
আপনার বয়স যদি হয় ২০ ছুঁই ছুঁই, কিংবা সদ্যই ২০ ছুঁয়েছে, তবে এই লেখাটি আপনারই জন্য।
২০ বছর বয়স। সম্ভবত একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় এটিই। অন্তত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তো অবশ্যই। খুব সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন আপনি। এর আগের ২০টি বছর আপনার জীবন একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল। স্কুল, কলেজে পড়েছেন। সবখানেই জীবনটি একটি নির্দিষ্ট, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ের ঘেরাটোপে বন্দি ছিল। এই প্রথম আপনি স্বাধীনভাবে, মনের আনন্দে নিজের জীবনটিকে পরিচালিত ও উপভোগের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু তাই বলে আনন্দের জোয়ারে ভেসে গিয়ে সবকিছু গুবলেট পাকিয়ে ফেলবেন না যেন। মনে রাখবেন, ছাত্রজীবনের আর বেশি কিন্তু বাকি নেই আপনার। এখন হয়ত আপনি জীবনের স্বর্নালি সময় পার করছেন, কিন্তু আর কয়েক বছরের মধ্যেই ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হবে আপনাকে। এবং সেই কর্মজীবনের শুরুটা মোটেই ফুল বিছানো হবে না আপনার জন্য। বরং জীবন যে কতটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন আপনি। কিন্তু সেই টের পাওয়াটাকেও একটি সহনশীল মাত্রায় রাখা যায়, যদি ২০ বছরের শুরুতেই আপনি নিজের জীবনটাকে নিজের মতো করে গোছাতে শুরু করে দেন।
কীভাবে করবেন? নিচের ৯টি কাজ করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এতে আপনার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি তো বদলাবেই, পাশাপাশি আপনার পরবর্তী গন্তব্য কোথায় এবং কেমন হবে- সেটিও হয়ত নির্ধারিত হয়ে যাবে।
১। মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন
এই বয়সটায় আপনি হয়ত আপনার শারীরিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব বেশি সচেতন। নিয়মিত শরীরচর্চা করে, ব্যালান্সড ডায়েট করে শরীরকে যথাসম্ভব ফিট ও আকর্ষণীয় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য একটি কাজ। তবে পাশাপাশি এটিও কিন্তু ভুলে যাবেন না যে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও সমান রকমের গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য কাজের চাপে নিজের মনের সুস্থতাকে অবহেলা করবেন না যেন। নিজের কীসে ভালো লাগে, মন ভালো থাকে- এসব ব্যাপারে আপনার হয়ে অন্য কেউ খেয়াল রেখে যাবে না, আপনার নিজেকেই খেয়াল রাখতে হবে। তাই প্রতিটি পদক্ষেপ খুব ভেবেচিন্তে নেবেন। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কাজ করার চেষ্টা বৃথা। বরং চেষ্টা করুন কাজটিকে ভালো লাগানোর কোন উপায় বের করা যায় কিনা। আর হ্যাঁ, অবসরে বন্ধু ও পরিবারের সাথে সময় কাটান। আপনার মনের সব কথা তাদের সাথে শেয়ার করুন, নিজেকে তাদের সামনে উজাড় করে দিয়ে মনটাকে হালকা করুন। মন ভালো রাখতে এর চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছুই হতে পারে না।
২। লক্ষ্য অর্জনে এখনই সচেষ্ট হোন
যেমনটি শুরুতেই বলছিলাম, আর কয়েক বছরের মধ্যেই আপনাকে কণ্টকাকীর্ণ কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হবে। এবং আজকের দিনে কেউ আপনার চেহারা দেখে, মামা-খালুর খবর নিয়ে, এমনকি আপনার একাডেমিক রেজাল্ট দেখেও আপনাকে বিচার করবে না। যেকোন সেক্টরে আপনার স্কিলই হবে আপনার সবচেয়ে বড় পরিচয়। তাই এখন থেকেই নিজের স্কিল বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করুন। এমন যেন না হয় যে কর্মজীবনে প্রবেশের পর আপনাকে নতুন করে সবকিছু হাতে কলমে শিখতে হচ্ছে। বরং এখন থেকেই নিজের স্কিল ডেভেলপ করুন। পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর আপনাকে বেকার বসে থাকতে হবে না। স্কিলের জোরে খুব দ্রুতই কোথাও না কোথাও কাজ জুটিয়ে ফেলতে পারবেন।
৩. ভ্রমণ করুন, এবং কখনো কখনো একদম একা
সারাদিন, সারা সপ্তাহ, সারা মাস, সারা বছর কত কাজেই না আপনাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। রুটিন মাফিক জীবন কাটাতে কাটাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনি হয়ত হাঁপিয়ে ওঠেন। তখন নিজের মনকে চাঙ্গা ও সতেজ করতে কোন না কোন একটি টনিকের অবশ্যই প্রয়োজন। ভ্রমণ হতে পারে আপনার সেই টনিক। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ুন অজানার উদ্দেশ্যে। নিজের দেশটিকে আবিষ্কার করুন। ভ্রমণে সাথে বন্ধুবান্ধব তো অবশ্যই নেবেন। তবে মাঝেমধ্যে একা একাও বেরিয়ে পড়তে পারেন। কারণ সেক্ষেত্রে নিজের দেশকে আবিষ্কারের পাশাপাশি আপনার সামনে সুযোগ তৈরি হবে নিজেকে আবিষ্কারেরও। এবং ঝালিয়ে নেবার যে অজানা পরিবেশে, অচেনা মানুষজনদের সাথে আপনি কেমন যোগাযোগ করতে পারেন। এটি পরবর্তী জীবনে আপনাকে অনেক সাহায্য করবে।

৪। বন্ধুদের সময় দিন
২০ বছর বয়স থেকেই হয়ত কাজের চাপে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আপনার মধ্যে একটি দূরত্ব সৃষ্টি হতে শুরু হবে। বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ রক্ষা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে একেবারে ভুলে যাবেন না যেন। কারণ বিপদের সময়ে ত্রাতা হয়ে আসবে কিন্তু এই বন্ধুরাই। যেকোন প্রয়োজনে এই বন্ধুদেরই পাশে পাবেন আপনি। তাই চেষ্টা করুন বন্ধুদের সাথে যথাসম্ভব যোগাযোগ রক্ষার। আর আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এটি তো কোন ব্যাপারই না। আপনি নিজেও জানেন আপনাকে কী করতে হবে। চাইলেই ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার ইত্যাদির মাধ্যমে সবার সাথে যোগাযোগ বহাল রাখতে পারেন। পাশাপাশি মাসে অন্তত একবার যদি সামনাসামনি দেখা করে সম্পর্ক ঝালিয়ে নেন, তাহলেই তো হলো!
৫। নিজের মতো করে বাঁচুন
নিজের মতো করে, স্বাধীনভাবে জীবন পরিচালনার মতো আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। এতদিন আপনি বাবা-মা, পরিবারে ছত্রচ্ছায়ায় মানুষ হয়েছেন। কিন্তু এখন আপনাকে নিজের মতো করে বাঁচতে শুরু করতে হবে। আর সেজন্য প্রথমেই আপনার যেটি প্রয়োজন, তা হলো নিজের খরচ নিজে চালানোর মতো সক্ষমতা। কারণ যতদিন অর্থনৈতিকভাবে আপনি পরনির্ভরশীল হয়ে থাকবেন, ততদিন কোনভাবেই নিজের স্বাধীন জীবন লাভ করা সম্ভব হবে না। আর তাই নিজের মতো করে মুক্ত আকাশে স্বাধীন বিহঙ্গের মতো ডানা ঝাপটানোও হবে না। তাই যদি চান নিজের মতো করে বাঁচার, নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্স ও প্রায়োরিটি দেয়ার, তাহলে শুরুতেই নিজের খরচ নিজে চালানোর যোগ্যতা অর্জন করুন। পড়ালেখার পাশাপাশি যেকোন একটি সম্মানজনক পেশাকে বেছে নিন, এবং কাজে লেগে পড়ুন।
৬। ভালোবাসুন, ভালোবাসা আদায় করে নিন
ভালোবাসা সবসময়ই মাল্টি ডাইমেনশনাল হয়। তবে ২০ বছর বয়সের মতো এতটা বোধহয় আর কখনোই নয়। এই সময়ে পরিবার, বন্ধুবান্ধবের ভালোবাসা তো আপনি পাবেনই, পাশাপাশি হয়ত বিশেষ এমন কাউকেও পেয়ে যাবেন, যার সাথে আপনি হাত ধরাধরি করে জীবনের বাকি সময়টা একসাথে পাড়ি দিতে চাইবেন। কিন্তু একটি কথা সবসময় মনে রাখবেন, অন্যকে ভালোবাসার আগে নিজেকে ভালোবাসা বেশি জরুরি। আপনি যদি নিজেকেই ভালোবাসতে না পারেন, তাহলে জেনে রাখবেন অন্যকে আপনি যে ভালোবাসা দিচ্ছেন, সেখানেও নির্ঘাত কোন না কোন খামতি রয়ে গেছে। তাই আগে নিজেকে ভালোবাসুন, তারপর প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসুন। বিনিময়ে তার কাছ থেকেও আপনি আন্তরিক ভালোবাসা আদায় করে নিতে পারবেন।
৭। নিজের প্রয়োজনের কথা মুখ ফুটে জানান
এই পৃথিবীটা যে কতটা স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক, এতদিনে সেটি নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন। তাই আপনি যদি আপনার প্রয়োজনের কথা মুখ ফুটে না জানিয়ে অপেক্ষায় থাকেন যে অন্য কেউ নিজে থেকে সেটি বুঝে যাবে এবং আপনাকে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসটির জোগান দেবে, তবে আপনি হয় বোকার স্বর্গে বাস করছেন্, নয়ত ঊটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু এখন সময় বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার। বাস্তবতাকে মেনে নিন, এবং সাহস করে নিজের চাহিদার কথাটি অন্যদেরকে জানান। প্রয়োজনে একটু জোর করে নিজের যেটা লাগবে তা আদায় করে নিন। আপনি নিজেই যদি আপনার প্রয়োজন মেটাতে সচেষ্ট না হন, অন্য কেউই আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না।
৮। খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করুন, সঠিক সঙ্গ বেছে নিন
খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করা ও সঠিক সঙ্গ বেছে নেয়ার উপদেশটি তো সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছেন। সেটি বিশোর্ধ্ব বয়সে এসেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে একটিই তফাৎ! তা হলো, এটিই আপনার জন্য শেষ সুযোগ। এর পর আর চাইলেও ভালো সঙ্গ বা মন্দ সঙ্গ বাছাইয়ের সুযোগ আপনার সামনে থাকবে না। তাই সময় থাকতেই সঠিক লোকদের সাথে বন্ধুত্ব শুরু করুন। এমন লোকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা শুরু করুন যাদের সাথে মিশলে আপনি মানসিক প্রশান্তিও যেমন পাবেন, তেমনি আপনার অনাগত ভবিষ্যতটিও মঙ্গলময় হয়। আপনি এখন এমন একটি বয়সে এসে দাঁড়িয়েছেন, যখন কখনো কখনো বন্ধুত্বেও স্বার্থ খুঁজতে হবে। আর হ্যাঁ, যেসব লোকদের সাথে মিশে আপনার কেবল সময় আর পকেটের টাকাই শুধু শুধু নষ্ট হচ্ছে, বিনিময়ে আপনার কোন লাভ হচ্ছে না, তাদেরকে আজ থেকেই এড়িয়ে চলতে শুরু করুন। এমন লোকদের সাথে মেশার মত বিলাসিতা করার সময় সেই কবেই গত হয়েছে!
৯। শেষবারের মতো নিজের মনকে চিনুন, জানুন, বুঝুন
সঠিক সঙ্গ বেছে নেয়ার মতো নিজের মনকে চেনা, জানা ও বোঝারও এটিই শেষ সুযোগ। এরপর আর সে সুযোগ কখনোই আসবে না। আর তখন হাপিত্যেশ করে মরলেও কোনো লাভ হবে না। এই বয়সটায় আপনি হয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, ক্যাম্পাসে বন্ধুবান্ধবের সাথে হাসি-আনন্দ-মজা করে, বা অন্য নানা কাজে মত্ত থেকে নিজেকে ভুলে আছেন। এদিকে সময় যে কোন দিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, আপনি টেরই পাচ্ছেন না। কিন্তু দেখতে দেখতেই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বছর কেটে যাবে। তখন গিয়ে যদি আপনার মনে হয় যে আপনি জীবনে যা চান, গত পাঁচ বছরে সে সংক্রান্ত কোন প্রস্তুতিই নিতে পারেননি, তাহলে সেটি হবে খুবই আফসোসের বিষয়। তাই সময় থাকতেই সচেতন হন। অন্যান্য কাজের ব্যস্ততার ফাঁকেও নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করে নিন, এবং সেই সময়টায় নিজের সাথে নিজে কথা বলুন, নিজের মন কী চায় তা জানার ও বোঝার চেষ্টা করুন।
একটু খেয়াল করে ভেবে দেখুন যে আপনি জীবনে যা চান, যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান, আপনি সেই সঠিক ট্র্যাকেই আছেন তো, নাকি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়েছেন। ভেবে দেখুন আপনি এই মুহূর্তে যে সকল কাজে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করছেন, ভবিষ্যৎ জীবনে সেগুলোর আদৌ কোন উপযোগিতা আছে তো? যদি থাকে, তাহলে তো ভালোই। কিন্তু যদি না থাকে, তবে কেন সেই কাজগুলো করছেন? স্রেফ ভালো লাগা থেকে? কয়েক বছর পর যখন জীবনের কঠিন বাস্তবতার সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন, তখন এই ভালো লাগাগুলো আর অবশিষ্ট থাকবে তো?