"তুই নোয়াখালীর সিভিল সার্জন, কিন্তু আমাদের এমন কোনো বন্ধু নাই, বড় ভাই নাই, ছোট ভাই নাই যারা তোর এই ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে রক্ষা পাইছে। সর্বশেষ উদাহারণ ছোট ভাই শাহরিয়ার ফয়সাল। মিথ্যা অভিযোগে যারে তুই জেলে ঢুকাইলি, ঘুষ দেয় নাই বইলা তার ক্লিনিক বন্ধ করে দিলি..."

তিনি একজন সরকারী কর্মচারী, পদবী সিভিল সার্জন। নিজেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন তিনি। এজন্যেই তিনি হাসপাতালের মালিকদের কাছে ঘুষ দাবী করেন, ঘুষের টাকা না পেলে বিনা নোটিশে অন্যায়ভাবে সিলগালা করে দেন হাসপাতাল। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করান, হয়রানি করেন। নাম তার মমিনুর রহমান, নোয়াখালীর সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তবে তার কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি জানার পরে সেই দায়িত্ব কতটা জনগণের জন্য করছেন, আর কতটা নিজের জন্যে করছেন- এই প্রশ্নটা উঠবেই।

ডা. মমিনুর রহমান নিজ ক্ষমতাবলে নোয়াখালীর সেনবাগে ছয়টি বেসরকারী হাসপাতাল এবং ক্লিনিক সীলগালা করেছেন। সেটা তিনি করতেই পারেন, কেউ যদি নিয়ম নীতি না মেনে হাসপাতাল বা ক্লিনিক পরিচালনা করে, রোগীদের সাথে প্রতারণা করে, তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের এখতিয়ার একজন সিভিল সার্জনের আছে। কিন্ত যদি বিষয়টা এমন হয় যে, চাহিদামতো ঘুষ না পেয়ে একজন অসাধু সিভিল সার্জন আক্রোশের বশবর্তী হয়ে হাসপাতাল আর ক্লিনিক বন্ধ করে দিচ্ছেন নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে- সেটা বড়সড় ধরণের অন্যায়। নোয়াখালীতে সেরকমটাই ঘটেছে।

বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি হাসপাতাল হচ্ছে মনোয়ারা জেনারেল হাসপাতাল ও ডক্টরস পয়েন্ট, সেটির মালিক শাহরিয়ার ফয়সাল বলেছেন, ডা. মমিনুর রহমান পিএস খায়রুল আনাম সবুজ ও তার কার্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী আবু তাহেরের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকার ঘুষ দাবি করেছিলেন। এই দুজন শাহরিয়ারকে জানিয়েছিল, চাহিদামতো টাকা দিয়ে দিলে হাসপাতাল চালাতে কোন সমস্যাই হবে না, এমনকি ডাক্তার-নার্স ছাড়াও হাসপাতাল চালানো যাবে, কেউ ‘ঝামেলা’ করবে না। অনেক হাসপাতাল আর ক্লিনিকই নাকি সিভিল সার্জনকে এভাবে ‘ম্যানেজ’ করে চলছেন, সেটাও জানিয়েছে তারা।

সরকারি বিধি মোতাবেক যথাযথ অনুমোদনের মাধ্যমে স্থাপিত হাসপাতালের সকল নথিপত্র হালনাগাদ থাকার পরেও কেন ঘুষ দিতে হবে, এ প্রশ্ন করেছিলেন শাহরিয়ার ফয়সাল। তখন সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি এসব কথায় কান না দিয়ে করে ঘুষ দাবি করতে থাকেন।

শাহরিয়ার ফয়সাল অভিযোগ করেছেন, ঘুষের টাকা না পেয়ে সেদিন বিকেলেই তার হাসপাতালে আসেন মমিনুর রহমান। কাগজপত্র না দেখেই নার্স ও স্টাফদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন তিনি, সবাইকে সরিয়ে দিয়ে হাসপাতালের ফ্রিজের খুলে সেখানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করেছেন, সেটার ভিডিও ফুটেজ সংরক্ষিত আছে সিসিটিভি ক্যামেরায়। পরে মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ রাখার দায়ে হাসপাতালের মালিকের নামে মামলা হয়েছে। শাহরিয়ার ফয়সাল অভিযোগ করেছেন, পুরোপুরি ভুয়া এবং বানোয়াট মামলা এটা, মমিনুর রহমান নিজেই স্যাবোটাজ করে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছেন।

সিভিল সার্জন ডা. মমিনুর রহমান

তবে মমিনুর রহমানের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তারই সাবেক সহপাঠী অমি রহমান পিয়াল, যিনি নিজে সাংবাদিক, ব্লগার, অ্যাকটিভিস্ট, এবং যার সবচেয়ে বড় পরিচয় একজন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হিসেবে। অমি রহমান পিয়াল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মমিনুর রহমানের উদ্দেশে লিখেছেন-

“দোস্ত মমিন, তোর লগে আমার কোনো সমস্যা নাই। কখনও ছিলো না। বরং দারুণ সব স্মৃতি আছে সিলেটে আর চিটাগাংয়ে। তাই এইটাই স্বাভাবিক হইতো যে ব্যাপারটা নিয়া তোর সঙ্গে আমি সরাসরি আলাপ করতে পারতাম। বিষয়টা সলভ করতে পারতাম। কিন্তু যা শুনলাম, তুই সেই অবস্থা রাখোস নাই। ব্যক্তিগত লোভ এবং অর্থলিপ্সা তোরে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে তুই বন্ধুবান্ধবরেও পটেনশিয়াল কাস্টোমার হিসেবেই বিবেচনা করোস।

তুই নোয়াখালীর সিভিল সার্জন, কিন্তু আমাদের এমন কোনো বন্ধু নাই, বড় ভাই নাই, ছোট ভাই নাই যারা তোর এই ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে রক্ষা পাইছে। সর্বশেষ উদাহারণ ছোট ভাই শাহরিয়ার ফয়সাল। মিথ্যা অভিযোগে যারে তুই জেলে ঢুকাইলি, ঘুষ দেয় নাই বইলা তার ক্লিনিক বন্ধ করে দিলি।

এবং এইটা নতুন কিছু না। নতুন কোনো ঘটনা না। একসঙ্গে পাশ করা বন্ধুদের কাছে তুই সামান্য কাজের জন্য ঘুষ চাইতে দুইবার ভাবোস না। তোর যাইতে দেরী হইছে, নোমান ভাই ক্লিনিক উদ্ভোধন করে দিছে, সেটা তুই তালা মেরে দিছোস তোর জন্য অপেক্ষা না করায়। মাইজদিতে তোর তান্ডবে বিএমএ, স্বাচিপ পর্যন্ত রাস্তায় নামতে বাধ্য হইছে।

আমার জানা মতে এর আগে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ভাই এবং ওবায়দুল কাদের ভাইর সরাসরি হস্তক্ষেপে সমঝোতামূলক বৈঠকে তোরে সাবধান করে দেয়া হইছে। কিন্তু তুই থামোস নাই। মাইজদি ছাড়ছোস, পেরিফেরিতে ছড়াইয়া গেছোস। আবার লাইনম্যান রাখছোস ছাত্রলীগের কোন পোলা সবুজ নামের। সে তোর শিকারের জায়গা খুজে দেয়, আর তুই সিভিল সার্জনের পদ ব্যবহার কইরা ডাকাতি করোস। আবার বলোস ২০ লাখ টাকা খরচ কইরা পোস্ট নিছোস, টাকা উঠাইতে হইবো। এইটা কোনো কথা!

দোস্ত থাম। বহুত হইছে। ছয় সাত মাসে যা কামাইছোস এইগুলা দশ মিনিটে হাওয়া হইয়া যাবে। কিন্তু যে উপায়ে কামাইছোস তার জন্য ডাক্তার সমাজে আর মুখ দেখাইতে পারবি কিনা সেইটা নিয়া ভাব। দুদকে তোর আত্মীয় আছে, সচিবালয়ে কোন সেক্রেটারি এসিসটেন্ট সেক্রেটারি তোর আত্মীয়- এইগুলা কি এইরকম উড়াধুরা ধান্দাবাজির জন্য এনাফ মনে হয় তোর? তোর থিকা বড় বড় দুইনম্বর কি মাটিতে পরে নাই?

তো এখন তোর টার্ন। গোটা নোয়াখালী তোর বিরুদ্ধে এক হইছে। একজন মানুষও পাবি না তোর পক্ষে। কি লাভ হইলো এতো দূর্নীতি কইরা বল। ইজ্জত কি পাইলি। বরং পাছায় লাথি খাইয়া তোরে নোয়াখালী ছাড়তে হবে। এই লজ্জাটা আমাদেরও যে তোরে নিয়া গর্বিত হইতে পারলাম না...”

অমি রহমান পিয়াল তার সাবেক সহপাঠীর কর্মকাণ্ডে হতাশ। হতাশ আমরাও, যারা প্রত্যাশা করি, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদেরকে জনগনের সেবক হিসেবে ভাববেন, মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন, দেশের মানুষের ভালোর জন্যে কাজ করবেন। এই মানুষগুলো আমাদেরই কারো বন্ধু, কারো ভাই, কারো স্বজন। কিন্ত দেশ আর দশের মঙ্গলের জন্যে কাজ করার শপথ নিয়ে চাকুরীজীবন শুরু করা মানুষগুলো যখন কয়েক বছরের মাথায় সম্পদের পাহাড় গড়ার মিশনে লিপ্ত হন, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যান, তখন এই দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আর ইচ্ছে করে না। মমিনুর রহমানের মতো অসাধু লোকগুলো আমাদের স্বপ্ন দেখার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় বারবার। যতোই বানসুরি মোহাম্মদ ইউসুফ বা মাহবুব কবীর মিলনরা মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান না কেন, দিনশেষে হয়তো এই বাংলাদেশে মমিনুর রহমানেরাই দলেবলে ভারী।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা