এক মায়ের হার না মানা সংগ্রাম ও চার পিশাচের ফাঁসি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দিল্লির নির্ভয়া ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত চার ধর্ষকের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে অবশেষে, শান্তি পেয়েছে জ্যোতি সিং নামের সেই মেয়েটার আত্মা!
আমি জেগে আছি এই মুহূর্তটার জন্যে। আনন্দবাজার আর এনডিটিভিতে কিছুক্ষণ পরপর আপডেট নিচ্ছি। বাংলাদেশ সময় ভোর ছ'টা বাজে ঘটনাটা ঘটবে, আট বছরের অপেক্ষার অবসান হবে আজ, অবশেষে! ২০১২ সালের ডিসেম্বরের এক কালরাত্তিরে যে অমানুষগুলো দিল্লির ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির ভেতরে জ্যোতি সিং নামের তেইশ বছরের তরুণীটিকে ধর্ষণের পর নির্মম নির্যাতন করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল, সেই পাপিষ্টগুলোর সাজা হচ্ছে আজ। ভারতীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঝোলানো হবে চার নরপিশাচকে, ঢাকায় বসে আমি ঘড়িতে ঠিক ছয়টা বাজার অপেক্ষায় আছি...
১৬ই ডিসেম্বর, ২০১২। বন্ধুর সাথে সিনেমা দেখতে বেরিয়েছিল প্যারামেডিকেলের ছাত্রী জ্যোতি সিং। সিনেমা শেষ হতে হতে বাজলো প্রায় সাড়ে দশটা, দিল্লির বুকে এটা যদিও তেমন কোন বিষয় ছিল না। কিন্ত রেপ ক্যাপিটাল সেদিন ভয়ংকর এক বাস্তবতা নিয়ে অপেক্ষা করছিল জ্যোতি সিংয়ের জন্যে। বাড়ি ফেরার জন্যে বন্ধুটির সঙ্গে যে বাসে উঠেছিল সে, সেই বাসের ভেতরেই চালক-হেল্পার মিলে ধর্ষণ করেছিল তাকে, অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল তরুণী মেয়েটার ওপর।
এখানেই থেমে থাকেনি ঘাতকেরা, বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করার জন্যে যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল রড, পেটানো হয়েছিল জ্যোতির বন্ধুটিকে। তারপর দুজনের জামা-কাপড় খুলে আহত অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়েছিল চলন্ত রাস্তার ওপরে। ওদের গায়ের ওপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল ড্রাইভারের, কিন্ত কাছেই পুলিশের গাড়ি দেখে সেটা আর করতে পারেনি তারা। পুলিশ এসে উদ্ধার করেছিল জ্যোতি আর তার বন্ধুকে, মেয়েটা ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
হাসপাতালে যমে মানুষে টানাটানি চললো কয়েকটা দিন। উন্নত চিকিৎসার জন্যে জ্যোতিকে পাঠানো হলো সিঙ্গাপুরে। কিন্ত যে অত্যাচারটা হয়েছিল শরীরের ওপরে, সেটা নিতে পারেনি জ্যোতি। মৃত্যুর সাথে টানা তেরোটা দিন লড়াই করে অবশেষে হার মেনেছিল সে। ভারত ছাড়ার আগে একজন মহিলা পুলিশ অফিসার আর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘটনার জবানবন্দী দিতে পেরেছিল, পুলিশ অফিসারকে জ্যোতি অনুরোধ করেছিল, অপরাধীদের একজনও যাতে পার না পায়। চোখের জল আটকে রেখে জ্যোতিকে কথা দিয়েছিলেন সেই পুলিশ অফিসার।
সিঙ্গাপুরে জ্যোতি যখন শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করছে, ভারত তখন জ্বলছে দ্রোহের আগুনে, সেই আগুনের নাম নির্ভয়া! ভারতের মিডিয়া হাউজগুলো তখনও এখনকার মতো বিকিয়ে যায়নি, জ্যোতির নামটা তারা গোপন রেখেছিল, প্রতীকি নাম দেয়া হয়েছিল নির্ভয়া- যার অর্থ ভয় ডরহীন। জ্যোতি তো আসলেই ভয়হীন চিত্তে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে অপরাধীদের বিচার চেয়েছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছে। নির্ভয়া নামটাই তো তার জন্যে সবচেয়ে মানানসই!
দিল্লি থেকে কলকাতা, বেঙ্গালোর থেকে মুম্বাই কিংবা পাঞ্জাব থেকে মধ্যপ্রদেশ- সব জায়গাতেই শুরু হলো প্রতিবাদ, একটাই দাবী- ধর্ষকের গ্রেফতার চাই, সর্বোচ্চ শাস্তি চাই! ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বনিতা, সবাই নামলো পথে। পুলিশের জলকামানের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী, মার খেয়ে পিঠে দাগ করে ফেললেন অফিস ফেরত ভদ্রলোক। মার পড়ুক, তবু বিচার হোক। আজ নির্ভয়া বিচার না পেলে কাল আমার বোন, আমার স্ত্রী, অথবা আমার মেয়ের ওপর লোলুপ হাত পড়বে কোন ধর্ষকের, সেটা হতে দেয়া যাবে না! যন্ত্রর মন্তরের প্রতিবাদের ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো সুদূর যুবভারতী পর্যন্ত!
দিল্লি পুলিশ আর সিআইডি মিলে দ্রুতই গ্রেফতার করলো ছয় আসামীকে। এদের মধ্যে একজন আবার নাবালক, অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে, সেই নাবালকই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার চালিয়েছিল জ্যোতির ওপরে। মামলা শুরু হলো কোর্টে, সেটাই ছিল ভারতের ইতিহাসে ধর্ষণের ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে হওয়া প্রথম মামলা। নামে দ্রুত হলে কি হবে, কাজে শামুকের চেয়েও শ্লথ। তারিখ আসে, তারিখ যায়, ধীরগতিতে এগিয়ে চলে কাজ। শুনানি হয়, জ্যোতি সিংকে বেশ্যা হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে অপরাধীদের উকিল।
এরইমধ্যে জেলখানায় আত্মহত্যা করলো মূল আসামীদের একজন রাম সিং, ঘাতক বাসটির ড্রাইভার ছিল সে। কিশোর সংশোধনাগারে তিন বছর কাটিয়ে ছাড়া পেয়ে গেল নাবালক সেই ধর্ষকও। ভারতে নেটফ্লিক্স এলো, জ্যোতির ঘটনাটা নিয়ে তারা দিল্লি ক্রাইম নামের একটা ওয়েব সিরিজও বানিয়ে ফেললো। সবকিছুই হলো, হলো না শুধু বিচারটা। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে গেল মামলা, সেখান থেকে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করলো ধর্ষকেরা, কয়েক দফা ফাঁসির সময় পেছালো- অজস্র নাটকের সমাপ্তি পর্বে অবশেষে তিহার জেলে মঞ্চ প্রস্তুত, আজ ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে চার ধর্ষক মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত এবং অক্ষয় কুমার সিংহকে।
গত আট বছরে আমি একজন আটপৌরে গৃহবধুকে ইস্পাতকঠিণ দৃঢ়তা নিয়ে লৌহমানবীতে পরিণত হতে দেখেছি। তার নাম আশা দেবী, জ্যোতি'র মা তিনি। মেয়েকে অকালে হারিয়ে শোকে মুষড়ে পড়েছেন, কিন্ত মেরুদণ্ড ভেঙে যায়নি তার। বাজার-সদাই আর ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার বাইরে দিন দুনিয়া সম্পর্কে যার কোন খোঁজ ছিল না, সেই মহিলা গত আট বছর ধরে একটানা কোর্ট কাছারির চক্কর কেটেছেন, আজ হাইকোর্ট তো কাল সুপ্রীম কোর্টে দৌড়েছেন। মেয়ের ছবি আঁচলের তলায় নিয়ে প্রতিটা শুনানিতে গিয়েছেন, চোখের জল বাঁধ মানেনি কখনও, আদালতেই কেঁদে ফেলেছেন। তিনি তো মা, তার চোখের সামনে যখন তার মৃতা মেয়েটাকে বাজারের পণ্য বানানো হচ্ছিল, তখন তিনি সেটা সহ্য করেন কি করে?
আশা দেবীর অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়েছে আজ, অন্য কোন ভূবন থেকে জ্যোতি সিংও নিশ্চয়ই দেখছেন, তার ওপর হওয়া অন্যায়টার বিচার হচ্ছে অবশেষে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন সেই পুলিশ অফিসার এবং ম্যাজিস্ট্রেট, জবানবন্দী নিতে গিয়ে যারা জ্যোতিকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি বিচার পাবেন। তাকে দেয়া কথা তো রাখা গেছে! নির্ভয়া কাণ্ডের বিচারের দাবীতে ভারতের যতো মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন, পুলিশের মার খেয়েছেন, গরম জলের ঝাপটা সয়েছেন- আজকের এই রায় কার্যকরটা তাদের সবার জয়। জ্যোতিকে তারা নিজেদের মেয়ের আসনে, বোনের আসনে বসিয়েছিলেন, মেয়ের ধর্ষণ আর হত্যার বিচার দেরীতে হলেও পেয়েছেন তারা। সকালের চায়ে চুমুক দিয়ে টেলিভিশনে ফাঁসির খবরটা দেখতে দেখতে তাদের কেউ নিশ্চয়ই আজ 'জাস্টিস ডিলেড, বাট জাস্টিস ডান' টাইপের স্বগোতক্তি উচ্চারণ করতেই পারবেন...