শিশুরা নাকী অনুকরণপ্রিয়, কিন্ত এমন জঘণ্য ঘটনার অনুকরণ করতে দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠতে বাধ্য যে কেউই!
শিশুরা নাকী নিষ্পাপ হয়, কোমল হয়। সারাজীবন শুনে আসা কথাটা এখন অবিশ্বাস্য ঠেকছে। পাবনার ঈশ্বরদীতে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনাটার ইতিবৃত্ত জানার পর থেকেই কেমন যেন অসুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে! দশ-এগারো বছর বয়সের তিন শিশু তাদেরই এক সহপাঠীর ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে, তাকে খুন করার জন্যে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে অচেতন দেহটা ফেলে রেখেছে বিরান ভূমিতে, আখ ক্ষেতের ভেতরে। আর পুরো ব্যাপারটাই তারা ঘটিয়েছে ভারতীয় টেলিভিশন শো ক্রাইম পেট্রোল দেখে! শিশুরা নাকী অনুকরণপ্রিয়, কিন্ত এমন জঘণ্য ঘটনার অনুকরণ করতে দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠতে বাধ্য যে কেউই!
ঘটনার মূল কূশীলব একজোড়া চাকাওয়ালা রোলার স্কেটস। ইয়াসির আরাফাত নামের শিশুটির এক জোড়া রোলার স্কেটস ছিল। রাব্বি নামের এক বন্ধু আড়াই হাজার টাকায় সেটি কেনার প্রস্তাব দিলো কিন্তু শর্ত হলো, টাকা পরে দেবে। আরাফাত রাজি হয়ে বন্ধুকে স্কেটস জোড়া দিয়ে দেয়। কিছুদিন পর রাব্বির কাছে টাকা চাওয়া শুরু করলো সে, কিন্ত টাকা নেই রাব্বির কাছে। কী করা যায় এখন? রাব্বি কবুতর পোষে, আরাফাত তাই টাকার বদলে বন্ধুর কবুতর জোড়া চাইলো।
কিন্ত রাব্বি কবুতরও দিলো না। আরাফাত হুমকি দিলো, রাব্বির বাবা-মায়ের কাছে নালিশ জানাবে সে। রাব্বি তখন দুই বন্ধুর সঙ্গে পরিকল্পনা করলো, কীভাবে টাকা না দিয়েই আরাফাতকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া যায়! ভারতীয় সিরিজ ‘ক্রাইম পেট্রলের কাহিনির’ মতো করে আরাফাতকে খুনের পরিকল্পনা করলো সবাই। পরিকল্পনামাফিক তারা আরাফাতকে একটি আখ ক্ষেতে ডেকে নিয়ে বেদম মারধর করলো, লোহার রডের উপর্যুপরি আঘাতে মাথার মগজ বেরিয়ে এলো আরাফাতের। কিন্ত অলৌকিক হলেও সত্য, আহত হয়ে পড়ে থাকার তেরো ঘন্টা পরে আরাফাতকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। শিশুটি এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে, যদিও তার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়।
আরাফাতকে মারধরের ঘটনায় রাব্বির সঙ্গে জড়িত ছিল আরও দুই শিশু রাকিব এবং রাসেল। বয়সে তারা আরাফাতে চেয়ে এক বছরের বড়। বেধড়ক পেটানোর পরে মৃত ভেবে তারা আরাফাতকে আখ ক্ষেতের ভেতরে ফেলে আসে। জায়গাটা জনমানবশূন্য হওয়ায় তারা ভেবেছিল আরাফাতকে কেউ খুঁজে পাবে না। রাত হয়ে গেলেও আরাফাত বাসায় না ফেরার শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। অভিযোগ জানানো হয় পুলিশে।
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ডেকে আনা হয় রাব্বিকে, কারণ তার সঙ্গেই আরাফারকে দেখা গেছে সর্বশেষ। রাব্বি জানায়, আরাফাতকে সে অপরিচিত একজন লোকের সঙ্গে যেতে দেখেছে। সাক্ষী হিসেবে হাজির করে রাসেল এবং রাকিবকে। তারা দুজনও একই কথাই জানালো পুলিশকে। ক্রাইম পেট্রোল দেখে তারা শিখে গিয়েছিল, জবানবন্দী কোনভাবেই আলাদা হওয়া যাবে না, সবাইকে একই কথা বলতে হবে পুলিশের কাছে। কী বলা হবে, সেটাও ঠিক করে রেখেছিল তারা!
কিন্ত পুলিশও নাছোড়বান্দা। জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে পালা করে, এদিকে বাড়তে থাকে রাত। প্রায় দেড় ঘন্টা পরে প্রথম ভেঙে পড়লো রাসেল। পুলিশকে সে জানালো, আরাফাতের বডি কোথায় আছে সে জানে, কিন্ত আশ্বাস চাইলো, তার যেন কিছু না হয়। ভোরে উদ্ধার অভিযান চালানোর ব্যাপাতে মত দিলো কয়েকজন, কিন্ত পুলিশ দেরী করতে চাইলো না, দেরী করলেই আরাফাতকে জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা কমবে। রাসেলকে নিয়েই পুলিশ ছুটলো বর্ণনার সেই আখ ক্ষেতে।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে কয়েক হাত সামনের জিনিসও দেখা যায় না, তার ওপর ভারী কুয়াশার প্রলেপ। ঠান্ডায় কাঁপাকাঁপি করছে গরম কাপড় পরা মানুষগুলোও। সেখানে আহত একটা শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা এক পার্সেন্টেরও কম। কিন্ত সেই এক পার্সেন্ট সম্ভাবনাটাও ছাড়তে চাইলো না পুলিশ, শুরু হলো খোঁজাখুঁজি।
রাসেলকে ভেতরে নিয়ে গিয়েই আরাফাতের রক্তাক্ত দেহটা উদ্ধার করলো পুলিশ, তার দেহে তখনও প্রাণ আছে! মাথা থেকে চুইয়ে পড়া রক্ত মাটির সঙ্গে জমাট বেঁধে গেছে, বেরিয়ে এসেছে মগজ।এত আলো আর লোকজন দেখে আরাফাত শুধু অস্ফুটে বললো- ‘আপনারা কারা? আমাকে একটা বালিশ দিন আমি একটু ঘুমাব। আমার আব্বু আম্মু কোথায়?’
অভিযুক্ত তিন শিশুর কাছ থেকে জানা গেল, রোববার তারা তিন জন আরাফাতকে এক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এরপর তারা আখ ক্ষেতে গিয়ে একসঙ্গে আখ খায়। পেছন থেকে আরাফাতের মাথায় আঘাত করা হবে, এরকমটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্ত রাব্বি আরাফাতের চেয়ে উচ্চতায় খাটো হওয়ায় সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই সে আরাফাতকে বলে, আখের গোড়ার দিকে যে নতুন কুশি বের হয়েছে সেগুলো ভেঙে নিয়ে বাড়িতে লাগালে আখ গাছ হবে।
বন্ধুদের কথামতো এই কাজ করার সময় পেছন থেকে আরাফাতের মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে রাব্বি। মারধরের একপর্যায়ে আরাফাত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ফেরার পথে রডটি একটি পুকুরে ফেলে দেয় তারা। এটাও তারা ক্রাইম পেট্রোল দেখেই শিখেছিল, অপরাধের প্রমাণ লোপাট করে দিতে হয়! পুলিশ রক্তমাখা সেই রডটি পরে উদ্ধার করেছে।তিনজনকেই যশোর শিশু সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
সংশোধনাগারে তাদের চরিত্রের সংশোধন কতটা হবে সেটা জানিনা। তবে সমাজের অবক্ষয় কী ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সেটা এই ঘটনাটাই প্রমাণ করে দিলো। আমাদের মধ্যে ভালো কিছু শেখার তাড়ানাটা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, জগতের খারাপ সবকিছু নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করার ব্যাপারটা আমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে গেছে। সেখান থেকে বাদ যাচ্ছে না কোমলমতি শিশুরাও! নইলে ক্রাইম পেট্রোলের হাজারটা ভালো মেসেজ এড়িয়ে খুনের পরিকল্পনাটাই কেন আমাদের নাথায় ঢুকবে? যে দেশে এগারো-বারো বছরের শিশুরা এমন প্রি-প্ল্যানড মার্ডারের ছক সাজাতে পারে, ঠান্ডা মাথায় নিজের বন্ধুকে খুনের চেষ্টা করতে পারে, সেদেশের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি!