ঢাকার ঠিক মাঝখানে ভর সন্ধ্যায় গিজগিজে পাকিস্তানী মিলিটারির মধ্যে ৯২ রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছিল ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধষ গেরিলারা; তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা সুপ্রশিক্ষিত দলকে এভাবেই কয়েকটা অসমসাহসী ক্র্যাক ছেলে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছিল, জাস্ট ৯২ সেকেন্ডের মধ্যে!

৮ই আগস্ট, ১৯৭১। ফার্মগেট মোড়। আর্মি চেকপোস্ট। দুটো তাঁবু। তিনজন সৈন্যকে বাইরে দেখা যাচ্ছে। বাকিরা ভেতরে ডিনার করছে অথবা রেস্ট নিচ্ছে। গাড়ি চালাচ্ছেন সামাদ ভাই, পাশে আলম, তার পাশে বদি। সামাদ ভাইয়ের ঠিক পিছনে স্বপন, তার পাশে পুলু আর বদির পিছনে বসেছে মায়া। আসার কথা ছিল গাজীর, কিন্তু কোন কারনে গাজী আসতে পারেনি, তাই পুলুকে নিয়ে আসা হইছিল। পুলুকে দেওয়া হলো গ্রেনেড লঞ্চ করার দায়িত্ব। 

ইন্ডিয়ান গ্রেনেডের পাশাপাশি দুইটা ফসফরাস গ্রেনেডও ছিল পুলুর কাছে। ফসফরাস গ্রেনেড দিয়ে সব পুড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু দারুল কাবারের সংকেত দিতে দরকার ইন্ডিয়ান গ্রেনেডের সাউন্ড। তখনকার টয়োটাগুলায় স্টিয়ারিং হুইল স্টিয়ারিং এর সাথে, তাই সামনে তিনজন বসতে পারে। ঠিক সাতটা ১৫ মিনিটে বদিদের গাড়িটা ডানদিকে ঘুরে তেজগাঁও সড়কে গিয়ে টার্ন নিয়ে আবার ধীরে ধীরে হলিক্রস কলেজের গেটের কাছে এসে থেমে গেল। 

গাড়ির লাইটটা অফ করে দেওয়া হয়েছে বহু আগে। নিঃশব্দে নেমে গেল ছয়জন, চোখের পলকে অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হয়ে গেল। চেকপোস্টের চারদিকে তিন ফিট উঁচু দেয়াল আর তার উপর তিনফিট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। আলম নিঃশব্দে চাইনিজ এসএমজিটা নিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার উপর পজিশন নিল। ওর কপালটা খুব ভালো, রাইফেলের রেঞ্জে তিনটা গার্ডের দুইটাকা পেয়ে গেল। সমস্যা হচ্ছে, তিনটাকে একসাথে ফালাইতে না পারলে পরিস্থিতি কব্জা করা যাবে না। 

একটু পর দেখা গেল তৃতীয় গার্ড পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বাকি দুইটার আড্ডায় যোগ দিতে আসছে। তিনটা কাছাকাছি দেখামাত্র বদির কণ্ঠে চিৎকার শোনা গেল- ফায়ার...! সাথে সাথে গর্জে উঠলো আলমের এসএমজি, তৃতীয় গার্ডটা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, বাকি দুইটা গার্ড কাটা কলাগাছের মত দড়াম করে পড়ে গেল। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কা সামলায়া পকেট থেকে দুই হাত বের করতে করতেই তাকেও নরকের ওয়ানওয়ে টিকিট ধরিয়ে দিল আলমের সেকেন্ড ব্রাশফায়ার। সাথে সাথে বাকিদের একসঙ্গে ব্রাশফায়ার তাঁবু দুইটা লক্ষ্য করে। 

হঠাৎ আবিস্কার করল আলম, তার মাথার উপর আর দুইপাশ দিয়ে সাঁইসাঁই করে বুলেট যাচ্ছে, কিছুক্ষণের জন্য বধির করে দিল চারপাশ। আশেপাশের মানুষগুলোকে দেখে মনে হইল তারা মোমের মূর্তিতে পরিণত হয়েছে, ভয়ের চোটে মাটিতে ডাইভ দিতেও ভুলে গেছে সবাই। ২০ সেকেন্ড এইভাবে টানা ফায়ার চলল, তাঁবুর ভেতর ও বাইরে সব কিছু ঝাঁজরা হইয়া গেল। স্বপন নির্দেশ দিল, রিট্রিট... সাথে সাথে পুলু দুইটা ইন্ডিয়ান পাইন অ্যাপেল গ্রেনেড ফেলেই হাওয়া! সবাই কোনোমতে গাড়ির দরজায় পা রাখতে না রাখতেই টান দিল সামাদ ভাই, টয়োটা সিক্সটি ফাইভ ফার্মগেট থাইকা মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে গেল! 

ঢাকার ঠিক মাঝখানে ভর সন্ধ্যায় গিজগিজে পাকিস্তানী মিলিটারির মধ্যে বিরানব্বই রাউন্ড গুলি ছুঁড়ছিল ক্র্যাকগুলা; তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষতম আর্মি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা সুপ্রশিক্ষিত দলকে এভাবেই কয়েকটা অসমসাহসী ক্র্যাক ছেলে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছিল, জাস্ট বিরানব্বই সেকেন্ডের মধ্যে! 

আজাদের মগবাজারের বাসায় পরে এই অপারেশনের কথা বলছিল জুয়েল। চেকপোস্টের ১২ জনই মরেছে এইটা শুনে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আজাদ বললো, 'কয়জন মরল, সেইটার হিসাব তোরা পাইলি ক্যামনে?' হাসতে হাসতে জুয়েল বললো, 'পরের দিন আশরাফুলের বাড়ি গেছিলাম, ওইখানে আমাগো বন্ধু হিউবার্ট রোজারিও সব খুইলা কইল। তার বড় বোন তো হলিক্রসের টিচার, সেইদিন রাত্রে সব দেখছে। সারা রাইত আর্মি আইতে সাহস পায় নাই, পরেরদিন ভোরে আইসা ডেডবডিগুলা নিয়া গেছে। 

চিন্তা কর, এরা নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে সাহসী সোলজার, লোমভর্তি শিনা চাপড়ায়া কয়, উই আর দ্যা বেস্ট। এই হইল দুনিয়ার সেরা আর্মির নমুনা। সারা রাইত সেনাগুলা পইড়া থাকলো, কেউ তো উন্ডেডও থাকতে পারে, আইসা দেখ, হসপিটালে নিয়া যা। নাহ, ইন্দুরের বাচ্চা সব, গর্ত থাইকা মুখটা বাইর করার সাহস নাই, তাও আবার ঢাকা শহরে। আরে নিউজ শুইনা নাকি ক্যান্টনমেন্টে সব সোলজারের পেশাব পাইছে, একলগে। কার আগে কে যাইব বাথরুমে, এই নিয়া হুটপাট। শ্যাষে বাথরুমে যাওয়ার আগেই নাকি কাম হয়া গেছে, প্যান্টের মধ্যেই। মুতের গন্ধে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাওয়া যাইতেছে না…'

জুয়েলের রসিকতা শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে সবাই। আজকে প্রজন্ম কুলনেস আর তুফানি বলতে বোঝে মাসল ফুলানো বলিউড-হলিউডের নায়কদের, ভিনদেশী কমিকের অবাস্তব সুপারহিরোরা তাদের আইডল, ৪৬ বছর আগে তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানী মিলিটারিকে ইন্দুরের বাচ্চা বানিয়ে ফেলা তারছিঁড়া কিছু ক্র্যাককে আজকাল আর কেউ চেনে না। চেনার চেষ্টাও নাই। অকুতোভয় শেকড় নিয়া গর্ব করতেই যেখানে প্রজন্ম লজ্জা পায়, কি দরকার আর সেখানে ৪৬ বছর আগের ইতিহাস টানার! 

তথ্যসূত্র- 

১। ব্রেইভ অফ হার্ট- হাবিবুল আলম বীর প্রতীক

২। বারে বারে ফিরে যাই- মেজর(অবসরপ্রাপ্ত) ডাঃ আখতার


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা