দুর্নীতির ভিত্তিহীন অভিযোগ, প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া, শত-সহস্র সমালোচনাকে জয় করে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। এই সেতুটা আমাদের কাছে একটা সেতু কেবল, কিন্ত শেখ হাসিনার কাছে পদ্মা সেতু ছিল নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের, নিজের দেশকে প্রমাণের চ্যালেঞ্জ...

পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যানটা বসানো হয়েছে আজ। পদ্মার দুই পাড় এখন এক সুতোয় গাঁথা, সেতুর কাজ শেষ হলেই শুরু হবে গাড়ি চলাচল। অপেক্ষার অবসান হবে দক্ষিণাঞ্চলের ২৯টি জেলার মানুষের। ফেসবুকের নিউজফিডজুড়ে সেতুর একচল্লিশতম স্প্যানের ছবি, কেউবা গোটা সেতুর কাঠামোটাকেই ধরার চেষ্টা করেছেন ক্যামেরায়। কুয়াশার কারনে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর পুরোটা নজরে আসে না, তবু ছবিগুলো দেখে অদ্ভুত ভালো লাগায় আক্রান্ত হয় মন, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অজান্তে। হাজারটা সমালোচনা, ষড়যন্ত্র, দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা আর আকাশছোঁয়া চ্যালেঞ্জকে জয় করে পদ্মা সেতু বানিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ; একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচিয়ে বলা 'আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না' কথাটাই যেন মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার।

নতুন ছবিগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে পুরনো একটা ছবি খুঁজে বের করি, পদ্মা সেতু তখন সবে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন সেতু পরিদর্শনে। হেলিকপ্টারে চড়ে সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতি দেখছিলেন তিনি। কিশোরী মেয়েদের মতো উচ্ছ্বাস নিয়ে নিজের মোবাইলে সেতুর ছবি তুলছিলেন, নিজের আনন্দ চেপে রাখতে পারছিলেন না মোটেও- সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। পদ্মা সেতু আমাদের কাছে একটা ব্রীজ, যোগাযোগের একটা মাধ্যম। শেখ হাসিনার কাছে পদ্মা সেতু ছিল বিশাল একটা চ্যালেঞ্জের নাম। নিজেদের প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ, দুঃসাহসকে কাজে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ, দলের গায়ে, দেশের গায়ে ছুঁড়ে দেয়া দুর্নীতির অভিযোগকে ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ। প্রতিটা চ্যালেঞ্জে তিনি বিজয়ী হয়েছেন, লিখেছেন অসম্ভবকে জয় করার গল্প।

নিজের মোবাইলে পদ্মা সেতুর ছবি তুলছেন শেখ হাসিনা

পদ্মা সেতুর উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লিগ সরকারই, সেই ২০০১ সালে। ক্ষমতার পালাবদলে সরকার পরিবর্তন হলো, থমকে গেল সেতুর কাজ। ২০০৮ এর নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা যখন আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন তার 'টু ডু লিস্ট'- এ টপ প্রায়োরিটি পেল পদ্মা সেতু নির্মাণ করাটাই। আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইসিওএম এর সাহায্য নিয়ে তৈরি করা হলো সেতুর ডিজাইন। দেশের মানুষ জানলো, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুটা হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম সেতু। সেইসঙ্গে এদেশের নির্মাণ ইতিহাসের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজও। কিন্ত অন্যরকমের আরও শত শত চ্যালেঞ্জ যে যুক্ত হয়ে যাবে এই প্রজেক্টের সঙ্গে, সেটা ভাবনায় ছিল না কারো, ভাবেননি শেখ হাসিনাও।

বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি ছিল, এই সেতু নির্মাণে তারা ঋণ দিয়ে সহায়তা করবে। সেই ঋণ সুদে-আসলে ধীরে ধীরে শোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। ২০১২ সালে আচমকাই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুললো। তাদের একজন ইন্টেগ্রিটি অফিসার যিনি জাতীয়তায় ব্রিটিশ, তিনি বাংলাদেশে এসে এখানে সেখানে বলে বেড়ালেন, পদ্মাসেতুতে দুর্নীতি হয়েছে। বাংলাদেশে এমন একজন দুর্নীতিবাজ আছেন যা পা থেকে মাথা পর্যন্ত দুর্নীতি রয়েছে; তিনি হলেন শেখ হাসিনা!

গোটা বাংলাদেশ তখন মোটামুটি হতভম্ভ! একসময় টানা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হবার রেকর্ড গড়েছিলাম আমরা। দুর্নীতি সবসময়ই এদেশে ছিল, কখনও কম, কখনও বেশি। কিন্ত বিশ্বব্যাংকের মতো বড় প্রতিষ্ঠান এভাবে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ তোলেনি কখনও। মন্ত্রীপরিষদ সচিব ড. মশিউর রহমান ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে চিঠি পাঠালেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলো, কোথায় দুর্নীতি হয়েছে সেটা দেখানোর জন্য। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু কাগজ পাঠানো হলো। ২০০১-০৬ সালের ডকুমেন্ট আছে সেখানে। শেখ হাসিনা সেটা দেখে বললেন, 'এরা আমার মন্ত্রী না। পদ্মাসেতুর কোথায় দুর্নীতি হয়েছে আপনারা সেটা দেখান।' বিশ্ব ব্যাংক সেটা দেখাতে পারলো না।

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ পর্যবেক্ষণে শেখ হাসিনা

বিরক্ত এবং বিব্রত শেখ হাসিনা দুজন মানুষকে ডাকলেন। একজন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণে যার অবদান আছে। আরেকজন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্ণর আতিয়ার রহমান। প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে জানতে চাইলেন, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব কিনা? ইতিবাচক উত্তর পেয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে এই সেতু নির্মিত হবে বাংলাদেশের মানুষের টাকা দিয়েই। ২০১৩ সালের ৪ঠা মে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে বাংলাদেশ!

কম হাসিঠাট্টা হয়নি সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের প্রায় সকল বড় স্থাপনা নির্মিত হয়েছে বিদেশী অর্থায়নে, বা দাতা সংস্থাগুলোর সাহায্যে। বিশ্বব্যাংক বা জাইকা সাহায্য করেছে, চীন ঋণ দিয়েছে। সেখানে কিনা পদ্মা সেতুর মতো একটা মেগা প্রোজেক্ট বাংলাদেশ বানাবে নিজেদের টাকায়? মালয়েশিয়ার সরকার এগিয়ে এলো সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে। শেখ হাসিনা বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন সেই প্রস্তাব। একবার তিনি বলেছেন, এই সেতু বাংলাদেশ নির্মাণ করবে, সেটাই ফাইনাল। এটা জেদ নয়, এটার নাম আত্মবিশ্বাস।

বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুর সবশেষ স্প্যানটিও

পদ্মা সেতুর প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ যখন উঠেছিল, তখন যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন আবুল হাসান। যেহেতু তার মন্ত্রণালয়ের অধীনেই চলছিল পদ্মা সেতুর সব কার্যক্রম, তাই অভিযোগের তীরটাও ছিল তার দিকেই। মন্ত্রী হিসেবে তিনি সফল ছিলেন না, তার আমলে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা হয়েছিল, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ছিল নিয়মিত ঘটনা। কিন্ত এটাও সত্য, ভিত্তিহীন একটা দুর্নীতির অভিযোগ কাঁধে নিয়ে শুধুমাত্র সমালোচনার জেরে তাকে পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল, যে অপরাধ তিনি করেননি, সেটাই মাথা পেতে নিতে হয়েছিল, তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটাও শেষ হয়ে গেছে একরকম। অথচ যে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে এভাবে হেনস্থা করা হলো, সেটার প্রমাণ বিশ্বব্যাংক আজও দিতে পারেনি। দুর্নীতি হয়ে থাকলে তো পারবে! কানাডার আদালতও রায় দিয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন- এই মর্মে।

পদ্মা সেতুর হিসেবটা তাই কেবল দক্ষিণাঞ্চলের ২৯টা জেলার নয়, ঢাকার সঙ্গে দূরত্ব কমে যাওয়ার নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধিরও নয়। পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয় আছে বাংলাদেশের সম্মানের প্রশ্ন, ভিত্তিহীন অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে নিজেদের সামর্থ্য দেখিয়ে দেয়াটাও পদ্মা সেতুর স্বার্থকতা। পদ্মা সেতুর গল্পটা শুধু ত্রিশ হাজার কোটি টাকা বা একচল্লিশটা স্প্যানের নয়। পদ্মা সেতু মানে শেখ হাসিনা নামের এক লৌহমানবীর মায়াবী হাসি আর অদম্য সাহসের আখ্যান, পদ্মা সেতু মানে 'আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না' বাক্যের জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা