চোখের ভেতর স্বপ্ন থাকে স্বপ্ন বাঁচায় জীবনটাকে...
গানের কথাগুলো বাস্তব জীবনেও দারুণ সত্যি। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে তার আশার সমান বড় করে বানিয়েছেন, বেঁচে থাকতে শিখিয়েছেন। ছোট বেলায় আমরা যখন আট আনার নাবিস্কো লজেন্স খেতাম, তখন ওটা পাওয়াটাই ছিল খানিক স্বপ্নের মতো। এগারো টাকায় তিন গোয়েন্দা কেনা ছিল বিলাসিতা। অপেক্ষা করতে হতো, কবে কিনতে পারব। এক টাকার অরেঞ্জ আইসক্রিম, তেঁতুলের আচার ছিল আনন্দের আরেক নাম।
আমরা অল্পে তুষ্ট ছিলাম। রমজান এলে কী দারুণ উত্তেজনা! কে ক'টা রোজা রাখতে পারি সে নিয়ে দারুণ এক কম্পিটিশন হতো। শবে কদরের রাতে চলতো নামাজ আদায়ের হিড়িক। আমাদের আনন্দ হয়তো ওপরওয়ালাও হেসে হেসেই দেখতেন। বাবা কবে ঈদের জামা আর জুতো নিয়ে বাড়ি ফিরবে, তার জন্য এক নিস্তরঙ্গ অপেক্ষা। আনলেই লুকিয়ে ফেলা, যাতে বন্ধু বান্ধব দেখতে না পারে। ঈদ পুরোনো হয়ে যাবে যে!
আমাদের জীবনে কষ্টও ছিল। একটু বড় হতেই কৈশোরকালীন মানসিক পরিবর্তন যখন শুরু হয়, সেসময়ে আমরা আচমকাই কারো প্রেমে পড়ে যেতাম ডাংগুলি কিংবা কানামাছি খেলতে খেলতেই। খেলার ফাঁকে আড়চোখে দেখতাম, মুখ টিপে হাসতাম। গোপন ডায়েরিতে তাকে নিয়ে কত অজস্র স্বপ্ন সাজাতাম। সেই ডায়েরি নিয়ে ভয়ে ভয়েও থাকতাম। নির্দয় বাবা মায়েদের কাছে তখনো ছেলে মেয়েরা নেহাত বাচ্চাই! তাদের "প্রাইভেসি" বলে কোন শব্দ তখন খুব অপরিচিত ছিল।
সভ্যতা যত সামনের দিকে এগিয়ে গেল, নিষ্পাপ শৈশব আর সহজ জীবন যাপনের বিষয়টা আমরা কিরকম ভুলে গেলাম। ডিপ্রেশন নামক মানসিক ব্যাধি আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। কেউ জানলো না, বুঝতেও পারলো না, অথচ আমরা হারিয়ে যেতে থাকলাম। মুক হয়ে রইলাম অথচ বুকে চলল অনবরত চিৎকার। উচ্চাশা আর হতাশার বেড়াজালে আমরা বন্দি হয়ে রইলাম। আগে যেখানে ছিল বুক ভরা বাতাস, খোলা মাঠ, গল্পের বই, সেখানটা দখল করে নিল মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটার। যন্ত্র বোঝে না যন্ত্রণা, ভালোবাসার কথা কিংবা নির্দয়তার গল্প। যন্ত্রের পেছনে ছুটে চলা ছেলে-মেয়েগুলো আজ বড্ড ক্লান্ত। শারিরীকভাবে নয়, মানসিকভাবে।
হয়তো কোনদিন আর মাঠে বসে গল্প করার মুহূর্তগুলো আসবে না। পারিবারিক কোলাহলের দিনগুলো হয়তো শূন্যে ভেসে গেছে। সহজ আটপৌরে মায়েরা এখন সিরিয়াল দেখায় আর অন্য ভাবীদের সাথে গয়নার প্রতিযোগিতায় মত্ত। সন্তান নিয়ে প্রতিযোগিতা তো চলছে কবে থেকেই। চিঠি লিখে বুকপকেটে নিয়ে পাড়ার কোন বড় ভাই হয়ত আর দাঁড়িয়ে থাকবে না রাস্তায়। ভালোবাসার মানুষটির জন্য হয়ত অপেক্ষা করবে না কেউ।
তবু চাইবো, ডিপ্রেশন নামক শব্দটি একদিন মানুষ জয় করবে। মন খারাপের গানে অনেক শব্দ থাকলেও সেখানে থাকবে না আত্নহত্যা। আর কেউ নিজেকে পরাজিত ভাববে না, ভাববে না অচ্ছুৎ। কষ্ট আসুক, কান্না আসুক, আসুক বুক ফাটা আর্তনাদ। অবসাদ কিংবা আত্মঘাতী কোন সংবাদ আর না আসুক সংবাদপত্রের পাতায়। ডিপ্রেশন নামক জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাক পৃথিবী। ভালো থাকুক আমাদের ছেলে মেয়েরা।
ফিচার্ড ইমেজ- তাসলিমা বাবলী