হবু প্রেসিডেন্টের আত্মহত্যা: দ্য কিউরিয়াস কেস অফ পার্ক-উন-সু!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই তিনি সিউলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন, দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন নাগরিকদের মধ্যে। পরবর্তী নির্বাচনে দক্ষিণ কোরিয়ার হবু প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকেই দেখছিলেন অনেকে। সেই লোকটা আচমকা নিজেকে শেষ করে দিলেন যৌন হয়রানির একটা অভিযোগ উঠতেই...
তিনি ছিলেন উদীয়মান এক রাজনীতিবিদ, বড় কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও টানা তিনবার দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন পার্ক-উন-সু নামের এই লোক। ২০২২ সালে তিনি কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হবার জন্য নির্বাচনে দাঁড়াবেন, এমনটা মোটামুটি নির্ধারিতই ছিল। সিউলে তিনি দারুণ জনপ্রিয়, সেই জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা দেশে। সেই লোকটার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলো, তার এক ঘন্টার মধ্যে তিনি নিখোঁজ হলেন, আর কয়েক ঘন্টা বাদে তার লাশ পাওয়া গেল বাড়ি থেকে অনেক দূরের একটা জায়গায়- গোটা ঘটনাটাকে কোরিয়ান কোন থ্রিলার ফিল্মের চিত্রনাট্য বলে ভুল হতে পারে, কিন্ত এটাই বাস্তব, এরকমটাই ঘটেছে চারদিন আগে।
পার্ক উন-সুন ২০১১ সালে সিউলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না তিনি, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় নিমজ্জিত সিউল সিটি কর্পোরেশনকে ঢেলে সাজানোর ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন তিনি ভোটারদের। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগনের একটা বড় অংশ য়াকে পছন্দ করেছিল, আর তাই হেভিওয়েট কোন প্রার্থী না হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনে বাজীমাত করেছিলেন পার্ক।
এরপরে আরও দুইবার মেয়র নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন তিনি, সিউল শহরটা আজকে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে পার্কের অবদান কম নয়। নাগরিকদের সমস্যার খোঁজ তিনি নিয়মিত রেখেছেন, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করেছেন। গত নয় বছর ধরে তার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে, নিজ কর্মগুণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষ।
দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল লিবারেল পার্টির হয়ে দেশটির আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীও ধরা হচ্ছিল তাকে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে যে তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন, সে ব্যাপারে অনেকেই নিঃসন্দেহ ছিলেন। কারণ মেয়র হিসেবে যেসব কাজ পার্ক করেছেন, সেগুলো লোকের মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা মোকাবেলা সহ তার আরও নানা উদ্যোগ দারুণ প্রশংসিত হয়েছে নাগরিকদের মাঝে।

কিন্ত সবকিছু থেমে গেল তার আকস্মিক বিদায়ে। পুলিশ বলছে, আত্মহত্যা করেছেন পার্ক-উন-সু। ঘটনাক্রম শুরু থেকে সাজালেও আত্মহত্যার দিকেই মতামত দেবে বেশিরভাগ মানুষ। কিন্ত খ্যাতির চূড়ায় থাকা পার্কের সঙ্গে কি এমন ঘটেছিল যে, তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন? যে লোকটা দুই বছর পরে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন, তিনি কেন নিজেকে এভাবে শেষ করে দিলেন?
পার্কের আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে যৌন হয়রানির একটা অভিযোগকে। যে অভিযোগটা এনেছেন পার্কেরই এক সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী। পার্কের বিরুদ্ধে 'অযাচিত শারীরিক সম্পর্ক' ও 'অশালীন বার্তা পাঠানো'র অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগে ওই নারী উল্লেখ করেছেন, কাজের সময় তিনি যৌন হয়রানি ও বাজে অঙ্গভঙ্গির শিকার হয়েছেন। অফিসের লাগোয়া বেডরুমে নিয়ে তাকে জোর করে আলিঙ্গন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ এনেছেন সেই ভুক্তভোহী নারী। তিনি আরও বলেছেন, কাজ শেষ হওয়ার পরও তাকে অন্তর্বাসের ছবি ও নোংরা বার্তা পাঠাতেন পার্ক।
এই অভিযোগের ব্যাপারে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হবার ঘন্টাখানেক পর থেকেই নিখোঁজ হয়েছিলেন পার্ক। মেয়র হিসেবে অফিসে তার একটা মিটিংয়ে যোগ দেয়ার কথা ছিল, সেটা ক্যান্সেল করে নিজের গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন তিনি। রেখে গেছেন ছোট্ট একটা চিরকুট। পার্কের মেয়ে সেই চিরকুট পেয়েই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, পুলিশ নেমেছে পার্ককে খুঁজে বের করার মিশনে। কিন্ত কয়েক ঘন্টা পর উত্তর সিউলের শহরতলীর একটি পাহাড়ী এলাকায় পার্ককে যখন খুঁজে পাওয়া গেছে, তখন তার দেহে প্রাণের অস্তিত্ব নেই।

মৃত্যুর আগে যে চিঠিটা পার্ক রেখে গিয়েছিলেন, তার পরিবারের অনুমতি নিয়ে সেটা প্রকাশ করেছে সিউলের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। সেখানে লেখা ছিল- ''আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমার সঙ্গে আমার জীবনে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আমার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইছি, কারণ, আমি শুধু তাদের কষ্টই দিয়েছি। দয়া করে আমার দেহ পুড়িয়ে আমার মা-বাবার কবরে ছড়িয়ে দেবেন, এটা আমার শেষ অনুরোধ।"
পার্কের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এখন গোটা দক্ষিণ কোরিয়া দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদল বিশ্বাস করতে পারছেন না পার্কের মতো মানুষ এরকম কিছু করতে পারে, তারা বলছেন, কেবলমাত্র অভিযোগের ভিতিতেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করাটা অন্যায়, তারা শোক জানাচ্ছেন পার্কের এই অন্তিম পরিণতিতে। আরেকদল বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীদের ওপর চলমান যৌন নিপীড়নের বহিঃপ্রকাশ পার্কের এই ঘটনাটা। সবকিছু প্রকাশ্যে আসার ভয়েই পার্ক আত্মহত্যা করেছেন, এবং সেই মিশনে তিনি সফল। কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার আইন অনুযায়ী, অপরাধীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এসব অভিযোগের তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়, এগুলোর পুনঃতদন্ত আর হয় না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে যৌন হয়রানির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পার্ক আত্মহত্যা করলেন, সেই তিনিই কিন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম যৌন হয়রানি মামলার আইনজীবী ছিলেন! ৬৪ বছর বয়সী জনপ্রিয় এই নেতা মানবাধিকার রক্ষায় লড়েছেন দীর্ঘদিন। লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক আইনে ডিপ্লোমা করেছিলেন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মানবাধিকার প্রোগ্রামের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো ছিলেন পার্ক-উন-সু। তরুণ বয়সে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সামরিক স্বৈরশাসক পার্ক চুং-হি- এর বিরুদ্ধে মিছিল করে গ্রেফতার হয়েছিলেন পার্ক-উন-সু। দক্ষিণ কোরিয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক একাধিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
পার্ক নিজের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জন্ম দিয়ে গেছেন অজস্র প্রশ্নের। যৌন হয়রানির অভিযোগটির ব্যাপারে আর কোন তদন্ত হবে না, যেহেতু পার্ক বেঁচে নেই। তবে অবস্থাদৃষ্টে এটা পরিস্কার, সম্মান হারানোর ভয়েই জীবন থেকে পালিয়েছেন তিনি। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত একটা দেশের প্রেসিডেন্টের গায়ে 'যৌন নিপীড়ক' ট্যাগ লাগানো থাকবে, এমনটার চেয়ে পার্কের আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটাই বোধহয় ভালো, তাই সেই পথেই হেঁটেছেন জনপ্রিয় এই নেতা...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন