বাঙালি বৃদ্ধরা পারতপক্ষে চায় না বৃদ্ধাশ্রমে যেতে, এর চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় বলে মনে করে। অথচ বিদেশে বৃদ্ধাশ্রম আছে প্রচুর পরিমাণে। এইসব বৃদ্ধাশ্রমের সাধারণ চেহারা নচিকেতার সেই বিখ্যাত গানের মতো এতো করুণ নয়..

(১) আমার ধারণা, টাকা-পয়সার দিক দিয়ে সলভেন্সি লেভেল ভালো আর সোশ্যাল সিকিউরিটি আছে, ফলে মেয়ে বিয়ে দিলে নিরাপদে থাকবে- এই একটা কারণ বাদে "প্রবাসী বাঙালি" জাতটাকে কেউ খুব একটা পছন্দ করেনা। 

এইটার একটা কারণ হতে পারে, অর্থনৈতিকভাবে ওই স্তরে পৌঁছোতে না পারা জনিত হিংসা, সাথে কিছু প্রবাসীর অহেতুক টাকার গরম দেখানো। ফলে, বিদেশিরা কতো খারাপ, তারা বিয়ে করে আর ছাড়ে, পঞ্চাশজনের সাথে শুয়ে বেড়ায়, মদ আর শুয়োর খায়, বিদেশে কামলা খেটে দেশে এসে ভাব নেয়, পারিবারিক মূল্যবোধ নাই- এই ধরনের কিছু বহুল প্রচলিত সান্ত্বনা, বিদেশে যেতে না পারা বাঙালি নিজেদের দিয়ে থাকে।

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি   

 

এই লেখা এইসব অভিযোগের একটামাত্র পয়েন্ট নিয়ে ডিসকাস করবে, পয়েন্টটা হচ্ছে- "বিদেশিদের পারিবারিক মূল্যবোধ নাই, তারা বাপ-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়, তাদের কোনো খবর নেয় না। ফাদার্স-ডে, মাদার্স-ডে - এইসব তৈরি হয়েছে একদিনের খাতিরে, নামকা ওয়াস্তে বাপ-মায়ের খবর নেয়ার জন্য।" 

একটা বড় সমস্যা হলো, বিদেশের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বাঙালির যা ধারণা, সেটা সাধারণত প্রবাসী বাঙালিদের মাধ্যমেই বিল্ড-আপ হয়। প্রবাসী বাঙালির সিংহভাগ, প্রবাসে আসে মূলত পয়সা উপার্জনের জন্য, সেই তাগিদে এরা বিদেশের মেইনস্ট্রিমের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগটা করে উঠতে পারেনা।

ফলে, প্রবাসের জীবনযাত্রা আসলে কেমন- প্রবাসী বাঙালির এই ব্যাপারে সত্যি সত্যি তেমন কোনো আইডিয়া নাই। নিজেদের কাজ আর নিজেদের সহকর্মীর বাইরে এদের মধ্যে বেশির ভাগই বিদেশের মেইনস্ট্রিম বা স্থানীয় কারো সাথে তেমন মেশে না। এইজন্য এরা নিজেদের সহকর্মীদের কথাবার্তার ওপর ভিত্তি করে পুরো দেশের একটা কাল্পনিক এবং অবাস্তব চিত্র তৈরি করে ফেলে, এবং ধরেই নেয় যে- পুরো দেশটাই মনে হয় এইরকম।

বলাই বাহুল্য, এগুলা অসম্ভব জেনারালাইজড কথাবার্তা। "সে তো ইয়োরোপে দেকিচি মশাই", বা "আমি জাপানে দেখেছি" - এইসব কথাবার্তা খুব বেশি বিশ্বাস করবেন না। সত্যি যে একেবারেই নাই এর মধ্যে তা না, কিছুটা সত্যি তো আছেই। তবে, পৃথিবীটা বিশাল বড়। একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে একটা সম্পূর্ণ দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভালো কোনো ব্যাপার নয়।

(২) বিদেশে বৃদ্ধাশ্রম আছে প্রচুর পরিমাণে। এইসব বৃদ্ধাশ্রমের সাধারণ চেহারা নচিকেতার সেই বিখ্যাত গানের মতো এতো করুণ নয়। 

আধুনিক বিশ্বে চাকরিসূত্রে, বাপ-মায়ের থেকে সন্তানের দূরে থাকাটা বেশ অবধারিত একটা ব্যাপার। এই দূরত্ব মাঝেমাঝে খুব কঠিন হয়ে যায়। আমি নিজে আমার বাপ-মাকে দেখিনা পাঁচ বছর হয়ে গেলো। আমার ইচ্ছা করে তাদের সাথেই থাকতে। নানা কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। কেউ কেউ বাপ-মায়ের সাথে থেকেও কাছাকাছি চাকরি যোগাড় করে ফেলতে পারে, আমি সেটা পারিনি। চেষ্টা করেছি, হয়নি।   

বিদেশে বিশাল সংখ্যক মানুষ এই পরিস্থিতির মধ্যে আছে। আপনার কি মনে হয় এরা মায়া-দয়াহীন? আপনার কি মনে হয় এরা বাপ-মায়ের সাথে দেখা করতে চায় না? অবশ্যই চায়। সম্ভব হয় না। বিভিন্ন কারণে সম্ভব হয় না।

আদিমকালে মানুষ এতো বেশিদিন বাঁচতো না। একটু বয়স হলেই রোগাক্রান্ত হয়ে বা পশুর আক্রমণে মরে যেতো। যেহেতু বয়স হলে শিকারের ক্ষমতা থাকতো না, তাই সমাজের কাছে তার আর কোনো গুরুত্বও থাকতো না। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি, সভ্যতার অগ্রগতির সাথে আমরা একটা বয়স্ক শ্রেণী পেয়েছি, যারা টেকনিক্যালি কোনো কাজে লাগে না। এরা সন্তান উৎপাদন করতে পারে না, অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে না। ফলে, প্রাণী হিসাবে এদের প্রয়োজনীয়তা শূন্য হয়ে যায়।

ফলে, এই বয়স্ক মানুষদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে একটা সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটে। মা-বাবার সাথে সন্তানের একটা মানবিক সম্পর্কের বিকাশ ঘটে, এক ধরনের ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। বাপ-মা সন্তানকে এমন মমতায় মানুষ করতে থাকে যাতে তারা যখন অক্ষম হয়ে যাবেন, সন্তান যাতে সেই সময়কার দায়িত্বটা নেয়। 

মাতৃস্নেহ, পিতৃমমতা ইত্যাদি যে বিষয়গুলোকে একেবারে ভালোবাসাময় করে মিডিয়াতে উপস্থাপন করা হয়, এর পিছের কার্যকারণটা অত্যন্ত সাধারণ। আমি তোমাকে খাওয়াচ্ছি, আমার বয়স হলে তুমি আমাকে খাওয়াবে- সিম্পল। যাতে কনফার্ম হয় যে তুমি আমাকে খাওয়াও, সে জন্যই এতো পিতা-মাতাভক্তি, এতো ভালোবাসা। সেজন্যই এতো কবিতা-নাটক-উপন্যাসের বায়েজীদ বোস্তামি আর দামোদর নদ পাড়ি দেয়া বিদ্যাসাগর। 

খুব কাঠখোট্টা নির্মম লাগছে তো শুনতে? লাগারই কথা। সহ্য করে যান, কারণ সত্যি এটাই। বাপ-মা আপনাকে ভালো না বাসলে তাদেরই বৃদ্ধ বয়সে কোনো উপায় থাকবে না। নিজেদের তাগিদেই সেজন্য তারা আপনাকে ভালোবাসবেন।

(৩) এখন, বৃদ্ধ বয়সের খাওয়া-পরা সংক্রান্ত যে ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তাটা, সামাজিকভাবে যদি আমরা এই চিন্তাটা দূর করে দেই, তাহলে চিত্রটা কেমন দাঁড়াবে? এই চিত্রটার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে বিদেশের বৃদ্ধাশ্রম। 

যেহেতু আজকের সভ্যতা তৈরি করে দিয়েছেন এই বৃদ্ধরাই, তাই সামাজিক সকল সেবা বৃদ্ধদের জন্য বিদেশে অত্যন্ত কম খরচে দেয়া হয়ে থাকে। নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা, অতি অল্প খরচে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত, বয়স্ক ভাতা- সবই তারা পান। এছাড়া, রিটায়ারমেন্টাল বেনিফিট হিসাবে ভালো এমাউন্টের একটা টাকা তাদের হাতে চলে আসে।

সুতরাং, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা- এই তিনটা মৌলিক চাহিদা নিয়ে তাদের কোনো ঝামেলা নাই। ফাইনাল চাহিদা বাসস্থান, আর সেটার অল্টারনেটিভই হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। রিটায়ারমেন্টের টাকা দিয়ে বৃদ্ধরা নিজেরাই বৃদ্ধাশ্রমের খরচ মেটান। 

বিদেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয় 

যেহেতু তাদের কোনো কাজ নাই, তো এইসব বৃদ্ধাশ্রমে থাকাটা তাদের জন্য নতুন একটা জীবন নিয়ে আসে। তারা সমবয়সী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছে পান। বৃদ্ধাশ্রমে শেষ বয়সে নতুন প্রেমকাহিনীর সূচনার বহু গল্প তো আপনারা শুনেছেন। নিজে একবার ভিজিট করলে দেখতে পাবেন, এখানে বুড়োরা নিজেদের যৌবনের আদিরসাত্মক গল্প করছে, একসাথে মদ্যপান করছে, বৃদ্ধারা একসাথে গসিপ করছে - মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো একটা পরিবেশ। 

এখন, এই সমবয়সী বন্ধুদের বাদ দিয়ে এই বয়স্করা যদি আপনার বাসায় থাকতো, এই আনন্দটা কি আপনি তাদের দিতে পারতেন? সারাদিন আপনি আর আপনার বউ থাকতেন কাজে, তারা কি সেখানে নিঃসঙ্গতাতেই আধমরা হয়ে যেতেন না? 

এসব বৃদ্ধাশ্রমে বয়স্কদের হেল্প করার জন্য ট্রেনিং দিয়ে সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত লোকেদের রাখা হয়, যারা এদের সার্বক্ষণিক সেবার দায়িত্বে থাকে। আপনি পারতেন সমপরিমাণ ধৈর্য্য নিয়ে এদের এই কোয়ালিটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে? সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে এগুলোর কোনোটাই নাই। আর নাই জন্যই, বৃদ্ধাশ্রম বিষয়টাকে এমন ভয়াবহভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বাঙালির সামনে যে, কোনো বৃদ্ধ পারতপক্ষে চায় না বৃদ্ধাশ্রমে যেতে, এর চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় বলে মনে করে। 

বাপ মায়ের সাথে থাকাটা আধুনিক বিশ্বে ক্রমশ কঠিন হয়ে আসছে। এই অবস্থায় আপনি মাতৃস্নেহ, পিতৃভক্তিকে আরও বেশি বেশি গ্লোরিফাই করলে কোনো লাভ হবে না, পারিবারিক মূল্যবোধের ঢাক পিটালে কোনোই লাভ হবেনা। পারিবারিক মূল্যবোধ, পেটের ভাত বা পরনের কাপড়- কোনোটাই যোগাড় করে না। 

বরং, বয়স্কদের জন্য হাই কোয়ালিটিসম্পন্ন বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করেন। যাদের অবদানে আজকের এই সভ্যতা, তাদের অবদানটাকে রিকগনাইজ করেন। এরপর দেখবেন, কোনো শালার ব্যাটার ক্ষমতা হবে না বাপ-মাকে জঙ্গলে ফেলে আসার, তারা নিজেরাই হেঁটে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবেন। 

(৪) ফাইনাল ওয়ার্ডস:

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, বিদেশে সত্যি সত্যিই কিছু সন্তান মা-বাপের কোনো খোঁজ-খবরই রাখেনা, সম্পর্কও রাখেনা, ফলে তারা মানসিক অবসাদে ভোগেন।

একটু কষ্ট করে খবর নিয়ে দেখবেন তো, এই বাপ-মায়েরা সন্তানের জীবনে একটা ন্যূনতম শ্রদ্ধার জায়গা কী কারণে তৈরি করতে পারলেন না? কী কারণে, কোন অপরাধে সন্তান এমন মানুষ হিসাবে তৈরি হলো যে, পিতা মাতার সাথে এমনকি কথা বলতেও তাদের অনিচ্ছা? 

ঢালাওভাবে সব সন্তান একেবারে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা- সেই দাবি করছি না, দুনিয়াটা হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস নারে পাগলা। পৃথিবীতে বহু খারাপ মা এবং খারাপ বাবা আছে। 

বৃদ্ধাশ্রম জিনিসটা মানুষের খারাপ-ভালোর তোয়াক্কা করে না। জীবনে যতো পাপই করে থাকেন, একটা ভালো কোয়ালিটির বিদেশি বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে আপনার কোনোই সমস্যা হবে না। নিজের ঘরে যে যত্ন পেতেন, এইখানে তার চেয়ে বেশিই পাবেন, কম পাবেন না। 

প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের খরচ তাদের নিজেদের যোগাড় করতে দেন। তাদের বিয়েতে অহেতুক ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ না করে নিজের জন্য বৃদ্ধাশ্রমের ভালো ব্যবস্থার পিছে খরচ করেন। আশা করি তাতে শেষ বয়সটা ভালো কাটবে।  

সন্তান বেঈমানি করতে পারে, বৃদ্ধাশ্রম বেঈমানি করেনা।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা