যে বয়সে মেয়েদের ঘরের বাইরেও যাওয়া ছিলো মানা, সে বয়সেই তিনি শুরু করেছিলেন লেখালেখি। 'বেগম' পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত করেছেন সমাজ পাল্টে দেয়ার মত অজস্র সব কাজ!

দেশভাগের আগের সময় থেকে শুরু করে বর্তমানের প্রেক্ষাপট যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, উপমহাদেশে নারীদের সামাজিক অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে অনেকটাই। এটা মোটেও বলা যাবে না, নারীদের অবস্থানের এবং লিঙ্গ-সমতার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। তবে এটা ঠিক, সময় পাল্টেছে। দৃষ্টিভঙ্গিও। এবং ক্রমাগত পট পরিবর্তনও হচ্ছে সবকিছুর। এই যে সময় পাল্টানোর চলক, নারীদের স্বাবলম্বী করার প্রক্রিয়া; এগুলো শুরু হয়েছিলো গুটিকয়েক নারীর হাত ধরে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম এই তালিকার একেবারে প্রথমেই আসবে। এই তালিকায় আসবে নূরজাহান বেগমের নামও। যিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী সাংবাদিক।উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ঐতিহ্যবাহী ‘বেগম’-এর সম্পাদকও ছিলেন যিনি!

জন্ম চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে। প্রত্যন্ত গ্রাম বলতে যা বোঝায়, চালিতাতলী ছিলো সেরকমই এক গ্রাম। অবশ্য এ গ্রামে বেশিদিন থাকা হয়নি। নূরজাহানের বয়স যখন তিন বছর, তখনই গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে আসে পুরো পরিবার। তবে গ্রাম ছেড়ে  কলকাতায় চলে আসার গল্পটা একটু অন্যরকম। খুব অল্পবয়সে থাকতে নূরজাহান, যাকে ছোটবেলায় ডাকা হতো 'নূরী' নামে, পুকুরে পড়ে যান। গ্রামে পুকুর, ডোবা, খাল খুবই স্বাভাবিক এক বিষয়। বাচ্চারা সেখানে টুপটাপ পড়ে যায়, সেটাও অবাক করার মত বিষয় না। নূরীকে পরবর্তীতে পুকুর থেকে অক্ষত অবস্থায় তোলা গেলেও নূরীর বাবা ভয় পেয়ে যান। তিনি ভাবলেন, এরকম দুর্ঘটনা আবার ঘটতে পারে। তিনি পুরো পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে যেতে চাইলেন। আত্নীয়স্বজনেরা তখন বাধা দিলেন। একটা ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো পরিবার গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা কোনো কাজের কথা না। নূরীর বাবাও মেনে নিলেন আত্মীয়স্বজনের যুক্তি। কিন্তু কয়দিন পর নূরী আবারও দুর্ঘটনায় পড়লেন। এবার পড়লেন খালে। নূরীর বাবা আর ঝুঁকি নিলেন না। পরিবার নিয়ে চলে এলেন কলকাতায়।

১১নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটের একটি দোতলা বাড়িতে এসে থিতু হলো পুরো পরিবার। নূরজাহান বেগমের লেখাপড়া শুরু হয় মায়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। বাবার কাছে তিনি শেখেন আরবি। এরপর ভর্তি হন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে। এখান থেকে যান সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে।  ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। আই এ ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। এখান থেকেই তিনি আই এ, বি এ পাশ করেন। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই বাবা মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের কাছে সাংবাদিকতার তালিম নিয়েছিলেন। বাবা ছিলেন সেসময়কার বিখ্যাত 'সওগাত' পত্রিকার সম্পাদক। বাবার প্রত্যক্ষ সাহচর্যে সাংবাদিকতা'র 'অ আ ক খ' শেখা শুরু হয়। এরপর বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য 'সওগাত' পত্রিকা অফিসে বসতে শুরু করেন নূরজাহান। মেয়ের আগ্রহ ও নারীদের জন্যে মেয়ের কিছু করার আগ্রহ দেখে মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন পরবর্তীতে 'সওগাত' পত্রিকায় ‘জানানা মহল’ নামে মহিলাদের জন্য একটি বিভাগ চালু করেন। সেই বিভাগটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতেন নূরজাহান বেগম। এরপর বাবা পরবর্তীতে নারীদের জন্যে পুর্নাঙ্গ একটি পত্রিকাই খুললেন। নাম দিলেন- 'বেগম'।

নূরজাহান বেগম 'বেগম' পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন প্রথম থেকেই!

বেগমের প্রথম চার সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। এরপর সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন নূরজাহান বেগম। 'বেগম' পত্রিকায় লেখালেখি, আঁকাআঁকি করার জন্যে নারীদের উৎসাহিত করা হতো সবসময়েই। সে সময়কার প্রেক্ষাপটে 'বেগম' ছিলো নারীজাগরণের এবং নারীপ্রতিভা বিকাশের এক অসাধারণ মঞ্চ। অনেকেই নিয়মিত লিখতেন এই পত্রিকায়। এই পত্রিকার প্রকাশনার পেছনে নূরজাহান বেগমের পাশাপাশি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ও লেডি বেবোর্ন কলেজের নূরজাহান বেগমের সহপাঠীরাও নিরলস কাজ করতেন।

নূরজাহান বেগম; যিনি।আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সাথে 

নূরজাহান বেগম শুধু এই সাংবাদিকতার কাজেই থেমে থাকেন নি মোটেও। তিনি করেছেন আরো কিছু অসাধারণ কাজ। ছেচল্লিশ সালে কলকাতা যখন পুড়ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, তখন নূরজাহান বেগম ও আরো কয়েকজন নারী এগিয়ে এসে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন করেন। তাদের খাবার, চিকিৎসা, সুরক্ষার ব্যবস্থা করেন। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত এতিম শিশু ও বিধবাদের জন্যে গড়ে তোলা হয় ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মুসলিম উইমেন্স অ্যান্ড অরফানেজ হোম’। নূরজাহান বেগম ছিলেন এই হোমের সাধারণ সম্পাদক। বেগম ক্লাবের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন? ষাটের দশকে মেয়েদের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার জন্যে যে ক্লাব করেনি, এমন কোনো কাজ নেই, সে ক্লাবেরও  সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি বহুদিন।

জীবদ্দশায় বহু পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন, তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ।  নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্রের সম্মাননা, রোকেয়া পদক,  অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার, আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা সহ অজস্র স্বীকৃতি রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।

বাংলাদেশের প্রথম নারী সাংবাদিক অথবা নারী জাগরণের সক্রিয় কর্মী, যেটাই বলা হোক না কেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে, মানুষ হিসেবে নূরজাহান বেগম ছিলেন দুর্দমনীয়। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি 'বেগম' পত্রিকায় যুক্ত হন। মৃত্যুর সময়ে, ৯১ বছর বয়সেও তিনি এই পত্রিকার সাথেই যুক্ত ছিলেন। ছয় দশকের তাঁর যে সাংবাদিকতার গল্প, সে গল্পে বারবারই উঠে এসেছে নারীমুক্তি, নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে বড় হয়ে ওঠা, নারীদের সফলতার জন্যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। নূরজাহান বেগমের গল্পটা অথবা পুরো জার্নিটা তাই এক সংগ্রামকে কেন্দ্র করেই। যে সংগ্রামে তিনি ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সে হিসেবে তাঁর সাংবাদিক, সমাজ-সংস্কারক পরিচয়ের চেয়েও যে পরিচয় বড় হয়ে ওঠে-

তিনি ছিলেন এক অদম্য লড়াকু যোদ্ধা।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা