পাবলো এসকোবার- দ্য কিং অফ কোকেনের অবিশ্বাস্য জীবনের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পাবলো এমিলিও এসকোবার গাভিরিয়া। কলম্বিয়ার সবচেয়ে ধূর্ত মাদক সম্রাটের নাম। কোকেন পাচারের ইতিহাসে এসকোবারকে ধরা হয় সবচেয়ে প্রভাবশালী, ধূর্ত এবং বিত্তবান। কোকেনের মূল বাজার আমেরিকায়। আমেরিকায় কোকেন পাচারের জন্য এসকোবার গড়ে তুলেছিলেন ‘মেডেলিন কার্টেল’।
পাবলো এমিলিও এসকোবার গাভিরিয়া। কলম্বিয়ার সবচেয়ে ধূর্ত মাদক সম্রাটের নাম। কোকেন পাচারের ইতিহাসে এসকোবারকে ধরা হয় সবচেয়ে প্রভাবশালী, ধূর্ত এবং বিত্তবান। কোকেনের মূল বাজার আমেরিকায়। আমেরিকায় কোকেন পাচারের জন্য এসকোবার গড়ে তুলেছিলেন ‘মেডেলিন কার্টেল’। এই চক্র ১৯৭০ এবং ৮০-এর দশকে বাইরে থেকে আমেরিকার ভেতরে ঢোকা মাদকের শতকরা ৮০ ভাগ যোগান দিয়ে গেছে। এই ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো মেডেলিন কার্টেলের, তার বশ হিসেবে এসকোবারের। আয় হতো মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। ৯০ এর দশকে এসকোবারের জ্ঞাত সম্পত্তির পরিমাণ ছিলো ৩০ বিলিয়ন ডলার। এত টাকা ব্যাংকে রাখা সম্ভব না, রাখলে নানাবিধ আইনি ফ্যাকরা। তাই এসকোবার গোটা কলম্বিয়া জুড়ে গর্ত করে মাটির নীচে রেখেছিলেন কাড়ি কাড়ি ডলার। শুধু মাটির নীচে রেখেই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন, ব্যপারটা এমন না। বিশ্বের নানাপ্রান্তে চার শতাধিক ম্যানসন, ব্যক্তিগত বিমান আর নিজস্ব একটা চিড়িয়াখানাও তার ছিল। সেই চিড়িয়াখানায় এনে রেখেছিলেন নানা পদের জানোয়ার।
১৯৪৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর। কলম্বিয়ার রিওনিগ্রো এলাকার নিম্নবিত্ত এক পরিবারে জন্ম নেন এসকোবার। সাত ভাইবোনের মাঝে তৃতীয় এসকোবারের বাবা কৃষক এবং মা ছিলেন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা। কিশোর বয়সেই অপরাধজগতে হাতেখড়ি হয় এসকোবারের। শুরুটা হয়েছিলো কবরস্থানের নামফলক চুরির মাধ্যমে। কবরস্থানে যেসব কবরে আত্মীয়স্বজন কম আসতেন, সেসব কবরের নামফলক চুরি করতেন এসকোবার। নামফলক পরে ঘষে পরিস্কার করে বিক্রি করে দিতেন স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছে। সাথে উপরি হিসেবে ছিলো কবরে স্থাপন করা ভাস্কর্য। এগুলো বিক্রি হতো বেশ চড়া দামে। পাশাপাশি নকল লটারীর টিকেট, আর গাড়ি চুরি। এসময় কলম্বিয়াতে তৈরী সিগারেটের পাশাপাশি মার্লবোরো কোম্পানীর চোরাই সিগারেট বিক্রি হতো বাজারে। বাজারের আধিপত্যের গ্যাঁড়ায় ঢুকে পড়েন এসকোবার, হয়ে ওঠেন মূল চরিত্রদের একজন।
মূলত এখান থেকেই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ও তা ধরে রাখার কলাকৌশল রপ্ত করে ফেলেন এসকোবার। এ অভিজ্ঞতার পুরোটা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন কোকেন সাম্রাজ্যের গড়া এবং রক্ষার কাজে। স্বপ্ন ছিলো ২২ বছর বয়সেই হবেন লাখপতি। পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চলছিলো। কারণ এসকোবারের আরেকটা স্বপ্ন ছিলো, হবেন- কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট। ইউনিভার্সিটি অটোনোমা ল্যাটিনোমেরিকানা অফ মেডেলিন এ কিছুদিন পড়ার পর পাট চুকিয়ে ছোটা শুরু করেন টাকার পেছনে। প্রথমেই মেডেলিন এলাকার এক হোমরাচোমরার আত্মীয়কে কিডন্যাপ করে বড় দাঁও মারেন এসকোবার। মুক্তিপণ ১ লাখ ডলার। এরপরে পরিচয় হয় আলভেরো প্রিটোর সাথে। জানলেন কোকেন পাচারের অলিগলি। কোকেন পাচারের ক্ষেত্রে কলম্বিয়ার নামটা একেবারে শুরুতে আসেনি। কলম্বিয়ার মাটিতে প্রচুর পরিমাণে গাঁজা উৎপন্ন হয়, তাই চাষটাও হয় ব্যাপক হারে। আমেরিকায় কলম্বিয়া থেকে প্রথমে পাচার হতো গাঁজা। পরে দেখা গেলো কোকেন তৈরীর কাঁচামাল কোকা পাতার কোকা গাছও কলম্বিয়ার মাটিতে বেশ ভালো বাড়ে। আবার দাম গাঁজার তুলনায় অনেক বেশি। শুরু হয় কোকা গাছের চাষ। কলম্বিয়ার ভৌগলিক অবস্থানও দারুণ। দক্ষিন আমেরিকার একেবারে উত্তর প্রান্তে অবস্থিত কলম্বিয়া, উত্তরে আর অল্প এগুলেই আমেরিকা। মাদকদ্রব্যের বিশাল বাজার।
কোকেনের রাজ্যে প্রথমদিকে আধিপত্য ছিলো বলিভিয়া আর পেরুর। তারা কোকা পেষ্ট থেকে কোকেন তৈরী করতো। কোকেনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা আর আকাশচুম্বী দামের কারণে এসকোবার ঝোঁকেন কোকেনের দিকে। ১৯৭৫ সালে মেডেলিন এলাকার কোকেন পাচারকারী ফ্যাবিও রেসত্রেপো খুন হয়ে যান। ধারণা করা হয় এই খুনের পেছনের মানুষটি হচ্ছেন এসকোবার। রেসত্রেপো খুন হবার পর এসকোবার খুব দ্রুত তার জায়গা নিয়ে নেন। প্রথমে রেসত্রেপোর রাস্তাতেই হেঁটেছিলেন এসকোবার। রেসত্রেপো কোকা পেষ্ট বিক্রি করতেন বলিভিয়া আর পেরুতে। পরে এরা কোকেন বানিয়ে পাচার করতো আমেরিকায়। এসকোবার শুরুতে একবারের জন্য বিপুল পরিমাণে কোকা পেষ্ট বিক্রি করেন বলিভিয়া আর পেরুর ব্যাবসায়ীদের কাছে। সেই ডলার দিয়ে গড়ে তোলেন ছোট্ট কিন্তু কুখ্যাত মেডেলিন কার্টেল।
১৯৭৬ সালে এসকোবার তার প্রেমিকা মারিয়া ভিক্টোরিয়া হেনাও কে বিয়ে করেন। এসময় এসকোবার এর বয়স ছিলো সাতাশ আর মারিয়ার মাত্র পনেরো। মারিয়ার বাড়িতে আগে থেকেই যাওয়া-আসা ছিল এসকোবারের। মারিয়ার বড় ভাই মারিও ছিল এসকোবারের অপরাধী দলের চ্যালা। সেই পরিবার এ সম্পর্কেই রাজী ছিলোনা, বিয়েতো দূরের কথা। তাই এই প্রেমিক যুগল পালিয়েই বিয়েটা সেরে ফেলে। তাদের ঘর আলো করে আসে দুই সন্তান। ছেলে হুয়ান পাবলো এবং মেয়ে ম্যানুয়েলা। মেডেলিন কার্টেলের মাথা হবার পর থেকেই নিত্যনতুন পন্থায় আর নতুন নতুন রুটে কোকেন পাচার শুরু করেন এসকোবার। প্রথম চালান দেন গাড়ির টায়ারের ভেতরে করে। রুটের সমস্ত চেকপয়েন্টের গার্ড ছিলো রিজিওনাল কলম্বিয়া কন্ট্রোল এজেন্সীর সৈনিকেরা। তাদের সাথে ছিলো মাসকাবারী চুক্তি। একবার মাসিক চুক্তির টাকা নিয়ে সামান্য বচসার কারণে এসকোবারের নিজের এলাকার কন্ট্রোল এজেন্সী চিফ তার একটা মাগশট নিয়েছিলেন। সাথে অভিযোগ লিখেছিলেন যে এসকোবারের সঙ্গীদের কাছে কিছু কোকেন পাওয়া গেছে।
গাড়ির টায়ারে করে পাঠানো চালানে পোষাচ্ছিলো না। গাড়ির সাথে সাথে শুরু করলেন বিমানের চাকার ভেতরে করে পাচার। প্রতিবার চালান নিয়ে গেলে বিমানের পাইলটকে দেয়া হতো পাঁচ লাখ ডলার! মানুষের পেটে করে কোকেন পাঠানোর বুদ্ধিটা বেরিয়েছিলো তার মাথা থেকেই। এক্ষেত্রে এসকোবারের পছন্দ ছিলো গর্ভবতী মায়েরা। কারন গর্ভবতী মায়েদের ইমিগ্রেশনে খুব বেশি চেক করা হয়না। আমেরিকায় রপ্তানি হয়, এমন কোনো পণ্য এসকোবার বাদ রাখেননি। প্রতিটা পণ্যের সাথে আমেরিকায় কোকেন ঢুকেছে। বাদ পড়েনি যীশু এবং মাদাম মেরীর প্রতিমাও। পাচারের জন্য শোনা যায় এসকোবার একটা সাবমেরিন পর্যন্ত কিনেছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি দেখা গেলো আমেরিকায় যত কোকেন পাচার হচ্ছে, তার শতকরা আশি ভাগ এসকোবারের দখলে। ধারণা করা হয় প্রতিদিন পাচার হতো প্রায় ১৫ টন। আর মেডেলিন কার্টেলের সাপ্তাহিক রোজগার ৪২০ মিলিয়ন ডলার!
প্রথম দিকে জাহাজের কার্গোতে করে ডলার আসতো কলম্বিয়াতে। কার্গোয় বিছানার জাজিমের ভেতর ছোবড়ার বদলে আসতো ডলার। দিন দিন পরিমাণ এতো বেড়ে যায় যে এই ডলার আনার জন্যে এসকোবার কিনে ফেলেন একটা লিয়ারজেট। একটা গল্প প্রচলিত আছে। এসকোবারের ডলারের বান্ডিল করার জন্য সারা মাসে ২৫০০ ডলারের শুধু রাবারব্যাণ্ড কিনতে হতো। এত টাকা ব্যাংকে রাখা যেতো না তাই বিকল্প হিসেবে ড্রামের ভেতরে বা ট্রাঙ্কের ভেতরে করে ডলার মাটিতে পুঁতে রেখেছিলেন এসকোবার। কোথায় কোথায় ডলার পুঁতে রাখা হচ্ছে এবং পরিমাণে কতো তার হিসেব রাখার জন্য একজন আলাদা লোক ছিলো। সেই লোকের কোডনেইম ব্ল্যাকবিয়ার্ড। বিখ্যাত পাইরেটের নামে নাম। এসকোবারের বিপুল পরিমাণের ডলারের নাকি দশভাগ ইঁদুরে খেয়েছে অথবা জলে ভিজে নষ্ট হয়েছে। এসকোবারের পলাতক জীবনের কোনো এক সময় মেয়ের গা গরম রাখতে বাড়ির ফায়ারপ্লেসের কাঠের অভাবে কয়েক মিলিয়ন ডলার পোড়ানোর কাহিনীও শোনা যায়।
১৯৮০ সালে কলম্বিয়ান সরকার এসকোবারের ১৪২টি বিমান, ২০ টি হেলিকপ্টার, ৩২ টি ইয়াট এবং ১৪১ টি বাড়ি ও অফিস জব্দ করে। তাতেও অবশ্য এসকোবারের গায়ে তেমন একটা আঁচ লাগেনি। দুনিয়ার সর্বোচ্চ ধনীদের দশজনের তালিকায় নাম উঠে আসে এসকোবারের। তখন তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ৩০ বিলিয়ন ডলার। এসকোবার তখন থাকেন নিজের এষ্টেট, ‘হেসিয়েন্দা নেপোলেস’ এ। এষ্টেটের আয়তন ২০ বর্গ কিলোমিটার। ভেতরে ব্যক্তিগত এয়ারপোর্ট, বুলরিঙ, গো-কার্ট ট্র্যাক আর ছিলো একটা চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানায় জলহস্তী, জিরাফ, অস্ট্রিচ, এন্টিলোপ সহ বিভিন্ন প্রাণী আর ছিলো নানা জাতের পাখী। ছিলো ডায়নোসরদের প্রমান সাইজের রেপ্লিকা দিয়ে নিজের দুই বাচ্চার জন্যে বানানো থিম পার্ক। এসকোবারের মৃত্যুর পর সরকার এখানকার প্রানীদের সরিয়ে নেয়। শুধু জলহস্তীরা এখনো আছে একই জায়গায় বহাল তবিয়তে।
বিপুল এই সম্পদের একটা অংশ তিনি খরচ করেছিলেন গরীব দুঃখীদের জন্য। তাদের জন্য হাসপাতাল, চার্চ, খেলার মাঠ, পার্ক, ব্যারিও বানিয়ে দিয়েছিলেন। এর অবশ্য আরেকটা কারণ ছিলো। সেই যে, প্রেসিডেন্ট হবার ইচ্ছা। দান খয়রাত করে নিজের ‘রবিন হুড’ সুলভ একটা ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর এসকোবার নামেন রাজনীতিতে। ১৯৮২ সালে হয়ে গেলেন কলম্বিয়ান কংগ্রেস মেম্বার। ভোটের সময় কাগজে কলমে তার বিশাল সম্পত্তির উতস দেখালেন প্রাইভেট ট্যাক্সির ব্যাবসা। এসকোবারের বিরুদ্ধে আসলে কোথাও কোন তথ্য প্রমাণ ছিলোনা। কাউকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে তাকে খুন করতে আটকাতো না এসকোবার। অবশ্য তাতে কিছু থেমে থাকেনি। সামনে চলে আসে সেই তোলা মাগশট। বহিস্কৃত হন এসকোবার। এর পরেই কংগ্রেসের আইনমন্ত্রী নিহত হন নিজের গাড়িতে, মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে।
বহিস্কারের পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এসকোবার। পাচার করতে থাকেন আরো বেশি বেশি কোকেন। আমেরিকার মায়ামীতে যখন দেখা গেলো কোকেনের পেছনে হাতবদল হওয়া ডলারের পরিমাণ তার বাতসরিক বাজেটের কয়েকগুন, তখন টনক নড়ে আমেরিকার। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান আমেরিকার তরুন সমাজের উদ্দেশ্য করে ভাষন দেন। আমেরিকা শুরু করে এসকোবার গ্রেফতার অভিযান। সাথে কলম্বিয়ান সরকার। অবশ্য এর আগে থেকেই কলম্বিয়ান সরকার এসকোবার কে গ্রেফতারের চেষ্টা করে আসছিলো। তখন সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধই ঘোষনা করে দিয়েছিলেন এসকোবার। আমেরিকা কলম্বিয়াতে সৈন্য পাঠাতে চাইলে তাতে রাজী হয়নি কলম্বিয়া। এর পর আমেরিকা করে এক্সট্রাডিশন চুক্তি। গোটা আমেরিকাকে কোকেনের নেশাতে বুঁদ করে দেয়া এসকোবারকে যেকোন মূল্যে নিজের দেশে ধরে নিয়ে যেতে চাইছিলো আমেরিকা। এতে এসকোবারকে ধরে নেয়ার পাশাপাশি কলম্বিয়ার রাজনীতির কিছু ব্যাপার জড়িত ছিলো। ১৯৮৪ সালে যৌথ অভিযান শুরু করে কলম্বিয়ার সরকার। তাতে জনবল কলম্বিয়ার আর প্রযুক্তিগত সমস্ত সহায়তা আমেরিকার। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান এসকোবার।
এসকোবার ভয় পেতেন দুটি জিনিষ। এক, নিজের বৌ বাচ্চা ছাড়া থাকা আর আমেরিকা এবং কলম্বিয়ান সরকারের মাঝে করা এক্সট্রাডিশন চুক্তি। ধরা পড়লে আমেরিকার জেলে যেতে হতে পারে, এই বিষয়টা তিনি তার সারাজীবনের কোনো সময়েই মেনে নিতে পারেন নি। এই চুক্তির আওতা থেকে মুক্তি পেতে কলম্বিয়ান সরকারকে তার বৈদেশিক ঋণের ১০ বিলিয়ন ডলার চুকিয়ে দেবেন বলে প্রস্তাব করেছিলেন। তাতে অবশ্য কলম্বিয়ান সরকার রাজী হয়নি। ১৯৮৫ সালে কলম্বিয়ার বামপন্থী গেরিলা বাহিনী এম-১৯ কে টাকা দিয়ে কলম্বিয়ার জাস্টিস বিল্ডিং এ হামলা করান নাটকীয় ষ্টাইলে। জাস্টিস বিল্ডিং এ রাখা এক্সট্রাডিশন চুক্তির আওতায় ধরা পড়া সমস্ত কোকেন পাচারকারীদের কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয় গেরিলা বাহিনী। হত্যা করা হয় অর্ধেকের বেশি বিচারককে। দেশে শুরু হয় এক কালো অধ্যায়ের।
শুধু সরকারকে নাজেহাল করার জন্যে এসকোবারের নির্দেশে তার লোকেরা প্রায় ১০০০ পুলিশ হত্যা করে। এই তালিকায় আছেন একজন এটর্নি জেনারেল এবং বিচারকেরাও। বিচারকার্য চালানোর সময় দেখা গেলো বিচারকেরা মুখোশ পড়ে কোর্টে আসছেন যাতে তাকে চিনে ফেলে এসকোবারের লোকজন মেরে না ফেলে। কলম্বিয়ান সরকার পড়ে যায় মস্ত এক গ্যাড়াকলের ভেতর। না সামলানো যাচ্ছে দানব এসকোবারকে, না সামলানো যাচ্ছে বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক চাপ। এর মাঝে ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন ল্যুইস কার্লোস গ্যালান। ব্যক্তি হিসেবে তিনি এক্সট্রাডিশন চুক্তির সমর্থক এবং এসকোবারকে ধরায় ছিলেন বদ্ধপরিকর। গ্যালান প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহনের দিন প্রকাশ্যে নিহত হন মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে। ধারণা করা হয় এর পেছনের মানুষটির নাম এসকোবার। প্রেসিডেন্ট গ্যালানের মৃত্যুর পর নতুন প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনের প্রার্থী এবং ঐ মুহুর্তে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সিজার গ্যাভিরিয়া ট্রুইলোকে হত্যা করার জন্য বিমানে বোমা বিস্ফোরন ঘটান এসকোবার। গ্যাভিরিয়া নিজেও এসকোবারকে ধরার জন্যে অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এভিয়াঙ্কা ফ্লাইট রানওয়ে ছাড়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় মাটি থেকে ১৩০০০ ফুট ওপরে বিস্ফোরিত হয়। এতে সিজার গ্যাভিরিয়া বেঁচে গেলেও মারা যায় নির্দোষ ১০৭ জন।
এর পরপরই গ্যাভিরিয়া প্রশাসন এসকোবারের সাথে সমঝোতা করে। আমেরিকার হাতে তুলে না দেয়া এবং অপরাধ কার্যক্রম কমিয়ে আনার শর্তে এসকোবার আত্মসমর্পনে রাজী হন। তাও সেই আত্মসমর্পন সরকারের কাছে না। তিনি থাকবেন তার নিজের তৈরী করা জেলের ভেতর বন্দী হিসেবে। গার্ড থাকবে তার নিজের এবং জেলের আশেপাশের দুই মাইল ব্যাসার্ধে সরকারী কোন বাহিনীর লোক দেখা যাবেনা, এই ছিলো শর্ত। গ্যাভিরিয়া প্রশাসন তা মেনে নেয়। এসকোবার থাকতে শুরু করেন তার নিজের বানানো ‘লা ক্যাথেড্রাল’-এ। সে এল আলিশান ব্যাপার স্যাপার ছিলো। তার ব্যক্তিগত জেলের ভেতর টেলিফোন, টিভি, জিমনেশিয়াম, স্পা, ক্যাসিনো, স্যুইমিং পুল, ফুটবল খেলার মাঠ- সব ছিলো।
সরকার যখন টের পেয়ে গেলো জেলের ভেতরে থেকে এসকোবার তার কাজকর্ম আরো ভালো ভাবে চালাচ্ছে তখন তাকে সরকারী জেলে পোরার চেষ্টা করে। লা ক্যাথেড্রালে অভিযান চালায়। নয় জন চ্যালা সহ সুড়ঙ্গ পথে পালায় এসকোবার। লা ক্যাথেড্রাল থেকে পালানোর পর এসকোবারকে ধরার জন্য সরকার থেকে গঠন করা হয় বিশেষ সেল। নাম দেয়া হয় সার্চ ব্লক। লোকাল বিভিন্ন ইনফো থেকে শুরু করে এই দলে ছিলো ইলেকট্রনিক সার্ভেইল্যান্স টীম। ১৬ মাস পর ব্রিগেডিয়ার হুগো মার্টিনেজ রেডিও ট্রায়াঙ্গুলেশন টেকনোলজি ব্যবহার করে এসকোবারের রেডিওটেলিফোন ট্রান্সমিশন ধরতে সমর্থ হন। দেখা গেলো এসকোবার দিব্যি লুকিয়ে আছে খোদ মেডেলিন এর লস ওলিভোস এলাকার মধ্যবিত্তদের থাকার জন্য বানানো এক কলোনীতে। সার্চ ব্লকের আনাগোনা টের পেতেই কলোনীর ছাদ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন এসকোবার। সাথে তার একমাত্র দেহরক্ষী লিমোনে। এসকোবারের পেটে, পায়ে আর কানে গুলি লাগে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসকোবারের মৃত্যু আদতেই পুলিশের বুলেটে হয়েছে নাকি পুলিশের গুলি খাবার পর এসকোবার নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন- এই রহস্য আজও রয়ে গেছে!