বিবিসি সেদিন সংবাদের পরিবর্তে পিয়ানো মিউজিক সম্প্রচার করেছিল, কারণ সেদিন নাকি কোনো খবর ছিল না পৃথিবীতে! অথচ সেদিন বাংলাদেশেই এমন কিছু ঘটেছিল, যা আজও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে। কী সেটি?

"এই পৃথিবীতে কোনো ব্যাপারেই নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়, কেবলমাত্র মৃত্যু এবং কর ছাড়া।" ১৭৮৯ সালে বসে অসামান্য এই কথাগুলি লিখেছিলেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জন বাপতিস্তে লে রয় নামের এক ফরাসি চিকিৎসকের উদ্দেশে রচিত চিঠির এক পর্যায়ে। তখন সবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয়েছে, কিন্তু সেটি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় অনাগত দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ - সবাইকে কেমন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হবে, মূলত সে বিষয়টির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করতে গিয়েই এ কথাগুলি লিখেছিলেন তিনি। 

এদিকে আমরা জানি, যা কিছু অনিশ্চিত, যা কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত, এবং যা কিছু অভিনব, সেগুলো সবই সংবাদ। মানুষের প্রত্যাশায় ছিল না কিংবা মানুষ আগে থেকে পূর্বানুমাণ করতে পারেনি, এমন যেকোনো ঘটনাই সংবাদের মর্যাদা লাভের অধিকার রাখে। তাই মৃত্যু এবং কর ব্যতিরেকেও যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সংবাদমূল্য সম্পন্ন অসংখ্য ঘটনার ঘনঘটা দেখা দেবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী! 

সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, এমন যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, প্রতিদিন অজস্র সংবাদের স্রোতে কীভাবে হাবুডুবু খেতে হয় তাদেরকে। কোনটা ছেড়ে কোনটাকে তারা বেছে নেবেন, এবং ডেডলাইনের আগেই আদৌ তারা নির্বাচিত সংবাদগুলিকে পরিবেশনযোগ্য করে তুলতে পারবেন কি না, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যেতে হয় তাদেরকে। দৃশ্যত মনে হয় যে, পৃথিবীতে অন্য আর যে জিনিসেরই অভাব থাকুক না কেন, একটি জিনিসের ভান্ডার অফুরন্ত, কখনও শেষ হওয়ার নয়। সেটি হলো সংবাদ।

কিন্তু ভেবে দেখুন তো, এমন কোনো দিন যদি আসে যেদিন পৃথিবীতে কোনো সংবাদই সৃষ্টি হয়নি! এমনও কি সম্ভব? আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টিকে পুরোপুরি অসম্ভব বলেই মনে হবে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি দিন আসলেই এসেছিল।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল দিনটিতে কোনো সংবাদ প্রচারিত হয়নি

দিনটি ছিল ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। সেদিন বিবিসি রেডিওতে কোনো সংবাদই প্রচারিত হয়নি। বরং সংবাদের জন্য নির্ধারিত সময়ে ঘোষক একবার 'আজ কোনো সংবাদ নেই' বলেই অনুষ্ঠানের ইতি টেনে দিয়েছিলেন, এবং ওই সময়ে শ্রোতাদেরকে শোনানো হয়েছিল পিয়ানো মিউজিক! এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ওই দিনটি ছিল গুড ফ্রাইডে। আগেরদিন সন্ধ্যায় ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিবের দেয়া বিশেষ একটি সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে বাজারে যেসব খবর ভেসে বেড়াচ্ছে, সেগুলোকে আর কোনো মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হতে দেয়া যাবে না।

তবে তাদের জন্য একটি সুবিধা ছিল যে, ইস্টারের বন্ধের কারণে পরবর্তী কয়েকদিন কোনো সংবাদপত্রই প্রকাশিত হবে না। তাই তাদের জন্য কেবল বিবিসি রেডিওর কণ্ঠরোধ করাই যথেষ্ট ছিল। এদিকে বিবিসি রেডিওকে যেহেতু সরকার বিষয়ক এত বড় একটি সংবাদ প্রচার করায় বাধা দেয়া হলো, তখন বিবিসি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল যে সেদিন তারা অন্য আর কোনো সংবাদই প্রচার করবে না। তাই সেদিন সন্ধ্যা ৬.৩০ এর সংবাদে, যেটি শোনার জন্য ব্রিটেনের আপামত জনতা উৎকর্ণ হয়ে থাকত, তারা কোনো সংবাদই প্রচার করল না। 

এভাবে বলা যায় সংবাদমাধ্যমের উপর অযাচিত হস্তক্ষেপের প্রতি বিবিসি একটি নীরব প্রতিবাদই করেছিল সেদিন। অবশ্য এ বিষয়টি তারা নিজমুখে স্বীকার করেনি কোনোদিনই। বরং বরাবরই তারা দাবি করে এসেছে যে, আসলেই ওইদিন ব্রিটেন কিংবা পৃথিবীর আর কোথাওই উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর সে-কারণেই সংবাদের পরিবর্তে পিয়ানো মিউজিক প্রচার করেছিল তারা। 

সংবাদের পরিবর্তে পিয়ানো মিউজিক বাজিয়েছিল তারা

কিন্তু আসলেই কি তাই? ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল কি প্রকৃতপক্ষেই কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি? ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাব, ওইদিন আসলে সত্যি সত্যিই খুব বড় একটি ঘটনা ঘটেছিল, যা আজও ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে রয়েছে। এবং মজার ব্যাপার হলো, ঘটনাটি ঘটেছিল আমাদের বাংলাদেশেই। অবশ্য বাংলাদেশ তখন ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এই বাংলাদেশের চট্টগ্রামেই সেদিন মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে কয়েকজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশ ও সহায়ক বাহিনীর চট্টগ্রামে অবস্থিত অস্ত্রাগার লুন্ঠনের প্রয়াস চালিয়েছিল। এর কয়েকদিন পরই বিপ্লবীদের সাথে ব্রিটিশ সৈন্যদের সম্মুখসমরে যুদ্ধ হয়, এবং তাতে ৮০ জন সৈন্য ও এক ডজন বিপ্লবীর মৃত্যু ঘটে।

এছাড়া ওইদিন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটেছিল। সেটি হলো প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেতা ক্লাইভ রেভিলের জন্ম। তাই ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল যে কোনোক্রমেই ঘটনাবিহীন ছিল না, সে কথা বলাই যায়। তবে পাশাপাশি বিবিসিকেও বেনিফিট অব ডাউট দেয়াই যায়। ক্লাইভ রেভিল যে পরবর্তীকালে এত নামকরা অভিনেতা হবেন, তা আগে থেকে জেনে বসে থাকা কোনো সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়, জ্যোতিষীর কাজ।

আর তখনকার দিনে যেহেতু ইন্টারনেট বা স্যাটেলাইট ছিল না, তাই লন্ডন থেকে ৫,০৯৮ মাইল দূরে চট্টগ্রামে সেদিন রাতে ঠিক কী হচ্ছিল, সে খবর যথাসময়ে বিবিসির কানে না পৌঁছানোই স্বাভাবিক। তবে পক্ষে বিপক্ষে যত যুক্তিই থাক না কেন, এ কথা মানতেই হবে যে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সত্যি সত্যিই ছিল একটি 'রেড লেটার ডে'। এবং এরকম দিন যে ভবিষ্যতে আর কখনও আসবে না, সে ব্যাপারেও আমরা অগ্রিম নিশ্চয়তা দিয়ে দিতেই পারি। এক্ষেত্রে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যু, কর ও অনিশ্চয়তা বিষয়ক তত্ত্বকে আমলে নেয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা