টায়ার রিপেয়ার করতে আর নয়ত নিজেই গাড়িটিকে নিয়ে যেতে হবে। আর এটিই সবচেয়ে বড় টেনশনের বিষয়। পার্কিং কই টুলবক্স সুবিধা দিচ্ছে গাড়ির টায়ার রিপেয়ার করার। শুধু একটি ফোন কল এবং  বাসায় এসে হাজির হবে পার্কিং কই এর মেকানিক এবং প্রয়োজনীয় সকল সেবা তারা দিবে। এই টুলবক্স সেবার মাধ্যমে গাড়িকে বা বাইককে একদম নতুনের মতো ঝকঝকে করেও ফেলা যাবে। টুলবক্স সার্ভিসসমূহের মধ্যে রয়েছে ইঞ্জিন রিপ্লেসমেন্ট, ইঞ্জিন ওভারভিউ, ইঞ্জিন সাস্পেনশন, ইঞ্জিন চেইঞ্জ, গাড়ি ওয়াস, ব্রেক সার্ভিসিং, ব্রেক প্যাড চেইঞ্জ, ডোর লক, ডায়নামা, এসি সার্ভিসিং, গ্যাস, মবিল ফিল্টার, রোড সাইড এ্যাসিসট্যান্ট। 

আমি শাহীন ভাইয়ের ফোনে 'পার্কিং কই' ইন্সটল করে দিলাম। অ্যাপটি ইন্সটল করেছিলাম এই লিংক থেকে। আশা করছি এখন থেকে অন্তত অর্ধেক কাপ চা খেয়ে হুড়মুড় করে দৌড় লাগাতে হবে না র‍্যাকারের ভয়ে। কড়া লিকারে দুধ বাড়িয়ে বানানো চা আয়েশ করে পান করতে পারব!

বিস্তারিত জানতে ঘুরে আসতে পারেন তাদের ওয়েবসাইট থেকে। 


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা