প্যারা কমান্ডো বিগ্রেড: দ্য লিগ্যাসি অব গেরিলা অ্যান্ড ক্রাক প্ল্যাটুন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষ বাহিনীর নাম 'প্যারা কমান্ডো বিগ্রেড।' কিন্তু এই বাহিনীর ট্রেনিংকে ধরা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ট্রেনিং হিসেবে। কী সেই ট্রেনিং, কীভাবে কাজ করে প্যারা কমান্ডো বিগ্রেড, তা অনেকেই জানেন না...
'হলি আর্টিজান' এ ২০১৬ সালের পহেলা জুলাইয়ের সেই নৃশংস ঘটনার কথা মনে আছে? জানি, ভোলেননি কেউই। ভোলা সম্ভবও নয়। বাংলাদেশে এরকম বীভৎস হামলা হয়েছেই হাতে গোনা কয়েকটা। এবং বর্বরতার সবগুলো ধাপই সেদিন দেখেছি আমরা। মানুষকে জিম্মি করা, জবাই করা, পুলিশকে মেরে ফেলা... জঙ্গীদের রাতভর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পরদিন সকালে আমরা দেখতে পাই মিশনে এসেছে বাংলাদেশের 'প্যারা-কমান্ডো বিগ্রেড'। যারা সাধারণত ছোটখাটো কোনো অপারেশনে আসেনা। একটু বিস্মিতই হই আমরা। কারন, এ বাহিনীকে আমরা খুব কমই দেখেছি প্রকাশ্যে।
তারা এসে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-সেনাবাহিনী সবাইকে নিয়ে একটা স্পেশাল অপারেশন পরিচালনা করে, যার নাম; অপারেশন থান্ডারবোল্ট! ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত জঙ্গীদের দমন করে মাত্র বারো-তেরো মিনিটের মধ্যেই হলি আর্টিজানের দখল নিয়ে নিতে সক্ষম হয় তারা। অনেকেই হয়তো সেদিনই প্রথমবার 'প্যারা-কমান্ডো ব্রিগেড' এর নাম শুনেছেন বা তাদের মিশন সরাসরি দেখেছেন। অথবা যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে ধারণা রাখেন তারা হয়তো আগেও সেনাবাহিনীর সবচেয়ে স্পেশাল ও সবচেয়ে চৌকষ এ বাহিনীর নাম ও কাজকর্মের বিষয়ে শুনে থাকবেন। আজকের কথাবার্তা এই প্যারা-কমান্ডো ব্রিগেড'কে নিয়ে, যারা একটু অন্তরালে থেকেই দেশকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন।

পৃথিবীর যেকোনো দেশের নিরাপত্তা ও সামরিক উৎকর্ষতার জন্যে কিছু 'স্পেশাল ফোর্স' থাকে, যেকোনো সংকটে যারা তুরুপের তাসের মত বের হন, ভেলকি দেখান। এরা হচ্ছেন রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগারের সবচেয়ে দামী ও সযত্নলালিত হাতিয়ার। আমেরিকার জন্যে যেমন আছে- 'নেভী সীল' 'আর্মি গ্রিন বেরেটস', ইসরায়েলের 'সায়েরেট মাটকাল' ভারতের 'প্যারা স্পেশাল ফোর্স', বাংলাদেশের তেমনি 'প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড'।
এখন প্রশ্ন আসবে, এই প্যারা কমান্ডো ব্রিগেডের কাজ কী? সেটার উত্তর দিচ্ছি। তার আগে এটা জানা দরকার, এই স্পেশাল বাহিনীর সদস্যদের কীভাবে নেয়া হয়। সেনাবাহিনীর আর্মস এবং সার্ভিস এর সদস্যদের মধ্য থেকে যারা এই বিগ্রেডে কাজ করতে চান, তারা স্বেচ্ছায় নাম নিবন্ধন করেন এখানে। নাম নিবন্ধন করার পরে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কঠিন ও ঝুকিপূর্ণ প্রশিক্ষণ এটি। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ট্রেনিং দেয়ার তালিকায় প্রথম দিকে নাম থাকে- ইউএস নেভী সীল এর। অনেকটা সেই স্টাইলেই বাংলাদেশের 'প্যারা কমান্ডো বিগ্রেড' এর ট্রেনিং হয়। শারিরীক ও মানসিক যত রকম নির্যাতন করা সম্ভব, সব করা হয় এখানে। সহ্য,ধৈর্য, দৃঢ়তার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আকাশ, পাহাড়, সমুদ্র, সমতল...ট্রেনিং এর জন্যে বাদ দেয়া হয়না কোনো জায়গাকেই।
এছাড়াও অখাদ্য, কুখাদ্য খাওয়ানো, ঘুমাতে না দেওয়া, তীব্র অপমান করা সহ বিভিন্নভাবে হিট করা হয় সৈন্যদের। এই ট্রেনিং সেশন অনেকের জন্যেই সহ্য করা বেশ কষ্টের। তাই দেখা যায়, প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু মানুষ কমতে থাকে। একবারে শেষ পর্যায়ে গিয়ে যে কয়জনকে পাওয়া যায়, তাদেরকে আবার আরো এক মাস প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে যারা উতরে যান, তারাই 'প্যারা কমান্ডো বিগ্রেড' এর সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পান। স্পেশাল ট্যাকটিকস, স্ট্রাটেজি, গেমপ্ল্যান সব নিয়েই আলোচনা হয় সেশনগুলোতে। যুদ্ধের যতরকম প্রচলিত ও অপ্রচলিত পদ্ধতি আছে, সব হাতেকলমে শেখানো হয়। এবং সব ধাপ পেরোনোর পরে অনেকসময় দেখা যায়, মাত্র চার পাঁচজন বের হয়েছে এক ব্যাচ থেকে। যে কয়জন সব ধাপ উতরে বের হয়েছেন, শুধুমাত্র তাদেরই নেয়া হয়। কোনো ছাড়ের সুযোগ নেই এখানে। দেশের প্রতিরক্ষার বিষয় বলে কথা। কোনো ফাঁক রাখা হয়না বাছাইয়ে তাই।
এবার আসি প্যারাকমান্ডো ব্রিগেডের কাজ কী। এটা নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমে একটু পেছনে যেতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের 'গেরিলাবাহিনী'র কথা মনে আছে? যারা প্রচলিত কায়দায় যুদ্ধ করতেন না, হুট করে অতর্কিতে এসে শত্রুকে নিকেশ করে দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যেতেন। তাছাড়া রুমী, বদি, আজাদদের কথা মনে আছে? ক্রাক প্ল্যাটুনের কর্মকান্ডের কথা মনে আছে? বাংলাদেশের 'প্যারা কমান্ডো বিগ্রেড' এর সাথে গেরিলাযোদ্ধা, ক্রাক প্ল্যাটুনের সদস্যদের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। কীভাবে? সেটাই দেখা যাক এখন বরং।
যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশকে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো তা আমরা জানি। দুই নম্বর সেক্টরটা গঠিত হয়েছিলো ঢাকার কাছেই, মেলাঘর নামে একটি জায়গায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিংক্যাম্পে আসেন ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক ছেলেমেয়ে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' থেকে জানতে পারি, সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছিলেন তাঁর বড় ছেলে শাফী ইমাম রুমীও। দুই নম্বরের সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এই সেক্টরে প্রশিক্ষণ নিতে আসা ছেলেমেয়েকে নিয়ে যান দুই নম্বর সেক্টরের অপারেশনাল অফিসার মেজর এটিএম হায়দারের সামনে। মেজর হায়দার সে সময়ের জাঁদরেল অফিসার। পাকিস্তান আর্মির স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি)- এর প্রশিক্ষিত প্যারাকমান্ডো ছিলেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হলে কুমিল্লার কমান্ডো ব্যাটালিয়ন থেকে পালিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন যুদ্ধে।
যাই হোক, দুই নম্বর সেক্টরের এই অপারেশনাল অফিসার, ঢাকা থেকে আসা এসব ছেলেমেয়েকে কঠোর প্রশিক্ষণ দেন। গেরিলা প্রশিক্ষণ, এ্যাম্বুশ ট্যাকটিক্স, হিট এ্যান্ড রান, বুবিট্রাপ সহ অনেকগুলো টেকনিক ও স্ট্রাটেজি, ওয়্যার ব্লুম্যাপ শিখিয়ে দেন তাদের। ৫৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম বিশেষ বাহিনী।
এদের কাজ ছিলো খুবই অন্যরকম। মুক্তিযোদ্ধারা যৌথবাহিনীর সাথে মিলে নিয়মিত আক্রমণ তো করছিলোই। গেরিলা বাহিনী আর ক্রাক প্ল্যাটুন মিলে হুটহাট করে শত্রুদলকে অতর্কিতে হামলা করছিলো। এতে করে যেটা হলো, চারপাশ থেকে বহুমুখী আক্রমণে নাকাল হয়ে পাকিস্তানিরা অবশেষে রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধ শেষের পর ১৯৭৬ সালের দিকে বাংলাদেশে প্রথম বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়। প্রাক্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত কমান্ডোদের আনা হয় এই বিশেষ বাহিনীর জন্যে। গঠন করা হয় 'কমান্ডো - স্পেশাল ওয়ারফেয়ার স্কুল'। প্রথম দিকে এই প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সেনানিবাসে কার্যক্রম চালালেও শেষমেশ সিলেট সেনানিবাসে এসে স্থায়ী রূপ লাভ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্যতম সেরা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান- স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাক্টিক্স', সংক্ষেপে 'এস আই অ্যান্ড টি'। এই 'এস এ্যান্ড টি' স্কুল আর 'কমান্ডো- স্পেশাল ওয়ারফেয়ার স্কুল' মিলে ১৯৮১ সালের দিকে 'স্পেশাল ওয়ারফেয়ার উইং' গঠিত হয়। প্রথমদিকে যে ছয় মাস প্রশিক্ষণের কথা বললাম, সে প্রশিক্ষণ এখান থেকেই দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালের দিকে এই উইং থেকে প্রথম ব্যাচ কমান্ডোরা বের হন। যাদের নাম '১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন'। সম্প্রতি ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে 'জাতীয় পতাকা' প্রদান করা হয়েছে, যা কোনো একটি ব্যাটালিয়নের জন্য সর্বোচ্চ সার্ভিসের স্বীকৃতি। প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ২০১৬ সালে সেনা সদরের তত্ত্বাবধানে স্বতন্ত্র একটি বিশেষ অপারেশন ব্রিগেডে রূপ নিয়েছে, যেটি 'প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড' নামে পরিচিত। এর সদর দপ্তরও সিলেটে।

দেশের পাশাপাশি বিদেশেও এদের কর্মকাণ্ড নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে। সবচেয়ে ইতিবাচক বিষয়, এই 'প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড' এখনো কোনো মিশনে ব্যর্থ হয়নি। যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই তারা সাফল্য অর্জন করেছে। এদের প্রশিক্ষণটাই এমন যে, এখানে তাদের ভুল করার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। এবং সেটারই সাক্ষ্য রেখে চলেছে তারা। এখন পর্যন্ত যে ক'টি মিশনে তারা অংশগ্রহণ করেছে, সেগুলোর মধ্যে অপারেশন থান্ডারবোল্ট, অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অপারেশন, অপারেশন চিটাগাং এয়ারপোর্ট বেশ উল্লেখযোগ্য।
সাধারণত যখন যুদ্ধ শুরু হয়; সাধারণ বাহিনী সরাসরি যুদ্ধ করেন শত্রুপক্ষের সাথে। এদিকে 'প্যারা কমান্ডো ব্রিগ্রেড' যেটা করে, তারা অতর্কিতে শত্রুদের পেছন থেকে হামলা করে। সামনে থেকে 'সাধারণ বাহিনী' ও পেছন থেকে 'প্যারা কমান্ডো বিগ্রেড' এভাবেই দুইদিক থেকে আক্রমণ করে শত্রুদের দমন করা সম্ভব হয় সেনাবাহিনীর পক্ষে। এবং এই কাজটি খুবই ঝুকিপূর্ণ। শত্রুসীমানার বাউন্ডারির মধ্যে গিয়ে এই এ্যাটাক করা হয় যেহেতু, তাই জীবন-মৃত্যুর মার্জিন এখানে খুবই সামান্য। জীবন কে প্রত্যেকদিন একবার শত্রুদলের সীমানায় রেখে এসে দেশের জন্যে- দেশের মানুষের জন্যে যুদ্ধ করছেন যারা, তাদের কথা আমাদের জানা উচিত। পর্দার অন্তরালে থাকা এই মানুষগুলির প্রত্যেকদিনের অবদানের জন্যেই এ সীমান্ত, কাঁটাতার আজও সুরক্ষিত ও নিরাপদ। তাই আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জায়গাটিও রয়ে গিয়েছে এই মানুষগুলোর প্রতি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই বিশেষ 'প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড' এর জন্যে রইলো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন