নেটফ্লিক্স: ডিভিডি সাপ্লায়ার্স থেকে বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নেটফ্লিক্সের দুই উদ্যোক্তা শুরু করেছিলেন খুব গড়পড়তা ভাবেই। সবার উৎসাহ, কম্পিটিশন আর শ্রেষ্ঠ হবার লড়াইয়ে তারা এমনভাবে নামলেন, সিনেমা হলকে মানুষের হাতের মুঠোয় নিয়ে এলেন; সেই গল্প শুনলে মুগ্ধতা শুধু বাড়বেই...
আমাদের একটা সময় ছিলো, যখন সিনেমার উৎস ছিলো একটিই; বিটিভি। আর ছিলো কিছু সিনেমাহল। যেগুলোতে যাওয়া হতো কালেভদ্রে। এরপর ভিসিডি প্লেয়ার, ডিভিডি প্লেয়ার এলো আমাদের জীবনে। প্রথমবার যখন বাসায় ভিসিডি প্লেয়ার আনা হলো, সে রাতে আমাদের কারোরই ঘুম হয় নি। সিনেমাকে ইচ্ছেমত থামাতে পারছি, সামনে নিতে পারছি, পেছনে নিতে পারছি, বিজ্ঞাপন নেই... নিজেদেরকে তখন অতিমানব মনে হচ্ছিলো কিছুটা।
সেই সব যুগ পেরিয়ে আস্তে আস্তে এলো অন্তর্জাল। সিনেমা দেখতে চাইলে আর সিডি কেনার ঝামেলা নেই। ইন্টারনেট, টরেন্ট থেকে ডাউনলোড করলেই হলো। এরপর মানুষ ডাউনলোড করার ঝামেলাকেও এড়িয়ে গেলো। সবাই এখন মুভি-সিরিজ স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে সাবস্ক্রাইব করে রাখে, নতুন কোনো সিনেমা অথবা সিরিজ রিলিজ করলে এখন শুধু সাইটে ঢুকে ক্লিক করলেই চলে! অনলাইন স্ট্রিমিং সাইট এর এই ধারণাকে জনসম্মুখে সর্বপ্রথম নিয়ে আসে একটি নাম- নেটফ্লিক্স। আজকাল হয়তো এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে নেটফ্লিক্স নিয়ে জানেনা অথবা যার নেটফ্লিক্সে একাউন্ট নেই। ১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া নেটফ্লিক্স এখন পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছে ১৯০টি দেশে। ১৫১ মিলিয়ন পেইড সাবস্ক্রাইবারও রয়েছে তাদের। অথচ গোড়ার দিকের জার্নিটা কিন্তু এত সহজ ছিলো না মোটেও।
টেক জায়ান্ট গুগলের পেছনে যেমন দুটি মানুষঃ ল্যারি পেইজ ও সার্গেই ব্রিনের অবদান বেশ ভালো করেই জানি আমরা, তেমনি নেটফ্লিক্স এর পেছনেও রয়েছে দু'জন মানুষের ভূমিকা। তাদের নিয়ে বলার আগে এটা জানা উচিত, অনলাইন প্ল্যাটফর্মটির নাম নেটফ্লিক্স কেন? এই শব্দে 'নেট' দিয়ে ইন্টারনেট বা অন্তর্জালকে বোঝায়। ওদিকে 'ফ্লিক্স' শব্দটি এসেছে ইংরেজি- 'ফ্লিক' থেকে৷ যার অর্থঃ মুভি। 'নেটফ্লিক্স' একত্রে বলতে তাই অনলাইনে সিনেমা পাওয়াকেই বোঝায়।
এবার আসি, নেটফ্লিক্সের পেছনের দুই মানুষের প্রসঙ্গে। রিড হ্যাশটিংস এবং মার্ক র্যানডল্ফ... এই দুইজন মানুষের হাত ধরেই ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করে নেটফ্লিক্স। হ্যাশটিংস বোডিন কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স' এর উপর পড়াশোনা করেন কিছু বছর। এরপর কিছুদিন সুইজারল্যান্ডের হাই স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে থাকেন। অনেকগুলো স্টার্টাপ করার পর শেষমেশ থিতু হন এই 'নেটফ্লিক্স' এ। দ্বিতীয় মানুষটি হলেন মার্ক র্যানডল্ফ। যিনি সিলিকন ভ্যালিতে ছিলেন অনেক বছর। ভালো ভালো স্টার্টাপে টাকা ইনভেস্ট, গ্রাউন্ড ওয়ার্ক ও এ্যাডভাইস করার কাজ করতেন তিনি। র্যানডল্ফ এর এই বিষয়ে একটা ইউএসপি ছিলো। খুব সহজেই কোনো একটা স্টার্টাপের কার্যকারিতা, কতটুকু যেতে পারবে সে স্টার্টাপ, এগুলো ধরতে পারতেন তিনি।
রিড হ্যাশটিংস এর কোম্পানি 'পিওর আটরিয়া'তে কাজ করতেন মার্ক, মার্কেটিং ডিরেক্টর হিসেবে। তখন সদ্যসদ্য হ্যাশটিংস এর মাথায় নেটফ্লিক্সের আইডিয়া এসেছে। একদিন নেটফ্লিক্স নিয়ে কথা বলার জন্যে রিড হ্যাশটিংস ডেকে পাঠান মার্ক'কে, তার অফিসের রুমে। মার্ক আসেন। নেটফ্লিক্সের কনসেপ্ট শুনে মার্ক বুঝতে পারেন- লম্বা রেসে খেলবে এই ঘোড়া। এরপর দুইজন মিলে শুরু করেন দক্ষযজ্ঞের কাজ!
প্রথমদিকে নেটফ্লিক্সের কাজ ছিলো খুবই গড়পড়তা। অনলাইনে কেউ কোনো মুভির অর্ডার করলে, তারা সেই মুভির ডিভিডি পাঠিয়ে দিতেন গ্রাহক বরাবর। ৪ ডলার দিতে হতো ডিভিডি'র জন্যে, সার্ভিস চার্জ দুই ডলার। আস্তে আস্তে যখন মডেলটি সাকসেস পাওয়া শুরু করলো, তারা তাদের কার্যপদ্ধতি আরেকটু উন্নত করলেন। সাবস্ক্রাইবার বেইজড মডেল চালু করলেন। অনলাইনে মুভি অর্ডার করলে খুব দ্রুতগতিতে ডিভিডি গুলো পাঠানো হলো ক্লায়েন্টের কাছে। তখন 'ব্লকবাস্টার' এর মতন জায়ান্ট ওয়েবসাইটও ছিলো, যারাও একই কাজ করতো। কিন্তু নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইবার, নেটওয়ার্ক ক্রমশ বাড়ছিলো। যেটি অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেয় ব্লকবাস্টারকে। অবশ্য 'ব্লকবাস্টার' এর গাফিলতিও সেজন্যে দায়ী। একটা ঘটনা শুনলে তা পরিষ্কার হবে। ২০০০ সালের দিকে নেটফ্লিক্স 'ব্লকবাস্টার'কে অফার দিয়েছিলো কোলাবোরেশানে কাজ করার জন্যে৷ ব্লকবাস্টারের সিইও মুচকি এক হাসি দিয়ে চলে গিয়েছিলেন সেদিন। জানি না, সেই ঘটনা ভেবে ব্লকবাস্টারের সেই সিইও এখন দুঃখ পান কী না। সেদিন যদি এই স্টার্টাপের সাথে কোলাবোরেশান করতেন, আজকে তাদের নামকেও সবাই সমানভাবে উচ্চারণ করতো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্লকবাস্টার কোলাবোরেশান করেনি। তারা হারিয়েই গিয়েছে। আর নেটফ্লিক্স! সেটা বলার কি দরকার আছে?
নেটফ্লিক্স কাজ শুরু করার এক বছর পরেই অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের দিকে পৃথিবীর প্রথম অনলাইন ডিভিডি রেন্টাল কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০০ সালের দিকে এসে অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তারা সাবস্ক্রাইবারদের জন্যে পার্সোনাল রিকোমেন্ডেশন অপশন চালু করে। যেটা সে সময়ে মানুষদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। ছয় বছরের মাথাতেই নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইবার হয়ে যায় ১ মিলিয়ন! এর এক বছর পরেই সাবস্ক্রাইবার হয়ে যায় ২ মিলিয়ন! এরপর আস্তে আস্তে শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া। প্রত্যেক বছরই মিলিয়ন মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার বাড়ছিলো। নেটফ্লিক্সও নিত্যনতুন জিনিসপত্র সংযোজন বিয়োজনের চেষ্টা করছিলো। ২০০৭ সালের দিকে এসে নেটফ্লিক্স প্রথমবার 'ভিডিও স্ট্রিমিং' অপশন চালু করে। হয়ে যায় অসাধারণ এক কনসেপ্ট। মানুষজন শুধু একটা ক্লিক করেই অনলাইনে মুভি, সিরিজ দেখবে... এই কনসেপ্ট আগে কেউ ভাবেওনি। এবং ভিডিও স্ট্রিমিং যে হতে যাচ্ছে 'দ্য নেক্সট বিগ থিং' এটাও বোঝা যাচ্ছিলো জোরেসোরেই। নেটফ্লিক্স এই 'ভিডিও স্ট্রিমিং' মডেলকে আঁকড়ে ধরে শক্তভাবে। আস্তে আস্তে ইন্টারনেট টিভি, ইন্টারনেট সাইট, আইওএস, এ্যান্ড্রয়েড সব প্ল্যাটফর্মে আসা শুরু করে তারা।
নেটফ্লিক্সের এই মডেলকে দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হন। এদের মধ্যে প্রথমেই আসবে 'অ্যামাজন প্রাইম' এর নাম। নেটফ্লিক্সের সাথে টেক্কা দেওয়ার জন্যে ৫০০০ সিনেমা ও টিভি সিরিজ নিয়ে চলে আসে অ্যামাজন প্রাইম। তবে তাতে নেটফ্লিক্সের খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। চল্লিশ মিলিয়নেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার নিয়ে নেটফ্লিক্স তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শাখা স্থাপন করছে। ইউরোপ, ইউকে, কানাডা সহ সবখানেই যাচ্ছে তারা। বিভিন্ন সিরিজের জন্যে পাচ্ছে প্রাইমটাইম এমি নমিনেশনও। এবং এটাও জানিয়ে রাখা ভালো, নেটফ্লিক্সই প্রথম কোনো অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট যারা 'প্রাইমটাইম এ্যামি' নমিনেশন পেয়েছিলো। 'প্রাইমটাইম এ্যামি অ্যাওয়ার্ড' সাধারণত টিভিতে প্রচারিত সিরিজগুলোর উপরে ভিত্তি করে দেয়া হয় সবসময়।
জয়রথ চলছিলো। ২০১৬ সালের দিকে এসে তাদের গোটা পৃথিবীর ১৯০টি দেশকে কানেক্ট করা হয়ে যায়। মোট ২১টি ভাষাতে তাদের প্রোগ্রামগুলোকে তারা ডেলিভারি করা শুরু করে। এবং এই বছরেই নেটফ্লিক্স তাদের ভিডিওগুলো ডাউনলোড করে অফলাইনে দেখার ব্যবস্থা চালু করে। ২০১৭ সালে এসে তারা প্রথম অস্কার জেতে 'দ্য হোয়াইট হেলমেটস' ডকুমেন্টারির জন্যে। এ বছরেই তারা গ্লোবালি ১০০ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারের মাইলফলক স্পর্শ করে। 'লা কাসা ডে পাপেল' 'ডার্ক' এর মত টিভি সিরিজগুলো আসে নেটফ্লিক্স এর সাইট থেকে। মানুষজন নেটফ্লিক্সে আরেকটু মজে যায়।
এভাবেই আস্তে আস্তে ক্রমশ এগোচ্ছে নেটফ্লিক্স। যদিও বিতর্ক আছে কিছু বিষয় নিয়ে। মানুষদের মনিটরিং করার জন্যে কেউ কেউ নেটফ্লিক্সকে একটু দোষারোপ করেন। তাছাড়া অ্যামাজন, ডিজনি, অ্যাপল অরিজিনাল... এই স্ট্রিমিং সাইটগুলো এসে নেটফ্লিক্সের কম্পিটিশন'কে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। সবগুলো স্ট্রিমিং সাইটই নিজেদের মতন স্ট্রাটেজি নিয়ে এগোচ্ছে সামনে। তাই প্রতিযোগিতা বাড়ছে ক্রমশই। তবে এক্ষেত্রে নেটফ্লিক্সও নিয়েছে ভিন্ন স্ট্রাটেজি। সবাই যেখানে ভিন্ন ভিন্ন সোর্স থেকে মুভি, সিরিজ নিয়ে এসে জড়ো করছে তাদের সাইটে, সেখানে দাঁড়িয়ে নেটফ্লিক্স ফোকাসে রাখছে তাদের অরিজিনাল কন্টেন্ট মেকিং কে। নিজেরাই সিনেমা, সিরিজ বানাচ্ছেন তারা। প্রচুর টাকাপয়সা তারা ইনভেস্টও করেছেন সেখানেই। এভাবেই আস্তে আস্তে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন তারা।
শুরু থেকে বিভিন্ন পরিবর্তন, উত্থানপতন, অসাধারণ চিন্তাভাবনা করে নেটফ্লিক্স আজকের এই অবস্থানে এসেছে, যেখানে তাদের বর্তমান সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১৮০ মিলিয়নেরও বেশি এবং নেট ক্যাপিটাল ২০৯.৭৪ বিলিয়ন ডলার! এরকম এক প্রতিষ্ঠান যে সামনেও থেমে থাকবে না, বরং অন্যরকম চিন্তাভাবনা করে আবারও এগিয়ে যাবে সবার থেকে, সেটা একরকম নিশ্চিতই।
সামনে আর কী কী চমক তারা দেখাবে, অপেক্ষা সেটির জন্যেই!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন