বন্ধুদের সাথে দেখা হয় অনেক অনেক দিন বাদে, তাও কয়েকটা মিনিটের জন্য। একসঙ্গে গিটারের তারে ঝড় তোলা হয় না, রাতবিরেতে ট্যুর প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়ার দিনগুলো কেড়ে নিয়েছে করোনা। আমরা থমকে গেছি, আটকে গেছি এক আবদ্ধ কোণে। সেই উচ্ছ্বাস, সেই চপলতা, সেই দুষ্টুমি, হাতে হাত রেখে হেঁটে বেড়ানো কিংবা বল পায়ে ছুটে বেড়ানো, সবই যেন আজ ধূসর স্মৃতি।
করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার এগারো দিনের মাথায় যখন জরুরী দরকারে বাসা থেকে বের হতে হলো, মনে হয়েছিল, ভুল করে বুঝি অন্য কোন প্যারালাল ইউনিভার্সে চলে এসেছি! রাস্তাঘাট-বাড়িঘর সব আছে আগের জায়গায়, শুধু মানুষ নেই, শহরজুড়ে নেই প্রাণের দেখা। উইল স্মিথের একটা হরর সিনেমা আছে, 'আই অ্যাম লেজেন্ড', সেখানে জোম্বিদের আক্রমণে শূন্য হয়ে যাওয়া পৃথিবীর শেষ মানব হিসেবে বেঁচে থাকেন নায়ক উইল স্মিথ। ফাঁকা এক অদ্ভুত ঢাকার বুকে নিজেকে সেরকমই কোন চরিত্র বলে মনে হচ্ছিল।
করোনাভাইরাস এই পৃথিবীটাকে বড়সড় একটা ধাক্কা দিয়েছে। আমাদের জীবনব্যবস্থা পুরোপুরি পাল্টে গেছে ক্ষুদ্র এই ভাইরাসের তাণ্ডবে। পৃথিবীর ইতিহাস-ঐতিহ্য-আচার এখন দুটো ভাগে বিভক্ত, করোনা পূর্ববর্তী পৃথিবী, আর করোনা পরবর্তী পৃথিবী। জন্ম হয়েছে 'নিউ নরমাল' নামের একটা শব্দের, নতুন স্বাভাবিকতা, যেটা ছয় মাস আগেও কেউ হয়তো কেউ ভাবতে পারতো না। মার্চের আট তারিখে যেদিন বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হবার খবরটা এসেছিল, সেদিনও কি কেউ ভাবতে পেরেছিল যে, পরের দিনগুলোতে মাস্ক পরে বাইরে বের হওয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখাটা প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে যাবে?
করোনা যে আমাদের লাইফস্টাইলকে বদলে দিয়েছে, তার ছোট্ট একটা নমুনা দেয়া যাক। আগে বাজার করার জন্য কাঁচাবাজার ছিল প্রথম পছন্দ, করোনা আসার পর থেকে সুপারশপে ছুটছি, কারণ একটাই- নিরাপত্তা। স্বপ্ন বা আগোরার সামনে লাইন ধরে দাঁড়াতেও বিরক্ত লাগছে না, সুপারশপের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়ানোটাও তো একটা নতুন অভিজ্ঞতা। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ক্রেতাকে একসঙ্গে তারা ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না, প্রত্যেক ক্রেতাকে ডিজইনফেক্ট করা হচ্ছে- এই দৃশ্য এখন চোখে সয়ে গেছে, কিন্ত পাঁচ মাস আগে কেউ এমন কথা বললে তাকে পাগল ভেবেই হেসে দিতাম।
রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার, বাইরে কোথাও আড্ডা দেয়ার স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে মন থেকে। বাইরের খাবারের জন্য মন আনচান করলেও ফুড ডেলিভারির মাধ্যমে আনিয়ে নিতে হয়, বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টই ডাইন-ইন সার্ভিস চালু করেনি এখনও। বন্ধুদের সাথে দেখা হয় অনেক অনেক দিন বাদে, তাও কয়েকটা মিনিটের জন্য। একসঙ্গে গিটারের তারে ঝড় তোলা হয় না, রাতবিরেতে ট্যুর প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়ার দিনগুলো কেড়ে নিয়েছে করোনা। সব ধরণের যোগাযোগ এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ার গলিতে বসেই করতে হয়, স্পর্শের তীব্রতাটাকে মিস করি ভীষণ।
কয়েকদিন আগে গুলশানের একটা সুপারশপে গেলাম বাজার করতে। যথারীতি ডিজইনফেক্ট হয়ে ভেতরে ঢুকেছি, এক বয়োজ্যেষ্ঠ ক্রেতাকে দেখলাম একজন বিক্রয়কর্মী একটা ট্রলি ধরে কিছু একটা বলছেন। নেগেটিভ মেন্টালিটিতে প্রথমেই মাথায় এলো, ট্রলির ব্যবহার নিয়ে কোন বচসা হচ্ছে কিনা। কোন সাহায্য লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য এগিয়ে গেলাম, তবে কাছে গিয়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখতে পেলাম। ট্রলির হাতলের একপাশে গোলাকার একটা বস্তু লাগানো আছে, এটা একরকমের জীবাণুনাশক কিট। গোলাকৃতির এই জীবাণুনাশক যন্ত্রটি ট্রলির এক প্রান্তে লাগানো থাকে। এটিকে হালকা চেপে ধরে হাতলের এক পাশ থেকে অন্যপাশে টেনে নিলেই মুহূর্তের মধ্যে হাতলটি জীবাণুমুক্ত হয়ে যায়। বৃদ্ধ ভদ্রলোককে অনেকটা সময় নিয়ে এই কিটের ব্যবহারটাই শেখাচ্ছিলেন সেই বিক্রয়কর্মী।
সুপারশপের তরুণটিই জানালেন, স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সেপনিলের পক্ষ থেকে ইউনিমার্ট, মিনা বাজার, স্বপ্ন, প্রিন্স বাজারের মতো সুপারশপগুলোতে এই জীবাণুনাশক কিট সরবরাহ করা হয়েছে, যাতে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতারা নিরাপদে থাকেন, এমনকি ভাইরাসবাহী কেউ যদি অজান্তেও কেনাকাটা করতে আসেন, তার হাতের স্পর্শের মাধ্যমে যেন অন্য কারো দেহে এই ভাইরাস না ছড়াতে পারে- এজন্যেই এই উদ্যোগ।
করোনাকালে আমরা অজস্র চমৎকার উদ্যোগ দেখেছি, মানবতার ডাকে মানুষকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি, আবার বিপরীত অভিজ্ঞতাও হয়েছে, করোনায় আক্রান্তদের প্রতি চরম অমানবিক আচরণের উদাহরণও তৈরি হয়েছে। বিদ্যানন্দের মতো প্রতিষ্ঠান নিজেদের উজাড় করে দিয়ে কাজ করছে, আবার অনেক জনপ্রতিনিধি ত্রাণের সামগ্রী লোপাট করার চেষ্টা করে গ্রেপ্তার হয়েছেন- ভালো মন্দ দুটো উদাহরণই আছে আমাদের সামনে।
তবে ব্যক্তিগতভাবে মুগ্ধ হয়েছি আমাদের কর্পোরেট সমাজের অজস্র মানুষের নানামুখী উদ্যোগ দেখে। অনেকেরই ধারণা, কর্পোরেটরা শুধু ব্যবসাটাই বোঝেন, লাভের চিন্তা ছাড়া তাদের মাথায় আর কিছু বোধহয় ঢোকে না। কিন্ত করোনার এই ক্রান্তিকালে কর্পোরেট জগতের অনেকেই যেভাবে আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সেটাকেও একটা 'নিউ নরমাল' ঘটনা বলা চলে। মিশন সেভ বাংলাদেশ নামে একটা প্ল্যাটফর্মই গঠন করে ফেলেছেন কর্পোরেটরা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। যারা সেই প্ল্যাটফর্মে নেই, তারাও নিজ নিজ জায়গা থেকে সাধ্যমতো করোনার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন, সেপনিলের এই উদ্যোগটাও এই লড়াইয়ের সেরকমই একটা অংশ।
কোথায় যেন আমরা হারিয়ে ফেলেছি নিজেদের। জীবনের রিস্টার্ট বাটনে কবে চাপ দিব, সে ভেবেই কাটছে মুহূর্ত। আমরা থমকে গেছি, আটকে গেছি এক আবদ্ধ কোণে। সেই উচ্ছ্বাস, সেই চপলতা, সেই দুষ্টুমি, হাতে হাত রেখে হেঁটে বেড়ানো কিংবা বল পায়ে ফুটবল নিয়ে ছুটে বেড়ানো, সবই যেন আজ ধূসর স্মৃতি। কবে ঠিক হবে সব কিছু? হবে কি আদৌ? প্রশ্নের উত্তর না পেতে পেতে আমরা বোধহয় এখন প্রশ্ন করাও ভুলে গেছি।
জীবন আর জীবিকার দ্বন্দ্বের কাছে হেরে গিয়ে আমাদের রাস্তায় নামতে হয়েছে, কিন্ত ভাইরাসের আগ্রাসন তো থামেনি। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া উপায় নেই কোন। 'নিউ নরমাল' এই পৃথিবীতে এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে আরও অনেকগুলো দিন, করোনাপূর্ব পৃথিবীর স্মৃতিচারণ করে। মাঝরাতে 'আগুনের দিন শেষ হবে একদিন' গান শোনাটাই সার হবে, আগুনের দিন কবে শেষ হবে, আদৌ হবে কিনা- সেই প্রশ্নের জবাব জানা নেই কারো!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন