কম্পিউটারে 'ক' না জানা মানুষটিই হয়ে গেলেন গুগলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটির প্রধান! পারিসা তাব্রিজের উত্থানের গল্পটি বেশ আকর্ষণীয় ও তীব্র অনুপ্রেরণারও।

এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ঠাকুমার ঝুলিও নেই, রাজা-রাণী, রাজকন্যা-রাজপুত্রদের গল্পও নেই। সবই হয়ে গিয়েছে ডিজিটাল। অনেকটা 'ওপেনটি বায়োস্কোপ' সিনেমার সেই ডায়লগের মতন- সবই আইটি, বুঝলে ভাইটি। তবে এই আইটির যুগে এসেও এমন একজন রাজকন্যা আছেন, যিনি আমাদের প্রত্যেকের সাথে যুক্ত। না, মোটেও চাপা মারছি না। পুরোটা শুনলেই বুঝতে পারবেন। গুগলে পারিসা তাব্রিজ নামের একজন চাকরী করেন, যার অফিশিয়াল নাম- 'সিকিউরিটি প্রিন্সেস' বা 'নিরাপত্তার রাজকুমারী'। অর্থাৎ তাকে যে রাজকুমারী ডাকা হলো, সেটা কিন্তু ভুল না। এবার আসবে দ্বিতীয় বিষয় যে, তিনি কীভাবে প্রতিদিন আমাদের সাথে যুক্ত? কারণ তিনি গুগলের সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের প্রধান! আমরা যে প্রতিদিন ক্রোম ব্রাউজার ব্যবহার করি, সেখানে কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত বহু তথ্যই প্রতিদিনই আমরা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই পার্সোনাল ইনফরমেশনগুলোকে প্রতিদিনই ঠিকঠাকভাবে আগলে রেখে যাচ্ছেন গুগলের এই সিকিউরিটি প্রিন্সেস; পারিসা তাব্রিজ।

পারিসা তাব্রিজের কাজটাও মজার। তিনি প্রতিদিন নিয়ম করে গুগলের প্রত্যেক অফিসারের আইডি হ্যাক করার চেষ্টা করেন। গুগলের গুরুত্বপূর্ণ সাইটগুলোকেও তিনি হ্যাক করার চেষ্টা করেন। এরপর যদি হ্যাক হয়ে যায় সাইট, সেই সাইটটির প্রটেকশন তিনি আবার নিজ হাতেই ঠিক করে দেন। তাছাড়া তিনি কিছু প্রফেশনাল হ্যাকারও পালেন। যাদের কাজও ঠিক একই। পারিসার মতই। প্রত্যেকদিনই তারা গুগলের গুরুত্বপূর্ণ সাইটগুলোকে হ্যাক করার চেষ্টা করেন।

পারিসার ডিপার্টমেন্টের কথা একটাই। চিন্তা করতে হবে ক্রিমিনালের মতন। একজন ক্রিমিনাল যেভাবে হ্যাক করার চিন্তা করতে পারে, তাব্রিজ ও তাঁর টীমও চেষ্টা করেন সেভাবেই গুগলকে হ্যাক করার জন্যে। এছাড়াও গুগল ক্রোমের দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তারা, গুগলের এ্যাপ ও সাইটগুলোর কোনো দুর্বলতা আছে কী না, সেগুলো খুঁজে বের করেন তারা। যাতে করে বাইরের কেউ গুগলকে আক্রমণ করার আগেই ঘরের মানুষজনই বিষয়টা জানতে পারে। এরপর নিরাপত্তা বলয়ে ঢেকে দেন গুগলের সাইটগুলোকেই।

গুগলের কাজের পরিবেশ এমনিতেও কিন্তু খুবই খোলামেলা। হয়তো কাজের প্রেশার বেড়ে গিয়েছে। একটু দৌড়ে আসতে চাইছেন, পারবেন। একটু ঘুমাতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাও পারবেন। কারও একটু নাচতে ইচ্ছে করছে, তার জন্যেও আছে ব্যবস্থা। পারিসা তাব্রিজের টীমও সেভাবেই নেচেকুদে, রিল্যাক্সে থেকেই এই ভারী ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকেন।

ইরানী চিকিৎসক বাবা ও পোলিশ-আমেরিকান নার্স মায়ের প্রথম সন্তান পারিসা বড় হয়েছেন শিকাগোতে। বাবা-মা দুইজনেই চিকিৎসার সাথে যুক্ত। চিকিৎসাক্ষেত্রে তারা খুবই দক্ষ ও চৌকষ মানুষ। কিন্তু  আইটি, ইন্টারনেট, কম্পিউটারের বিষয়ে তাদের জ্ঞান, আগ্রহ, ইচ্ছে বরাবরই ছিলো শূন্যের কোঠায়। ফলে পরিবারেও প্রযুক্তির ওরকম আনাগোনা তৈরী হয়নি। পারিসাও ছোটবেলায় কম্পিউটারের ধারেও ঘেঁষেনি ওভাবে। ছোট দুই ভাই এর সাথে দস্যিপনা আর মারামারি-হাতাহাতিতেই কেটেছে শৈশব। তবে পারিসা ঐ বয়স থেকেই মাথা খাটিয়ে ছোট ভাইদের দমন করতো। হাতাহাতিতে যখনই জুত করতে পারতো না, তখনই৷ ছোটবেলা থেকেই মস্তিষ্ক বেশ ভালোই প্রখর তাঁর।

প্রযুক্তি-বিমুখ হয়ে স্কুলের গন্ডি পার করে ফেলেন পারিসা। ঝামেলা হলো যখন পারিসা ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে বেছে নিলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং। কম্পিউটারের তো 'ক'ও জানতেন না। তবে ধীরে ধীরে ঠেকায় পড়ে আস্তে আস্তে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, কোডিং সবকিছু শিখতে হয় তাকে। ডিজিটাল জগতে হাতেখড়ি হয় তাঁর। অনুপ্রেরণা ছিলো জন ড্র‍্যাপার। তার মত করেই এগোতে শুরু করলেন পারিসা।  এরপরেই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গুগল থেকে ডাক পেয়ে গেলেন একসময়ে এসে। যদিও গুগলে চাকরী হয়েছে এটা শুনে পারিসার ভাইয়েরা নাক সিঁটকে মন্তব্য করেছিলো-

তুমি মেয়ে বলেই তোমাকে নিচ্ছে। কাজবাজ কিছুই করাবেনা। শোপিস হিসেবে রেখে দেবে।

 

পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে এ মন্তব্য একেবারে ফেলে দেয়ার মতনও না। পারিসা ভাইদের মন্তব্যে কিছুই বললেন না। মুচকি হাসলেন। এরপর গুগলে যোগ দিলেন। ২০০৭ সালে যোগ দেয়ার পরে এখন পর্যন্ত  তিনি নিজের ভাইদের কথাকেই মিথ্যে প্রমাণ করে যাচ্ছেন প্রতিদিন। ছড়ি ঘোরাচ্ছেন পৃথিবীর বড় বড় সব হ্যাকারের ওপর।

গুগলে তাঁর প্রভাবের কারণে তিনি ২০১২ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের ৩০ বছরের কম বয়সী শীর্ষ ক্ষমতাধারী ৩০ নারীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি লিড দিচ্ছেন যেসব হ্যাকারদের, তাদের পোশাকি নাম 'হোয়াইট হ্যাট'। এই হোয়াইট হ্যাটদের প্রধান কাজ ‘ব্যাড গাই’ হিসেবে পরিচিত ব্ল্যাক হ্যাটদের প্রতিরোধ করা। এ প্রসঙ্গে ব্ল্যাক হ্যাটদের কথাও একটু জানিয়ে রাখা দরকার। এরা অনেকটা শস্যক্ষেতের পঙ্গপালের মতন। যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন মানুষের ওয়েবসাইট হ্যাক করেন, টাকাপয়সা চুরি করেন। গুগলকেও এ্যাটাক করতে আসেন তারা। সেখানেই হোয়াইট হ্যাটদের কাজ। তারা খুব যত্নের সাথে ব্ল্যাক হ্যাটদের দমন করেন।

গুগলের খুব সুন্দর একটা পলিসি হচ্ছে। অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে নয়। তাই যারাই গুগলের বিভিন্ন সাইট হ্যাক করতে আসেন, তাদের জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থাও রেখেছেন পারিসা। তিনি ঘোষণাই দিয়ে রেখেছেন, যদি কেউ ক্রোমের কোনো সমস্যা ধরিয়ে দিতে পারে বা ক্রোমকে হ্যাক করতে পারে, তাহলে তাকে নগদ ত্রিশ হাজার ডলার পুরস্কার দেয়া হবে। এই পর্যন্ত গুগলের কোষাগার থেকে ১.২৫ মিলিয়ন ডলার খরচও হয়ে গিয়েছে এই সিদ্ধান্তের পর। এবং পারিসা এইসব সফল হ্যাকারদের 'ব্ল্যাক হ্যাট' থেকে 'হোয়াইট হ্যাট'এ রূপান্তরিত করে যাচ্ছেন প্রতিদিনই।

এভাবেই পারিসা তাব্রিজ অনলাইন সুরক্ষার জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিত। 'নারীরা প্রযুক্তি বোঝেনা' এই যুক্তির স্বপক্ষশক্তি যারা, তাদের গালে বেশ বড়সড় চপেটাঘাতও করে যাচ্ছেন তিনি, কাজের মাধ্যমেই। যিনি পোশাকি পদবিতে বিশ্বাসী না। যিনি বিশ্বাস করেন-

নামে কী আসে যায়? আমার কাজটাই তো আমাকে করতে হবে। আমি সেটাই করবো। ভারী ভারী পদবী নিয়ে বসে থেকেই বা কী হবে?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা