এখনকার কোভিড ১৯ প্যানডেমিক এর ঠিক আগের প্যানডেমিক টা ছিলো স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১৮ সালে এর শুরু।

আজকে আমরা লোকজনের নানারকম কাজকর্মে সচেতন লোকজন খুব বিরক্ত হচ্ছি। এই রকম কাজকর্ম তখনো ছিলো, আমার ধারণা সামনে যে প্যানডেমিকে পৃথিবী আবারও আক্রান্ত হবে তখনও মানুষের আচরন একই রকম থাকবে।

১৯১৮ তেই হাঁচি-কাশি জনসমাগমে দেয়া যাবে না, যেখানে সেখানে থুথু ফেলা যাবে না, মাস্ক পরতে হবে, এরকম নিয়মকানুন আমেরিকার কয়েকটি প্রদেশে আইন করে চালু করা হয়েছিলো। খুব মজার বিষয় হচ্ছে, লোকজন সেইসব নিয়মকানুন খুব একটা গায়ে প্রথমে লাগায়নি। এর মাঝে একজন মাস্ক পরেনি বলে হাতে-পায়ে গুলি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। যে জায়গায় এই ঘটনা, সে জায়গার নাম সান ফ্রান্সিসকো। গুলি করা হয়েছিলো মোট তিনজন কে, গুলি করেছিলেন হেলথ অফিসার (এখন এরকম কিছু হলে কী হতো ভাবছি।)। 

এখন যেমন আমাদের নিজেদের জন্য এবং আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ঠিকঠাক মাস্ক পাওয়া যাচ্ছেনা, তখনও দেখা গেলো মাস্ক পাওয়া যাচ্ছেনা। আদালত থেকে নির্দেশ এলো, যেভাবেই হোক নাক ঢেকে রাখতে হবেই। সে রুমাল দিয়ে হলেও সই। তখন কিছু বিচিত্র চিত্র দেখা গেলো। যারা ধূমপান করেন, তারা মাস্কের মাঝে একটা ছিদ্র করে রেখে দিয়েছেন। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষ শুধু নাক ঢাকে এরকম একটা জিনিষ নাকে চাপিয়ে বাইরে বের হওয়া শুরু করলেন। ঠিকমতো মাস্ক লোকজন পরছে কিনা সেটা দেখা এবং না পরলে বিচার করার জন্যে আমেরিকাতেই ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা কোর্ট’ বসানো হলো। তাতে একদিনে গ্রেফতার করে হাজির করা আসামীর সর্বোচ্চ সংখ্যা হচ্ছে ২৮ জন। 

এরা নানা রকম চিকন বুদ্ধির কথা দিয়ে বিচারক প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন। কেউ কেউ বলতো, মাস্ক ধুতে দিয়েছি, তাই পরিনি। কোর্টের উত্তর হচ্ছে, যেদিন মাস্ক ধুতে দেয়া হবে সেদিন বাইরে বের হওয়া বন্ধ। আবার কেউ কেউ বলতো, মুক্ত বাতাসের জন্যে তাদের পেট পোড়ে। বিচারক তাদের বাড়িতে পাখার বাতাস খেতে বলে দিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার গোলাপী রঙের মাফলার কে মাস্ক বানিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করলেন। বিচারক এদেরকে ১০ ডলার জরিমানা করে দিলেন। 

এই জিনিসে কি আদৌ কোন উপকার পাওয়া যেত?

এর মধ্যে হঠাত জানা গেলো কর্পূর শুঁকলে ফ্লু হয়না। বাজারে কর্পূরের দাম গেলো বেড়ে এবং লোকজন কর্পূরের একটা পোটলা বানিয়ে ঘাড়ে বেঁধে মাস্কের সাথে নিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করলো। আবার জানা গেলো যে ‘বুটলেগ হুইস্কি’ খেলে ফ্লু হচ্ছেনা। শুধু জানা না, সামরিক হাসপাতালে সৈনিকদের জন্যে চিকিৎসকেরা প্রেসক্রিপশন করে দিচ্ছেন। আমেরিকার যেসব প্রদেশে হার্ডড্রিঙ্ক বা লিকার নিষিদ্ধ, সেসব প্রদেশেও দেখা গেলো হঠাত করেই এসবের চাহিদা বেড়ে গেছে, পাওয়া যেতো গোপনে এবং দাম খুবই বেশি। লোকজন বোতল পাচার করার জন্যে বিশেষ কোট বানিয়ে নিলো। 

দুম করে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন প্যাড বানানোর হিড়িক পরে গেলো। পিটসবার্গে চারজন চিকিৎসক এবং ড্রাগিষ্ট গ্রেফতার করা হলো। ইনারা রোগী দেখা ছাড়াই হুইস্কি খাওয়ার প্রেসক্রিপশন দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। প্রেসক্রিপশন প্রতি এক ডলার। এক ডলার দাও, লিকার খাবার অনুমতি পত্র নিয়ে যাও, তারপর কতটুকু খাবে সে বাওয়া তোমার ব্যাপার! (কি? এখন কি খালি বাংলাদেশের চিকিৎসক দেরই কমিশন খোর মনে হচ্ছে?) ধরে লাইসেন্স বাতিল সহ, পেঁদিয়ে পোঁদের বিষ ঝেড়ে দেয়া হয়েছিলো।

এর মাঝে আবার জানা গেলো 'সিরকা' র বাষ্প নিলে ফ্লুতে ধরেনা (এবারে যেমন শোনা গেছে ইথাইল অ্যালকোহল এর বাষ্প নিলে কোভিড ১৯ ভাইরাস ধরেনা, ওনেকটা ওরকম। সিরকার বাষ্পে মানুষ মরেনি, ইথাইল অ্যালকোহলে মরেছে প্রায় ৬০০ জন, ইরানের ঘটনা।) ওসময় আমেরিকার বিশেষ লোকজন সিরকা বাষ্প নেয়া শুরু করলেন। সেজন্যে আবার বিশেষ নজেল ও বানিয়ে নেয়া হলো, জিনিষটা দেখতে অনেকটা সায়েন্সফিকশন টাইপের জিনিষ মনে হয়।

এই প্যানডেমিকে দেখা গেলো আমেরিকার লোকজন অলৌকিক ব্যাপার স্যাপারে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। প্রিয় মানুষের আত্মা ডেকে নামানো ও তার সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে, ওইজা বোর্ড এর বিক্রি হুহু করে বেড়ে গিয়েছিলো। এসবে জড়িত খুব বিখ্যাত মানুষটির নাম জর্জ অরওয়েল এবং হুডিনি।

প্রতিটা প্যানডেমিক আসলে আমাদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে যায়, আমরা আসলে দিনশেষে একটা প্রাণী। অন্য সব বাকোয়াস।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা