আপনি যখন ট্রল করছেন, তামাশা করছেন, কিছু মানুষ তখন কাজ করছে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ট্রল করে কিছু হাহা রিয়েক্ট পাবেন, কিছুক্ষণ আনন্দে থাকবেন, কিছুটা সময় ভালো কাটবে। কিন্তু একটা সত্য জানেন কী? আপনার ট্রলের কারণে কারো এক বেলা ভাত জুটবে না। আপনার ট্রল একটা মানুষের জীবন বাঁচাবে না...
পরিচিত এক আপু আছেন, সিংগেল মাদার। পরিজন বলতে আর কেউ নেই। ঢাকায় পার্লার চালাতেন। করোনার আঘাত এসে সরাসরি লাগল পার্লারে। বন্ধ হলো পার্লার, বন্ধ হয়ে গেল রুটি রুজির একমাত্র অবলম্বন৷ কিন্তু উপার্জন বন্ধ হলেই তো জীবন থেমে থাকে না, ঢাকার মতো জায়গায় বাঁচতে গেলে খরচা আছে। এখানে এক ইঞ্চি জায়গার পেছনে টাকা ঢালতে হয়। প্রতি ফোঁটা পানি, প্রতি দানা শস্য, একেকটা শাক পাতা... সবই কিনতে হয় টাকা দিয়ে।
উনার বাসা ভাড়া আটকে গেল। বাড়িওয়ালা এক দুই অপেক্ষা করে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিল। মেয়ে নিয়ে উঠলেন লতাপাতার আত্মীয়ের বাসায়। সেখানকার গ্রহকর্তী এক কাপ চা খেতে দেখলে ডিরেক্ট খোঁটা দিয়ে বসেন। মেয়ের পড়া শোনা, নিজের বাকি জীবন সব অনিশ্চিত। কোথাও যাবার জায়গা নেই। উনি ডিসিশন নিলেন সুইসাইড করবেন। কোনোভাবে মেয়ের একটা ব্যবস্থা করেই শেষ করে ফেলবেন জীবনের যুদ্ধ। ফুল এন্ড ফাইনাল। কিন্তু একটা ইউটার্ণ চলে এলো তার জীবনে!
কীভাবে জানি মাথায় চলে এলো একটা বিজনেস আইডিয়া। ঢাকার রেস্টুরেন্ট তখন সব বন্ধ। অনেক মানুষ নাস্তা খাবার নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিল। শুরু করে দিলেন রুটি, পুরি, রুল বানিয়ে সাপ্লাই দেয়া। পাশাপাশি বাজার থেকে সবজি কিনে এনে কেটে-বেছে পাঠানো হলো বিভিন্ন বাসায়।
মাত্র এক মাসের মধ্যে জমে গেল ব্যবসা। নিজের ছেড়ে দেয়া বাসায় আবার ফিরে গেলেম। মেয়ের টিচার আবার বাসায় আসা শুরু করল। এমনকি দুইজন ডেলিভারিম্যানের চাকরিও পর্যন্ত দিয়ে দিলেন। শেষ বার যখন আমার সাথে ফোনে কথা হয়, ব্যস্ততার জন্য কথাই বলতে পারেননি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে করতে নাকি জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই মানুষটার জীবন শেষ হতে চলেছিল কাজের অভাবে!
আরেক পরিচিত দম্পত্তি, করোনায় চাকরি হারালেন দুজনেই। চাকরি হারানো মানে স্যালারি অফ। স্যালারি অফ থাকলে জীবন কীভাবে চলবে? এই অসহ্য সময়গুলোই বা কাটবে কীভাবে? উনারা দুজন মিলে শুরু করলেন প্রায় একই রকম বিজনেস। ঘরে তৈরি প্রায় সব রকম খাবার অর্ডার নিয়ে বাইরে পাঠানো, এই সহজ পদ্ধতি।
আমি উনাদের কাজ পাশে থেকে দেখেছি। একটা অর্ডার পাওয়ার পর বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসা, তারপর সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মাঝ রাত পর্যন্ত জিনিসগুলো প্রসেস করা হয়। সকালে ঘুম থেকে আরেক দফা কাজ। এরপর ডেলিভারি। সত্যি বলতে, একটা খাবারের আইটেম রেডি করতে এত শ্রম আর মেধা লাগে এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। একটা খাবার আইটেমের ছবি পোস্ট করার পর একটা লাভ বা লাইক ইমো চেপে দেয়া আমার ধারণাও ছিল এই কাজগুলো যারা করে তাদের কতটা ধৈর্য থাকতে হয়। উনারা ব্যবসা থেকে এখনো খুব কিছু করতে পারেননি। কিন্তু স্যালারি অফ হওয়ার যে ক্রাইসিস, সেটা নিশ্চিতভাবেই কাটাতে পেরেছেন।
আমার আরেক ডাক্তার বান্ধবী, করোনায় চেম্বার অফ করতে হয়েছিল তার। বাসায় গিয়ে শুরু করেছে কাপড়, চা পাতার বিজনেস। শুনেছি ভালোই করছে। পরিচিত আরেক ডাক্তার ছোটোবোন বিক্রি করছে মাস্ক, নার্সিং পিলোও। মেডিকেলে পড়ুয়া কয়েকজন জুনিয়র কাজ করছে মধু নিয়ে। একজন পরিচিত মাদ্রাসা শিক্ষক সম্ভবত চাকরি ছেড়ে দিয়ে করছেন চা পাতা, চিনিগুড়া চালসহ সমজাতীয় কিছু পণ্যের ব্যবসা। এমন আরও অনেক নাম আছে, অনেক রকম জিনিস নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। সবার চাকরি চলে গেছে বা আর্থিক টানাপোড়েনে পড়ে এসবে নেমেছেন তা অবশ্য না। কেউ কেউ করছেন শখের বশে, কেউ আবার বাড়তি কিছু টাকা আয়ের আশায়।
উপরের যে উদাহরণগুলো দিলাম এসব আপনাদের অজানা না। প্রায় সবার পরিচিত একাধিক বা অনেক মানুষ আছেন যারা হঠাৎ করেই অনলাইন ব্যবসায় নেমেছেন। প্রায়ই অনেকে পোস্ট দিয়ে বলেন, "নিউজফিড তো বাজার হয়ে গেল" বা "আমার লিস্টে কে কে ব্যবসা করছেন না হাত তুলেন"... সোজা কথায়, অনলাইন ব্যবসা এখন চরম হাইপে আছে।
যখনই কোনো কিছু নিয়ে তীব্র হাইপ ওঠে, তার বিপরীত একটা স্রোত তৈরি হতে সময় লাগে না আমাদের দেশে। এই অনলাইন ব্যবসার ব্যাপারটাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অনলাইন ব্যবসা নিয়ে এতদিন হালকা ধাঁচে ট্রল হলেও হঠাৎ করেই ব্যাপারটা লিমিট ক্রস করে ফেলেছে। হ্যাঁ আমি জানি ট্রলগুলো হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ ও গ্রুপ প্রধানের কার্যক্রমকে টার্গেট করে। সেই গ্রুপ বা গ্রুপ প্রধানকে নিয়ে আমার নিজেরও কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
গ্রুপ প্রধান ভদ্রলোককে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী কায়দায় প্রতি পোস্টে মেনশন করা হয়, সেটা আমার কাছে দৃষ্টিকটু লাগে। প্রধানমন্ত্রীকে কারণে অকারণে অনারেবল মেনশন না করলে অনেকেরই মনে যেমন চাকরি হারানোর ভয় থাকে, এই গ্রুপ লিডারের ক্ষেত্রেও সামহাউ এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শুধু তেলানোর জন্য উনাকে মেনশন করা হয় ব্যাপারটা তেমন নাও হতে পারে। উনার নাম না নিলে পোস্ট এপ্রুভ হবে না এই আশংকাটাও সম্ভবত অনেকের ভেতর কাজ করে।
ভদ্রলোকের পোস্টগুলোও আমার কাছে কেন জানি এটেনশন সিকিং মনে হয়। একজন গ্রুপ লিডার হিসেবে উনার পোস্ট হওয়া উচিত ছিল মোটিভেশনাল বা ইন্ট্রাকশন-ইনফরমেশন বেইজড। কিন্তু আমি উনার যত পোস্ট দেখেছি সবখানে উনি হয় সমালোচকদের সংক্ষেপে "জবাব" দিয়েছেন নইলে বলেছেন "চট্টগ্রামের কে কে এক্টিভ" "এই গ্রুপে কাকে কাকে চেনেন ১০ টা আলাদা কমেন্ট করেন" "আপনার পণ্য নিয়ে আলাদা আলাদা ৫ টা কমেন্ট করেন"
উনার পোস্টে কমেন্ট হয় ৫-১০ হাজার। কমেন্টকারী নিজে ব্যতীত অন্য কেউ কারো কমেন্ট পড়ে বলে মনে হয় না। উনি নিজে নিশ্চয়ই ৫ হাজার কমেন্ট দেখেন না। তাহলে এভাবে এটেনশক সিক পোস্ট দিয়ে এত কমেন্ট করানোর মানে কী? কেনই বা একজনকে আলাদা করে ১০ টা কমেন্ট করা লাগবে? হয়তো কোনো মানে থাকতেও পারে। আমি আসলে জানি না।
গ্রুপ লিডার বা এডমিন মডারেটাররা প্রায়ই বলেন এই গ্রুপ একেবারেই অলাভজনক উদ্যোগ। এখানে পণ্যের প্রমোশনের জন্য এক টাকাও দিতে হয় না। কিন্তু আমরা এখন জানি সাপ্তাহিক অনলাইন আড্ডা নামে একটা আয়োজন আছে সেখানে এবং এই আড্ডায় জয়েন করার জন্য ৩০০ টাকা করে দিতে হয়। কেউ একজন হিসেব দেখিয়ে বলেছিলেন এসব আড্ডা থেকে গ্রুপ এখন পর্যন্ত আয় করেছে প্রায় ৯০ লাখ টাকা। গ্রুপের কয়েকজন এক্টিভ মেম্বার থেকে জেনেছি, টাকার পরিমাণ এত হবে না। চার ভাগের এক ভাগ হতে পারে। তাও এমাউন্টটা দাঁড়ায় প্রায় ২৫ লাখ টাকা।
একটা বৃহৎ প্ল্যাটফর্ম প্রোভাইড করার কারণে এই গ্রুপের ফাউন্ডাররা কিছু আর্থিক সুবিধা পেতেই পারেন। অনলাইন আড্ডা ঐচ্ছিক, ৩০০ টাকা একজনের জন্য খুব বড়ো কিছু না এবং যতদূর শুনেছি এসব আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা উপকৃত হয়ে থাকেন। এসব ফ্যাক্টর বিবেচনায় অনলাইন আড্ডার টাকা নিয়ে হাঙ্গামা করার সুযোগ কম।
কিন্তু গ্রুপ ফাউন্ডাররা ২৫-৯০ লাখ টাকার ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গিয়ে যেভাবে হাজী মহসিন ধাঁচের মহান সাজার চেষ্টা করেন, এইটা আমার কাছে ভালো লাগে না। প্ল্যাটফর্ম ও ট্রেনিং এর বিনিময়ে টাকা নেয়া ইস্যুটাকে ভালোভাবে স্বীকার করে নেয়া উচিত। গ্রুপের কিছু মেম্বার নিয়েও ঝামেলা আছে। "হাসপাতালে শুয়ে এক্টিভ আছি আপুরা" "স্বপ্নে *** স্যারকে দেখেছি" ধরণের পোস্ট মাঝে মাঝে দেখা যায়। এই গ্রুপের সবচেয়ে সফল ব্যবসায়ীর দুইটা পোস্ট পড়ে আমার কাছে উনাকে মানসিকভাবে অসুস্থ মনে হয়েছে। আরো আছে "অমুক আপু" "তমুক আপুর" সেল আপডেট। এর তার নাম বলে নিজেকে পরিচিত করা।
গ্রুপ নিয়ে আমার আপত্তি বা কনফিউশন এখানেই শেষ। কেউ যদি কাউকে সারাদিন স্যার স্যার ডেকে আনন্দ পায়, নিজের ব্যবসায় সুবিধা আদায় করে নিতে পারে...ডাকুক স্যার। আমার কাছে দৃষ্টিকটু লাগলেই কেউ তার ব্যবসায় লস ডেকে আনবে, এটা আশা করি কীভাবে? যাকে স্যার ডাকা হয় এই ভদ্রলোক গ্রুপে পিএম সেজে বসে থাকতে হয়তো পছন্দ করেন, আমার সেটা দেখতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। উনি মাঝ রাতে যদি "কে কে এখন হাই তুললেন কমেন্ট করেন" বলে পোস্ট দেন তাতেই বা আমি কী করতে পারি?
ভদ্রলোক এক মিলিয়ন এক্টিভ মেম্বারের একটা গ্রুপের হেড। হি ইজ জাস্ট এনজয়িং হিজ টাইম। আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারটা একেবারে অন্ধকারে হচ্ছে না। টাকা দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই এ ক্ষেত্রে খুশি। ট্রেনিং পারপাজে টাকা নেয়া হচ্ছে, অন্য কোনো ইন্টারেস্টের লোভ দেখানো হচ্ছে না। আমাদের কাছে খারাপ লাগলেও বলার কিছু নেই। অনলাইন বিজনেস বা নির্দিষ্ট গ্রুপের অনেক কিছু খারাপ দেখালেও, ক্রেতার ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকলেও, হাইপ মাঠে মারা যাবার পর অনেকের হাহাকার করা অবশ্যম্ভাবী হলেও এই অনলাইন বিজনেসের স্রোতকে স্বাগত জানানোর বিকল্প নেই।
আমাদের চোখের সামনে অনেক মানুষ স্বচ্ছল অবস্থা থেকে প্রায় রাস্তায় নেমে এসেছে। চক্ষুলজ্জায় এরা হয়তো কারো কাছে হাত পাততে পারছে না, তবে ঘরে একটু উঁকি দিলেই পরিবর্তনটা টের পাওয়া যায়। মানুষ চাকরি হারাচ্ছে, ব্যবসা গুটাচ্ছে, ফ্ল্যাট ভাড়া ছেড়ে টিনশেড ঘর খুঁজছে। সময়ের একদম তিক্ত বাস্তবতা এটা।
আমাদের দেশে জিরো থেকে সৎভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ খুব কম, নাই বললেই চলে। যে হাজার হাজার মানুষের মাথায় হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে পড়ল, এরা এখন কী করবে ভাবুন তো? কেউ কেউ বুদ্ধি বের করেছে অনলাইন ব্যবসার। ড্যাডি-মাম্মির মেয়েরাও এখন বাঁচার তাগিদে গরুর ভুঁড়ি পরিস্কার করে রান্না করছে। কোনোদিন মাছ বাজারে না যাওয়া ছেলেরা পাঙ্গাস মাছ বিক্রি করছে। মেডিকেল পাড়ার অভিজাত ছেলে মেয়েরা বিক্রি করছে মধু।
দৃষ্টিকটু লাগছে এক সাথে এত মানুষকে ব্যবসা করতে দেখে। এক সাথে এত মানুষ কেন করবে না? একই সময়ে কতজন রাস্তায় নেমে গেল এটা দেখবেন না? হ্যাঁ, স্বীকার করছি এদের মধ্যে অনেকেই আছে হুজুগে। খুব বেশি প্রয়োজন নেই অথবা কীভাবে কী করবে জানে না, তাও অন্যের দেখাদেখি শখের বশে নেমে গেছে ব্যবসায়। অনলাইন ব্যবসার হাইপ নেমে যাবে, এরাও হারিয়ে যাবে। কেউ কেউ বাটপারি করে। ২০ টাকার জিনিস ২০০ টাকায় বেচে। এই বাটপারির অর্ধেক দায়ভার কিন্তু ক্রেতারও। আমি কাপড় চিনি না, অনলাইন কেন, দোকানে গিয়েও কাপড় কিনতে ভরসা পাই না। এখন আমার মতো 'জ্ঞানী' যদি না চিনে না বুঝে যদি জিনিস কিনে ধরা খাই, তবে আমার দায় এখানে থাকবে না? যেটা নিয়ে আপনার ধারণা নাই সেটা কেন কিনবেন? আপনাকে কিনতে তো বাধ্য করছে না।
"আমি অমুক, কাজ করছি *** নিয়ে"- এই ট্রলগুলো দেখতে আর ভালো লাগছে না। ট্রল করা খুব অন্যায় হয়েছে সেটা বলছি না। তবে সবকিছুরই আসলে একটা মাত্রা থাকে। অমুক লোকটাকে স্যার ডাকা নিয়ে আপনি ট্রল করছেন, ভাবুন তো লোকটাকে একজন কেন হুদাই স্যার ডাকতে যাবে? কেন ঘন্টার পর ঘন্টা এক্টিভ থাকবে? এক সপ্তাহে ২০ টা পোস্ট দেবার পরেও যখন কোনো অর্ডার আসে না তখন একটা মানুষের মনের অবস্থা কেমন হয় বুঝেন? এরপরও যখন কেউ লেগে থাকে বুঝতে হবে তার প্রয়োজনটা অনেক বড়ো। এতগুলো মানুষের ভীড়ে যুদ্ধ করছে টিকে থাকার, সে ট্রল পাওয়া ডিজার্ভ করে না।
অনলাইন ব্যবসার যে স্রোত সেটার হাইপ বেশিদিন থাকবে না। অনেকে সুবিধা না করতে পেরে বিদায় নেবে। অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে, মিটে যাবে ব্যবসার দায়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কেউ কেউ চাকরি ফিরে পাবে, এই জিনিসে টাইম দেয়ার সময় থাকবে না। আগেও বলেছি বর্তমান হাইপে অনেকেই আছে একেবারে অপ্রয়োজনে এই স্রোতে শরীর ভাসিয়েছে। প্রচুর মানুষকে নিয়ে ট্রল করা যায়, মাঝে মাঝে করতে বাধ্য হতে হয়।
কিন্তু ভাই সবাই কী তাই? আমার পরিচিত যত মানুষ অনলাইন ব্যবসায় নেমেছে প্রায় সবাই বিপদে পড়েই এখানে এসেছে। কয়েকজনের কাছাকাছি থেকে দেখেছি এই কাজে তারা কতটা পরিশ্রম করে। উপরে কয়েকটা উদাহরণ দিলাম, বলেন তো এরা এসব করার বাইরে আর ঠিক কী করতে পারত? ট্রল খাবার ভয়ে না খেয়ে বসে থাকা বেটার ছিল?
ট্রল করেন, মজা নেন; ফাইন। কিন্তু এমন অবস্থায় ব্যাপারটাকে নিয়ে যাইয়েন না যেন একটা স্ট্রাগলার মানুষকে তার নিজের কাজ বা পরিচয় নিয়ে লজ্জায় পড়ে যেতে হয়। এই যে "আমি এই, করি সেই" এর জোয়ার, এসব ফেইস করে যারা এই কাজ করে পেট চালাচ্ছে এদের মানসিক অবস্থাটা কেমন হচ্ছে ভেবে দেখেছেন?
কেউ কেউ আছেন হুমকি ধামকির উপরে থাকেন। আমাকে কোনো বিজনেস গ্রুপে এড করলে আনফ্রেন্ড করে দিব, আমাকে নিজের পেজে লাইক দিতে বললে ফাটায়া ফেলব... ভাইরে ভাই, ফেসবুকে ফ্রেন্ড অপশন রেস্ট্রিক্টেড। ৫০০০ এর বেশি মানুষ নেয়া যায় না। আপনি কাউকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছেন বা কারো রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করেছেন এর মানে তার সাথে আপনার সামান্য হলেও স্বার্থগত একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। লোকটা আপনাকে একটা গ্রুপে এড করে ফেললে বা লাইক ইনভাইটেশন পাঠালে এত অফেন্ডেড হোন কেন?
একটা লাইক দিলে আপনার ফোন ফেটে যায়? একটা গ্রুপে এড হলে টাকা দিতে হয়? আপনার পছন্দ না হলে লাইক ইনভাইটেশন ডিক্লাইন করতে পারেন। গ্রুপ লীভ নিতে পারেন, আনফলো করতে পারেন। এই কাজ করতে সময় লাগে ২-৫ সেকেন্ড। ২-৫ সেকেন্ড সময় নাই আপনার হাতে? কী করেন আপনি? এত ব্যস্ততা আপনার? একজন যখন ব্যবসা শুরু করেছে এটাই তার ধ্যান জ্ঞান। সে যদি নিজের লিস্টের ফ্রেন্ড থেকেই একটা লাইক না পায়, একজনকে গ্রুপ মেম্বার হিসেবে না পায়, তো অন্যের লিস্ট থেকে লাইক আদায় করবে?
হ্যাঁ, ব্যক্তি হিসেবে আপনার স্বাধীনতা আছে। আপনি লাইক দিতে বা গ্রুপে এড হতে বাধ্য নন। যদি মনে করেন এই দুই কাজ আপনার পক্ষে অসম্ভব, তাহলে অনলাইন বিজনেস শুরু করা লোকগুলোতে আগেই আনফ্রেন্ড করে দিন। আপনার শান্তি, তারও শান্তি।
ট্রলের দুইটা পার্ট। সুস্থ ট্রল, অসুস্থ ট্রল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের ম্যাক্সিমাম ট্রলই অসুস্থ। বিশেষ গ্রুপ নিয়ে কিছু ট্রল আমিও এঞ্জয় করি। এদের কিছু কার্যকলাপ নিয়ে ক্লোজ সার্কেলে হাসাহাসি করি। কিন্তু ওপেন প্লাটফর্মে এসে পুরো অনলাইন বিজনেসকে এভাবে ট্রলের পাল্লায় আনার চিন্তা মাথায় আসেনি। সম্ভব হলে আপনার পাশে যে মানুষটা টিকে থাকার যুদ্ধ করছে তাকে সাপোর্ট দিন। সম্ভব হলে কিছু কিনুন। মাথায় আইডিয়া থাকলে সেটা দিয়ে হেল্প করুন।
কয়েকজনের দোষে সবাইকে আপনি কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন না। ট্রল করে কিছু হাহা রিয়েক্ট পাবেন। কিছুক্ষণ আনন্দে থাকবেন। কিছুটা সময় ভালো কাটবে। কিন্তু একটা সত্য জানেন কী? আপনার ট্রলের কারণে কারো এক বেলা ভাত জুটবে না। কিন্তু যারা এসব ট্রল হজম করে ব্যবসা করে যাচ্ছে, তাদের চেষ্টা ভাত যোগাচ্ছে। আপনার ট্রল একটা মানুষের জীবন বাঁচাবে না। কিন্তু আমি জানি, অনলাইন ব্যবসা অন্তত একটা মানুষকে আত্মহত্যা থেকে ফিরিয়ে এনেছে।
সবচেয়ে বড়ো কথা, আপনি যখন তামাশা করছেন, অন্যজন তখন কাজ করছে... কাজ। পার্থক্যটা জেনে নিন।
আমি জয়নাল আবেদীন, জীবনে টিকে থাকার নিমিত্তে যারা অনলাইনে সৎভাবে ব্যবসা করছেন তাদের প্রতি স্যালুট ও শুভ কামনা জানাচ্ছি।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন