বয়স এবং অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে থেকেও নিজেকে বরাবরই ওবামার পেছনে জায়গা দিয়েছেন বাইডেন, আগ বাড়িয়ে হিরো সাজতে যাননি। ওবামাও তাই তার বিশ্বস্ত বন্ধুর জন্য প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, যেটা আমেরিকান সংস্কৃতিতেই বিরল দৃষ্টান্ত...

মিশিগানের ডেট্রয়েটে জো বাইডেনের হয়ে যেদিন নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সিএনএনের ক্যামেরার সামনে সেদিনকার অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন কয়েকজন ডেমোক্র‍্যাট সমর্থক। মধ্যবয়স্ক একজন বলছিলেন, "গত চার বছর ধরে আমি ওদেরকে এত বেশি মিস করেছি, আজ এখানে একসঙ্গে দুজনকে দেখতে পেয়ে মনে হচ্ছে একটা টাইম ট্রাভেল করে ফেললাম বুঝি!" 

ওবামা-বাইডেন জুটিটা কত জনপ্রিয় ছিলেন আমেরিকানদের কাছে, এটা তার ছোট্ট একটা উদাহরণ। ডেমোক্র‍্যাটরা তো এই দুজনকে মিস করেছেই, সাধারন মার্কিন নাগরিক, যারা চার বছর পরপর ভোট দেয়া ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপে থাকেন না- তাদের কণ্ঠেও গত চার বছরে অজস্রবার শোনা গেছে ওবামা আর বাইডেনের স্তুতি। জুটি ছিলেন বটে তারা, মানিকজোড় বললে ভুল হবে না। যেন রামায়ণের রাম-লক্ষণ, কিংবা শোলের জয়-বীরু। 

২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য মনোনয়ন চেয়েছিলেন অভিজ্ঞ ডেমোক্র‍্যাট নেতা জো বাইডেন। এর আগে টানা দুই টার্ম রিপাবলিকান জর্জ ডাব্লিউ বুশ শাসন করেছেন আমেরিকাকে, আট বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা ডেমোক্র‍্যাটরা তাদের সেরা নেতাটিকেই মনোনীত করতে চাইছিলেন দলের ভেতর থেকে। বাইডেনের সঙ্গে দৌড়ে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন এবং বারাক ওবামাও। এরমধ্যে সাড়া জাগানো এক বক্তৃতা দিয়ে ওবামা নজর কেড়ে নিলেন সবার, ইতিহাস গড়ে কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণকে দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি দিলো ডেমোক্র‍্যাট ডেলিগেটরা। সেই ওবামা নিজের ফার্স্ট মেট হিসেবে বেছে নিলেন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ জো বাইডেনকেই, রাজনৈতিক জীবনে যিনি অজস্র ঝড়-ঝাপটা সামলেছেন। 

বাইডেন বরাবরই ওবামার পেছনেই থেকেছেন

পরের গল্পটা ইতিহাস রচনার। ওবামার হাত ধরে প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউজ দেখা পেলো কৃষ্ণাঙ্গ এক প্রেসিডেন্টের, আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে যে ঘটনাটা চিরস্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। জো বাইডেন হলেন ফার্স্ট মেট। পরের আট বছর দুজনে হাতে হাত ধরে আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, গোটা বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। ওবামার ছিল দুর্দান্ত কনভিন্সিং পাওয়ার, ক্যারিশম্যাটিক বাচনভঙ্গি। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছিল বাইডেনের ধুরন্ধর মস্তিস্ক, আর তিন দশকের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এসবের মিশ্রণে সাধারণ আমেরিকানদের মনে জায়গা করে নিলেন দুজনে। 

আট বছর ধরে ওবামার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর হয়ে ছিলেন জো বাইডেন। ওবামা তার ছেলের বয়েসী, অভিজ্ঞতায় তিনি যোজন যোজন এগিয়ে, কিন্ত প্রেসিডেন্টকে সবসময় প্রাপ্য সম্মানটা তিনি দিয়েছেন, পর্দার আড়ালে থাকাটাকেই পছন্দ করেছেন, যেখানে দরকার পরামর্শ দিয়েছেন, আগ বাড়িয়ে হিরো সাজতে যাননি কখনও। এমনকি ওবামার শেষ টার্মে, যখন মোটামুটি সবাই নিশ্চিত ছিল যে আগামীবার হোয়াইট হাউজের দৌড়ে ডেমোক্র‍্যাট পার্টি থেকে বাইডেনই লড়বেন- তখনও নিজের ইমেজ বানানোর বাড়তি কোন চেষ্টা করেননি। নিজেকে সবসময় ওবামার নিচেই রেখেছেন, অসম্ভব বুদ্ধিমান এই মানুষটার যোগ্যতাকে যথাযথ সম্মান দিয়েছেন। 

ওবামার সঙ্গে তার অসমবয়েসী একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ওবামা জানতেন, বাইডেনের সঙ্গে তার কোন প্রতিযোগিতা নেই, বাইডেন তাকে ছাপিয়ে যেতে চাননি কখনও। আর তাই পূর্ণ সম্মানটুকু বাইডেনও পেয়েছেন এই তরুণ তুর্কির কাছ থেকে। প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে দুজনের খুনসুটির অজস্র ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যায়, দেখলে মনে হয়, কিশোর দুই বন্ধু বুঝি মেতে আছে নির্মল আনন্দে।একজনের বয়স মধ্যচল্লিশ, অন্যজনের সত্তর পার হয়েছে- ভিডিও দেখে এই কথা বলার জো নেই। 

বাইডেনের প্রচারণায় ওবামা

এবার যখন ট্রাম্পের বিপরীতে ডেমোক্র‍্যাট পার্টি থেকে বাইডেনকে মনোনয়ন দেয়া হলো, বন্ধুকে জেতাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ওবামা। ফোন ব্যাংকিং করেছেন চুটিয়ে, ভোটারদের বাড়ির নাম্বারে ফোন করে বাইডেন-কমলা জুটিকে ভোট দেয়ার আহবান জানিয়েছেন প্রতিদিনই। সেসবের ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ভাইরাল হয়েছে ভিডিওগুলো। এটুকুতেই ক্ষান্ত থাকেননি, বাইডেনের হয়ে প্রচারণা চালাতে করোনা উপেক্ষা করেই রাস্তায় নেমেছেন, বাইডেনের জনসভায় গিয়ে তার সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন, বন্ধুর জন্য ভোট চেয়েছেন, ট্রাম্পের বিভিন্ন নীতির সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। 

সাবেক একজন প্রেসিডেন্ট দলীয় প্রার্থীর জন্য নিজেকে এভাবে উজাড় করে দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন- আমেরিকার রাজনীতিতে এটা বিরল দৃষ্টান্ত। কিন্ত ওবামা আর বাইডেনের সম্পর্কটাকে তো শুধু দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই। দুজনে ছিলেন হরিহর আত্মার মতো, ওবামা নানা সময়েই বাইডেনকে নিজের বড় ভাই হিসেবে সম্বোধন করেছেন। সেই ভাইয়ের জন্য যে ওবামা প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তাতে অবাক হবার কি আছে!

প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নেয়ার আগে আচমকা একদিন যখন বাইডেনকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম- উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন ওবামা, বিস্ময়ের চোটে কেঁদে ফেলেছিলেন বাইডেন। বাইডেন নিশ্চয়ই আরও একবার কেঁদেছেন, জয় নিশ্চিত হবার পর ওবামার ফোন পেয়ে। সেই আনন্দাশ্রু আমরা দেখিনি, কিন্ত কল্পনা করে নিতে কষ্ট হয় না। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা শেষে ন্যুন্যতম ব্যবধানের এই জয়ে যে ওবামারও দারুণ অবদান আছে, সেটা আমরা না জানলেও, বাইডেন তো জানেন...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা