ওবায়দুল কাদের ছবি তুলতে পছন্দ করেন, তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টেই সাড়ে দশ হাজারের বেশি ছবি আপলোড দেয়া হয়েছে! অপরাধীরাও এই সুযোগটা নিচ্ছে ভালোভাবেই, ইদানিং কেউ অপকর্ম করে ধরা পড়লেই দেখি ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তার ছবি ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে!

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইস্যুর অভাব হয় না কখনোই। একটার পর একটা ট্রেন্ড চলে, আমরা বিভক্ত হয়ে যাই প্রতি ইস্যুতে। আওয়ামী লিগ-বিএনপি, প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ অথবা ভারত-পাকিস্তান, প্রতিটা জায়গায় আমরা দ্বিধাবিভক্ত থাকি। তবে ইদানিং একটা জায়গায় এসে ফেসবুকে সব ঘরানার মানুষকে একত্রিত হতে দেখছি, সেটা আওয়ামী লিগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আপলোড দেয়া ছবি নিয়ে মজা করার বেলায়। 

ওবায়দুল কাদের এমনিতে সজ্জন টাইপের মানুষ, তার বড় একটা শখ হচ্ছে ফেসবুকে ছবি আপলোড দেয়া। দুই-তিন রকমের কমন পোজে ছবি তুলে প্রতিদিনই তিনি নিজের কাজের আপডেট দিয়ে থাকেন ফেসবুকে, কখনও হয়তো মিটিং করছেন, কখনও সচিবালয়ে কাজ করছেন, কখনও দলীয় কোন সভায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মত বিনিময় করছেন। তবে তার ফেসবুক পোস্টের মূল আকর্ষণ হচ্ছে তার নিজের ছবিগুলো, আর সেসব ছবির ক্যাপশন; তার 'চ্যালেঞ্জিং টাইম' ক্যাপশন তো ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল ফেসবুকে। এর আগে একবার চীন সফরে গিয়ে সুইমিং পুলে খালি গায়ের ছবি দিয়েও আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।

জাতীয় শোক দিবসের দিন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে কিছু ছবি পোস্ট করেছিলেন ওবায়দুল কাদের। সংসদ ভবন এলাকায় নিজের বাসভবনের ভেতরে–বাইরে ছবিগুলো তুলেছিলেন ওবায়দুল কাদের। কালো পাঞ্জাবি, এর ওপরে কালো কটি এবং সাদা পায়জামা পরা। সেটার ক্যাপশনে লেখা ছিল- ‘ট্রিবিউট টু বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট ২০২০’। কালো সানগ্লাস পরে বিভিন্ন ভঙ্গিমার এই ছবি দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সমালোচনার শিকার হয়েছিল, পরে তা সরিয়েও নিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।

প্রথম আলো মারফত জানতে পারলাম, ওবায়দুল কাদের জুতা, পোশাক-আশাক ও ঘড়ির ব্যাপারে বেশ শৌখিন। বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিহিত অবস্থায় নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে তিনি পছন্দ করেন। নানা ভঙ্গিমার ছবি তোলা ও ভিডিও করা জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকও নাকি আছে। এসব ছবি ওবায়দুল কাদেরকে জানিয়েই আপলোড করা হয়। তিনি সবকিছুর খবর রাখেন। প্রতিদিনই তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ১০/১২টা করে ছবি আপলোড দেয়া হয়, সেগুলো নিয়ে নেটিজেনরা মাঝেমধ্যেই মেতে ওঠে ঠাট্টা তামাশায়। গতকাল দেখলাম, ২০১৩ সাল থেকে এপর্যন্ত তার ভ্যারিফাইড ফেসবুক একাউন্টটিতে সাড়ে দশ হাজারের বেশি ছবি আপলোড দেয়া হয়েছে! সংখ্যাটাকে মোটামুটি অবিশ্বাস্যই বলা চলে। 

সাড়ে দশ হাজার ছবি আপলোড দেয়া হয়েছে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে

ওবায়দুল কাদের যেভাবে খুশি, যতটা খুশি ততটা ছবি আপলোড দিতে পারেন, এটা কোন ইস্যু না। নেটিজেনরাও সেই ছবিতে বিনোদন খুঁজে পেতে পারেন, ট্রল করতে পারেন- তাতেও দোষের কিছু দেখি না। তবে মনের ভেতর অজস্র প্রশ্ন জাগে, যখন সাহেদ-সাবরিনার মতো কালপ্রিট বা লুপা তালুকদারের মতো কিডন্যাপারদের ছবি দেখি ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে তো এমন অবস্থা হয়েছে, কেউ অপকর্ম করে ধরা পড়লেই দেখি ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সেই অপরাধীর ছবি ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে! 

ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা, শেখ হাসিনার পরে তাকেই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বললে ভুল হবে না (যেহেতু রাষ্ট্রপতির পদটা আমাদের দেশে আলঙ্কারিক)। এরকম ক্ষমতাশালী একজন ব্যক্তির সঙ্গে দুটো ছবি তুলে রাখতে পারলে যে কেউই জায়গায়-অজায়গায় পাওয়ার প্র‍্যাকটিসের সুযোগ পাবে, পুলিশের হাতে ধরা পড়লে নিজেকে 'ওবায়দুল কাদেরের আপনা লোক' হিসেবে পরিচয় দিয়ে ছাড় পাওয়ার চেষ্টা করবে। আর এই জায়গাটাতেই মন্ত্রীমশায়ের একটু সাবধান হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। 

ওবায়দুল কাদের সেলিব্রেটি লেভেলের মানুষ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে কাছে পেলে তার সঙ্গে ছবি তোলার জন্যে অনেকেই আবদার করবে- এটা স্বাভাবিক। কিন্ত যার সঙ্গে ছবি তুলছেন, সেই লোকটা ভালো কি মন্দ- এটা যাচাই করার দরকার আছে বৈকি। যদি যাচাই করা সম্ভব না হয়, তাহলে অপরিচিত লোকজনের মন রক্ষার জন্য তাদের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে পোজ দিয়ে না দাঁড়ানোই ভালো। কারণ এসব ছবি তার ইমেজের জন্যেই ক্ষতিকর। 

তবে ইমেজ নিয়ে তিনি খুব একটা চিন্তা করেন বলে মনে হয় না। ওবায়দুল কাদের একসময় বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীদের 'হাইব্রিড কাউয়া' উপাধি দিয়ে বলেছিলেন, এরা আওয়ামী লিগে ঢুকে দলের নাম খারাপ করছে। অথচ ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লিগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থাতেই রিজেন্ট সাহেদের মতো বাটপার একটা লোক আওয়ামী লিগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পেয়েছে, যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া হাজারটা অপকর্ম করেছে, সম্রাট-জিকে শামিমেরা ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে গেছে নাকের ডগায় বসে- এসবের দায় তো ওবায়দুল কাদের এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ফেসবুকে ছবি আপলোড দেয়ার সাথে সাথে এই বিষয়গুলোতেও একটু মনযোগ দিতে পারতেন তিনি, দেয়া উচিত ছিল। 

ওবায়দুল কাদের

প্রায় নিয়মিতই খবর আসছে, ব্রীজ কালভার্ট নির্মাণে অনিয়ম আর দুর্নীতির মচ্ছব বসেছে। যেখানে দরকার নেই সেখানেও ব্রীজ বানানো হচ্ছে, যেখানে পানির প্রবাহ নেই সেখানেও রাস্তা কেটে গর্ত করে কালভার্ট বানানো হচ্ছে, যাতে সরকারী টাকা মেরে খাওয়া যায়। কোথাও আবার কালভার্ট বানানোর বাজেট পুরোটাই তুলে নিয়ে ঠিকাদার আর জনপ্রতিনিধিরা মিলে বাঁশের সাঁকো বানিয়ে দিচ্ছেন! এসব দেখভালের দায়িত্ব ওবায়দুল কাদেরের মন্ত্রণালয়ের, পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে দুয়েকজন সাসপেন্ড হয়, সাময়িক একটা শাস্তি দেয়া হয় কাউকে, কিন্ত অপকর্ম থামে না তাতে। প্রোফাইলে নিজের ছবি আপলোড দেয়ার পাশাপাশি এসব অপকর্মের ব্যাপারে সরকার কি ব্যবস্থা নিচ্ছে, তদন্তের অগ্রগতি কতদূর- এসব আপডেটও জানাতে পারতেন তিনি, তাতে জনসম্পৃক্ততা বাড়তো বই কমতো না।

ওবায়দুল কাদেরের আপলোড দেয়া ছবিতেই আমরা দেখতে পাই, পনেরোই আগস্ট বা একুশে আগস্টে দলীয় নেতাকর্মীদের নিতে তারা শোক পালন করছেন, ধানমন্ডির বত্রিশ নাম্বারে বা বনানী কবরস্থানে ফুল দিচ্ছেন, অথবা দোয়া মাহফিলের আয়োজন করছেন। সেখানে সামাজিক দূরত্বের বালাই থাকে না, সবার মুখে মাস্কও থাকে না। করোনাকালে অন্তত তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার যে নিয়ম, সেটা মানতে দেখা যায় না কাউকেই। সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিটি যদি করোনা নিয়ে সিরিয়াসনেস না দেখান, তাহলে জনগন আর কোত্থেকে সিরিয়াস হবে করোনা নিয়ে? 

ছবি তোলা বা সেসব ছবি আপলোড দেয়াটা ওবায়দুল কাদেরের শখ, সেটা নিয়ে কারো কোন আপত্তি থাকা উচিত নয়। কিন্ত শখ পূরণের সাথে সাথে তার কাঁধে দায়িত্ব ও কর্তব্যের যে বিশাল বোঝাটা আছে, সেটাও যথাযথভাবে পালন করা প্রয়োজন। নিউজফিডে তার হাসিমুখের ছবি স্ক্রল করে একটু নিচে নামতেই যদি রাস্তা বা ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতির খবর পড়া লাগে, সেটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। 

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- প্রথম আলো

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা