২০০৬- ২০১১ সাল পর্যন্ত সময়টা এই যুগের সেরা সময় ছিল। আমরা যারা নব্বুইয়ের জেনারেশন, তাদের জীবনের সবচেয়ে সুখকর স্মৃতির সাক্ষী হয়ে আছে এই সময়টা।
তখন লাইকের চেয়ে কমেন্ট বেশি পড়ত। এক 'অনিকেত প্রান্তর' চারবার শুনে তখন ঘন্টা গুণতাম। অর্ণবরা তখন গান-টান গাইতো। বাক্সে বাক্সে বন্দি থাকতাম। খালিদরা গাইতো, 'যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে এ হৃদয়, সে কিছু নয়।' হাবিব একটা অ্যালবাম বের করে বলেছিল 'শোন'।
আমরা সপ্তাহে ৫/৬ বার পুরো অ্যালবাম শুনে রিভিশন দিতাম। ওয়ারফেজ ছেড়ে আসা বালাম এরপর 'এক মুঠো রৌদ্দুর হাতে' এনে দিয়েছিল। আমাদের আঁধার ছিল, আমাদের অর্থহীন ছিল। ফাল্গুন বাসের পিছনের সিটগুলো আজও সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের সবার গলা ছেড়ে গাওয়া 'আমার এই অন্তর চায় শুধু যে তোমায়' গানের।
এক 'চাইতেই পারো' গান দুইবার গেয়েও অর্থহীন আমাদেরকে তৃপ্ত করতে পারে নাই। আমরা আরো চাইতাম। চাইতেই পারো গানের একশ'টা ভার্সন হলেও হয়তো আমরা সবগুলা শুনতাম তখন।
আরজে নুশরাত, সায়েম, কায়ানাথ, নীরব, রাজু, রনো, প্রত্যয়দের গলা মুখস্থ ছিল। টিভিতে তখন বাংলা নাটকের জয়জয়কার অবস্থা ছিল। ছেলে-মেয়ে-আংকেল-আন্টি নির্বিশেষে আমরা একসাথে বসে দেখেছি '৪২০' কিংবা 'হাউসফুল' এর মতো নাটক।
নাটকের ব্যানার বলতে আমরা বুঝতাম 'ফাহিম মিউজিক'। মিউজিক ভিডিওর ব্যানার ছিল 'জি-সিরিজ' আর 'অগ্নিবীণা'। নাটকের সব ডিরেক্টরদেরও আমরা চিনতাম তখন। ইশতিয়াক রুমেল, রেদোয়ান রনি, ইফতেখার ফাহমি, মুস্তফা কামাল রাজ, অনিমেষ আইচ, মেজবাউর রহমান সুমন আরো কত মাস্টারপিস ডিরেক্টররা তখন নাটক বানাতো।
মেজবাউর রহমান সুমনের একটা নাটক ছিল 'তারপরও আঙ্গুরলতা নন্দকে ভালোবাসতো'। আমার দেখা জয়া আহসানের জীবনের সেরা অভিনয় ছিল সে নাটকে।
আমাদের হানি সিং ছিল না। আমাদের স্টোয়েবলিস ছিল, দেশি এমসি ছিল... স্কিব খান ছিল... আমাদের 'আবার জিগায়' ছিল। 'আবার আবার জিগায়' ছিল... আমাদের 'পাখি পাকা পেপে খায়' ছিল... 'মলে গিয়ে চটপটি খেতে খেতে দেখা হয়ে গেল সেই মেয়ের সাথে'র মতো গান ছিল... আরো ছিল 'চল ধানমন্ডি ৯ নম্বর'।
ওয়ারফেজের লিজেন্ডারি সব গান একসাথে করে 'পথ চলা' নামের একটা অ্যালবাম আমরা রিলিজ হতে দেখেছি। বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নর্থ সাউথের ক্যাম্পাসে তখন তপুরা পড়ত। তাদের ব্যান্ডের নাম বাংলায় ছিল যাত্রী। ইংলিশে হতো yaatri. আমরা ইয়াত্রি বলেই ডাকতাম! তাদের গাওয়া 'একটা গোপন কথা' আমাদের মুখে মুখে ছিল। তারপর তপু গেয়েছে 'এক পায়ে নুপুর' কিংবা 'মেয়ে' গানগুলো।
আমাদের সময়ে D rock star ছিল। সেখান থেকে উঠে আসা শুভরা ছিল। ছিল নেমেসিস, রেডিওঅ্যাকটিভ। রেডিওঅ্যাকটিভের পলাশ একটা কালজয়ী গান গেয়েছে পরে। গান টার নাম 'মা'। তাহসান তখন গান গাইতো। ব্ল্যাক থেকে বেরিয়ে আলো নামের একটা গান গাইলো। আজকে আমরা যারা অভিনেতা তাহসানকে নিয়ে ট্রল করি, তাদের সবাইকে বুকে হাত দিয়ে স্বীকার করতে হবে আমাদের প্লে লিস্টে আলো গানটা খুব টপ লেভেলেই থাকতো।
ফুয়াদের ফ্রেন্ডস এন ফ্যামিলি। বণ্য আমি হিংস্র। উপলের তোর জন্য আমি বন্য। আরো কতশত গান বেড়িয়েছে ফুয়াদ প্রোডাকশন থেকে! ঢাকা শহরের বড় বড় মাঠগুলোতে তখন রেগুলার কনসার্ট হত। গান ভালো হলেও আমরা 'ভুয়া ভুয়া' বলে চিল্লাতাম।
আমরা বসুন্ধরা, আফতাব নগর আবাসিক এলাকার পিছনে বালুর মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি। স্কুল- কলেজ পালিয়ে ঘুরেছি পুরো ঢাকা। সৈনিক ক্লাব থেকে নর্থ টাওয়ার। বর্ষাকালে ডুবাইতে (গোসল করতে) যেতাম আশুলিয়ায়।
সেই প্রজন্মের আমরা এখন বড় হয়ে গেছি। আমাদের জীবনে ব্যস্ততা এসেছে। সেই দিনগুলো এখন আর নেই। ঢাকা শহরের বুকে আমাদের এখন একা একা লাগে। শিরোনামহীনের গানের মতো, একা পাখি বসে আছে শহরের দেয়ালে। কিংবা চেনা শহর চেনা রাস্তা, পরিচিত ঢাকা। ভেসে যাচ্ছি চোখে আলো জ্বেলে জাহাজীর মতো একা!