বাবা মারা যাওয়ার পর সংসার বাঁচানোর জন্যে বারো বছরের নূর ইনায়াত খান নেমে পড়েন যুদ্ধে। গোটা দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ। লেখক থেকে স্পাই, গেস্টাপো জেলখানা থেকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প... উত্থানপতনের এরকম গল্প শুনেছে কী কেউ আগে!

যুগে যুগে বহু দেশে নানারকম গুপ্তচর এসেছেন। যেসব গুপ্তচরদের জীবনের গল্পগুলো অদ্ভুত রকমের থ্রিলিং। এমন কোনো গুপ্তচর হয়তো এখন পর্যন্ত এই কমলালেবু সাইজের পৃথিবীতে আসেননি, যার গল্প একটু হলেও বিরক্তিকর লাগবে।সেরকমই একজন ছিলেন নূর ইনায়াত খান। যিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ গুপ্তচর। কাজ করতেন ব্রিটিশ সরকারের 'স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ (এসওই) নামের একটি গুপ্ত সংস্থায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম মুসলিম নারী গুপ্তচর হিসেবে তার গল্প যিনিই পড়েছেন, তার মনেই চিরকালের জন্যে গেঁথে গিয়েছে নামটি। জীবনের উত্থান-পতনের এরকম চমক খুব একটা দেখাও যায় না সচরাচর।

নূরের জন্ম ১৯১৪ সালে, রাশিয়ার মস্কোতে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছরেই। বাবা ছিলেন উত্তর ভারতের নামজাদা ক্লাসিক্যাল মিউজিশিয়ান ইনায়াত রেহমান খান, হায়দ্রাবাদের নিজাম যাকে খুশি হয় উপাধি দিয়েছিলেন 'তানসেন'। বিয়ে করেন মার্কিন মহিলা আমিনা বেগম'কে। এই দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে একজন ছিলেন- নুর। বাবার দিক থেকে আবার মহীশুরের শাসক টিপু সুলতানেরও বংশধর ছিলেন নূর। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বিপ্লব ও সাহসীকতার বিষয়টি যে রক্তেই ছিলো নুরের, সেটি বুঝতে পারা যায়।

নুরের বাবা ইনায়েত রহমান খান ক্লাসিক্যাল মিউজিক ছেড়ে একসময়ে সুফিবাদের দিকে আগ্রহী হন। নুরের জন্মের বছরেই পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে, সেখান গড়ে তোলেন সুফি সংঘ। ক্রমশ জমিয়ে বসেন প্রবাসে। বেশ সুখেই কাটছিলো দিন। সেখান থেকে একসময়ে পুরো পরিবার চলে আসে প্যারিসে। কিন্তু প্যারিসে যাওয়ার পর হুট করেই নেমে আসে দুর্বিপাক। ইনায়াত রেহমান খান বলেন, তিনি ভারত চলে যাবেন। তিনি ছিলেন খেয়ালী মানুষ। কখন কী করবেন, সেটা আগে থেকে বোঝা খুব শক্ত। পরিবারকে প্যারিসে ফেলে রেখে তিনি একাই চলে যান ভারতে। সেখানে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান তিনি। পুরো পরিবার বিদেশবিভুঁইয়ে অকূলপাথারের মধ্যে পড়ে যায়।

নূরের বয়স তখন মাত্র বারো। পরিবার সামলানো, বাকি তিন ভাই-বোনকে সামলানোর দায়িত্ব নূর নিজের ঘাড়ে তুলে নেন। হন্যে হয়ে কাজ খুঁজতে থাকেন। স্বামীর শোকে চলাফেরা করতে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন নূরের মা। তাই দেখাশোনা করতে হচ্ছিলো মাকেও। সঙ্গীতজ্ঞ বাবার মেয়ে হিসেবে নূর নিজেও ছোটবেলা থেকেই গানের চর্চা করতেন। বীণা বাজাতেন। লেখালেখিও করতেন। প্যারিসের শিশুতোষ পত্রিকা ও রেডিওতে নিয়মিত ছোট গল্প লিখতেন। গান, বীণা ও লেখালেখির সূত্রে টাকাপয়সা আসছিলো অল্প অল্প করে। পরিবার কায়ক্লেশে এগোচ্ছিলো। নূরের বয়স যখন ২৫,  তখন তার প্রথম শিশুতোষ ছোট গল্পের বই ‘টুয়েন্টি জাতক টেলস’ প্রকাশিত হয়।

গান, লেখালেখি নিয়ে তাঁর ছিলো তীব্র আগ্রহ

এরমধ্যেই হুট করে শুরু হয় যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে নূর ফ্রান্সে রেড ক্রসের নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। নূরের ছোট দুই ভাই-বোনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ছোট ভাই বিলায়াত যোগ দেন ব্রিটিশ নেভিতে, আর ছোট বোন ক্লেয়ার যোগ দেয় এটিএস (আর্মি টেরিটোরিয়াল সার্ভিস)-এ।

দুই ভাইবোন কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখলেও নূরের নার্সের চাকরী বেশিদিন বজায় রাখা সম্ভব হয়না। জার্মান সেনাদের আক্রমণ হয় প্যারিসের হাসপাতালে। পুরো পরিবারকে নিয়ে নূর পালিয়ে যান ইংল্যান্ডে। তবে ইংল্যান্ডে পালিয়ে গেলেও জার্মানদের উপর তাঁর তৈরী হয় তীব্র ঘৃণা। যার রেশ আমরা পাবো সামনেই। নূরের বিভিন্ন সব কর্মকাণ্ডে।

ইংল্যান্ডে গিয়েই তিনি যোগ দেন উইমেন’স অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্স (ডব্লিউএএএফ)-এ একজন রেডিও অপারেটর হিসেবে। এমনিতেই বেশ চৌকষ ছিলেন নূর। উইমেন'স অক্সিলারি এয়ার ফোর্সে কাজের দক্ষতা দেখিয়ে তিনি খুব অল্পসময়ের মধ্যেই সেখানে খ্যাতি অর্জন করে ফেলেন। এরপর আবেদন করেন স্পেশাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ (এসওই) তে যোগ দেয়ার জন্যে। এখানে ঘটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার গায়ে ভারতীয় রক্ত, তিনি কীভাবে ব্রিটিশদের সাথে একাত্মতা পোষণ করবেন, এমন একটি প্রশ্ন আসে ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে। তিনি সোজাসাপটা উত্তর দেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি ইংল্যান্ডের সাথেই আছেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ভারতের পক্ষেই থাকবেন। এইরকম দৃঢ় মনোবল ও সোজাসাপটা কথাবার্তার জন্যে নূরকে নিয়ে নেয়া হয় এসওই'তে।

এখানে চাকরী হওয়ার পরের বছরই তিনি ফ্রান্স চলে যান ও সেখানে “ম্যাডালিন” সাংকেতিক নাম নিয়ে 'ব্রিটেনের গুপ্তচর' হিসেবে কাজ শুরু করেন। খোদ প্যারিস শহরেই তার কাজের দায়িত্ব পড়ে। শুরুর দিকে তাকে নিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ঠিক নিশ্চিত হতে পারেননা। তার ক্ষমতাতেও ঠিক ভরসা ছিলোনা তাদের। মহিলা মানুষ কতটুকু ঠিকঠাকভাবে দায়িত্বপালন করতে পারবেন, তা নিয়েও সন্দেহ ছিলো। কিন্তু খুব অসাধারণভাবেই সব অনিশ্চয়তা, সন্দেহের সমুচিত জবাব দেন তিনি। নূর ছিলেন প্রথম কোনো ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী ওয়্যারলেস অপারেটর, যাকে নাৎসি অধিকৃত ফ্রান্সে স্পেশাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ছিলেন প্যারিস ও লন্ডনের মধ্যে সেই সময়ের শেষ রেডিও অপারেটরও। ছয়টি কেন্দ্র থেকে রেডিও অপারেশন চালনা করতেন তিনি। খুব অল্পসময়ের মধ্যে তিনি কর্তৃপক্ষের নেকনজরে চলে আসেন ভালোভাবেই।

নাৎসিরা বেশ শক্তপোক্তভাবেই দখল করে রেখেছিলো প্যারিসকে। সেখানেই, শত্রুদলের নাকের ডগায় বসে তিনি নাৎসিদের তথ্যগুলো পাচার করতেন নিয়মিত। যেটা ছিলো খুবই ভয়ঙ্কর এক কাজ। নূর অবশ্য ঠিকই সামলে নিচ্ছিলেন সব। নূর এক্ষেত্রে যে টেকনিকটা অবলম্বন করতেন, ব্যাগের মধ্যে করে রেডিও ট্রান্সমিশনের যন্ত্রপাতি নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন এখান থেকে ওখানে। যাতে করে তাকে ট্র‍্যাক করা সহজ না হয়। দুয়েকবার যে ধরা পড়েননি, তাও নয়। জার্মান সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েও নিজের বুদ্ধির জোরে প্রতিবারই বের হয়ে এসেছেন তিনি। সে সাথে তথ্যগুলোও পাচার করেছেন তিনি নিয়মিত।

নাৎসিবাহিনীর সাথে লড়েছেন তিনি সমানে সমানেই! 

গেস্টাপোর নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন আপনি, তাই না? আচ্ছা, না শুনলেও অসুবিধে নেই। আমি বলে দিচ্ছি। হিটলারের গোপন পুলিশ বাহিনীকে বলা হতো গেস্টাপো।গেহেইম স্টাট্‌সপোলিজেই, অর্থাৎ গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী ছিলেন তারা। এদের হাতেই একদিন ধরা পড়েন নূর। কেন ধরা পড়েছিলেন, তা নিয়ে ইতিহাস খুব একটা জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় এক নারীর বিশ্বাসঘাতকতার বলি হন নূর। গেস্টাপো পুলিশ তাকে গ্রেফতারের জন্য বিশাল ফাঁদ পাতে। সে ফাঁদেই ধরা পড়েন তিনি। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় প্যারিসে গেস্টাপোর সদরদপ্তরে। যদিও সেখানে অবস্থানরত আরো দুই বন্দীর সাথে মিলে পালানোর চেষ্টা করেন নূর। কিন্তু ধরা পড়ে যান। এরপর তাকে আবার জেলখানায় আটকে রাখা হয়।তিনি জেলখানা থেকে পরবর্তীতে আবার পালানোর চেষ্টা করেন। আবার ধরা পড়েন।

এরপর তাকে আর প্যারিসে রাখেনা গেস্টাপো পুলিশ। পাঠিয়ে দেয় জার্মানিতে। সেখানে শিকলে আটকে রাখা, নির্মম নির্যাতন সবই করা হয়। কিন্তু নূর তথ্য ফাঁস করেনি কোনো। এর কিছুদিন পর নূরকে পাঠানো হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে পৌঁছানোর সাথে সাথে নূরের বাকি সঙ্গীদের মেরে ফেলা হলেও নূরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। নিয়মিত নির্যাতন, মারধোর ও অত্যাচার চালানো হয়। তথ্য আদায়ের চেষ্টা চালানো হয়, কিন্তু কোনো তথ্যই আদায় করা যায় না তার থেকে আর।

১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, খুব ভোরবেলা। ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সবার ঘুম তখনও ভাঙ্গেনি। ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয় নূর ইনায়াত খান কে। মাঠের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে ঘাড়ের পেছন থেকে 'পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক' রেঞ্জ থেকে গুলির শব্দ সব নীরবতাকে ভেঙ্গেচুরে দেয়। মৃত্যু হয় ব্রিটিশ এই চৌকষ গুপ্তচরের। জানা যায়- মৃত্যুর আগে শেষ শব্দ তিনি বলেছিলেন। “Liberté”; “স্বাধীনতা”। ইতি ঘটে ত্রিশ বছরের এক ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ জীবনের।

ব্রিটিশরা তার অবদান ভোলেনি। লন্ডনের ব্লুমসবারি এলাকায় যে বাড়িটিতে তিনি থাকতেন, সেটিতে তাঁর স্মরণে স্থাপন করা হয়েছে একটি নীল ফলক। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো, ব্রিটেনে বিখ্যাত লোকজন যেসব বাড়িতে থাকতেন, সেগুলোতে সাধারণত এ নীল ফলক লাগানো হয়, যাতে করে মানুষজন ফলক দেখেই বুঝতে পারেন বাড়ির তাৎপর্য। ভারতীয় বংশোদ্ভুত কোনো নারীর জন্যে ব্রিটিশদের তরফ থেকে নীল ফলক লাগানোর ঘটনা এই প্রথমবার। এছাড়াও তাকে মরণোত্তর জর্জ ক্রস সম্মাননা অর্জন করা হয়। যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই সম্মাননা কেবল বিপদের মুহূর্তে অসীম সাহসীকতা দেখানো মানুষজনকেই দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি ক্রইক্স দ্য গ্যেরে সম্মাননাও অর্জন করেছেন। লন্ডনের গর্ডন স্কয়ার গার্ডেন্সে তার একটি ব্রোঞ্জ-নির্মিত আবক্ষ প্রতিমূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে। তার জীবনকাহিনি নিয়ে বইও লেখা হয়েছে।  শ্রাবণী বসু লিখেছেন; ‘স্পাই প্রিন্সেস : দ্য লাইফ অফ নুর ইনায়েত খান।' ধারণা করা হয় ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে ৫০ পাউন্ডের নোটেও থাকতে পারে স্পাই প্রিন্সেস নূরের ছবি, সম্মাননা হিসেবে।

নূর ইনায়াত খানের আবক্ষ ভাস্কর্য 

দৃশ্যকল্প ভাবা যাক একটা। সুন্দর সুখের এক সংসার। ঘরে সঙ্গীতজ্ঞ বাবা, মা, চার ভাইবোন। কী নির্মল এক শান্তির আচ্ছাদন। সে আচ্ছাদন আকস্মিক উড়ে যায় নির্মম ঝড়ে। লুটপাট হয় সব। সংসার বাঁচানোর জন্যে বারো বছরের এক মেয়েকে নামতে দেখি আমরা যুদ্ধে। গোটা দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ।মৃত্যুর শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চলে যে যুদ্ধ। লেখক থেকে স্পাই, গেস্টাপো জেলখানা থেকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প... বিধাতা মাঝেমধ্যে কিছু মানুষের ভাগ্যে এমন গল্প লিখে দেন, যে গল্পে অখণ্ড অবসর আসে মৃত্যুর পরে। এর আগপর্যন্ত পুরোটাই দাবানল। সেই দাবানলেই আমরা ক্রমাগত পুড়তে দেখি নূর ইনায়াত খান নামের এক মানুষকে।

সেটাই হয়তো ছিলো ভবিতব্য, সোজা বাংলায়; নিয়তি।
*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা