নেতাজির অন্তর্ধান; প্লেন ক্রাশ, টর্চার সেল অথবা গুমনামি বাবা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নেতাজির কথিত প্লেন দুর্ঘটনার পেরিয়ে গিয়েছে ৭৫ বছর। এখনো জানা যায়নি কীভাবে মারা গিয়েছেন তিনি। জাপান সরকার পাঁচটি গোপন ফাইল প্রকাশ করতে চেয়েও করেনি। ভারত সরকার সময়ে অসময়েই থামিয়ে দিয়েছে নেতাজির মৃত্যু নিয়ে তদন্তের কাজকর্ম। কিন্তু কেন? নেতাজির পেছনে লুকিয়ে রয়েছে কী এমন গুপ্ত তথ্য, যা এখনো তটস্থ করে রাখছে সবাইকে!
আমাদের অর্থাৎ বাঙ্গালীদের বরাবরই সুপারম্যানের অভাব। সিনেমার প্রভাবেই হোক আর যে কারণেই হোক, সব সুপারম্যানেরাই আবির্ভূত হন ঠিক আমেরিকাতেই। আমরা টিভি পর্দায় বা কমিকের বইতে তাদের সম্পর্কে জানি আর আক্ষেপে মরি; আমাদের কেন এরকম একজন সুপারম্যান নেই? যিনি সকাল-সন্ধ্যা গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীত, দুপুরে ঠেসে ভাত-মাছ খেয়ে ঘুম আর সুতির শার্টে শান্তির জীবন কাটাবেন না। যিনি হবেন ফাইটার, যার ব্যক্তিত্বে কাঁপবে দেশ-মহাদেশ, যার চেহারায় ঠিকরে পড়বে ব্যক্তিত্ব। এখন খুঁজলে হয়তো এরকম প্রবল পরাক্রমশালী বাঙ্গালী ঘরের ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তবে, হ্যাঁ, আমাদেরও একজন সুপারম্যান ছিলেন। তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, আজাদ হিন্দ ফৌজের লিডার, যিনি পরপর দু'বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও কংগ্রেসের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করে পদত্যাগ করেন।
মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গেও আদর্শগত সংঘাতের ফলাফলে যিনি বেছে নেন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ। রাজনৈতিক দল- ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করে যিনি শাসন করতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশদের। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যাকে এগারো বার জেলেও আটক রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যিনি লুকিয়ে ভারত থেকে চলে যান সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেখান থেকে জার্মানি ও জাপানে। ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা পাওয়ার জন্যে যিনি দাপিয়ে বেড়ান পুরো পৃথিবীতে। জাপানিদের সহযোগিতায় যিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। জাপানের সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মায়ানমার) যুদ্ধ পরিচালনা করেন যিনি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করার পেছনে যার ছিলো বিরাট অবদান। হিটলার সহ তৎকালীন অনেক ডাকসাইটে নেতার সাথে যার সম্পর্ক ছিলো ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে। এরকম একজন বাঙ্গালীকে সুপারম্যান না বলে কী বলা যায়, বলুন?
নেতাজীর জন্ম, তাঁর উত্থান বা তাঁর কাজকর্ম নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে আগে-পরে। সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা আজ না বলাই তাই সমীচীন। আজকের কথাবার্তা এক রহস্য নিয়ে। যে রহস্য ভেদ হয়নি আজও। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ বা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর মত যে রহস্য আজও কিংকর্তব্যবিমুঢ় করেছে তাবড়-তাবড় বুদ্ধিজীবীকে। অনেকবার যে রহস্য উন্মোচন করতে চেয়েছে অনেকে, কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তাদের থামিয়ে দেয়া হয়েছে। স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আজকে কথা বলবো সেই প্লেন দুর্ঘটনা নিয়ে। যে প্লেন দুর্ঘটনা ঘটেছিলো, আজ থেকে ঠিক পঁচাত্তর বছর আগে, এই দিনটিতেই। যে প্লেন দুর্ঘটনা অনুযায়ী নেতাজীর মৃত্যু হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়েছিলো কিছুদিন। এরপরেই আসতে থাকে একের পর এক মারাত্মক তথ্য। একাধিক থিওরি দাঁড়িয়ে যায় নেতাজীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। কোনটি ঠিক, কোনটি ভুল... গোলকধাঁধার মহাসড়কে দাঁড়িয়ে যার সমাধান হয়নি আজও। নেতাজীর মৃত্যু তাই দীর্ঘ ৭৫ বছর পরে এসেও রহস্যের কৌটায় খুব যত্ন করে রাখা দিদিমার আমসত্ত্ব!
ক্যালন্ডারে সেদিন ১৮ আগস্ট, সাল ১৯৪৫। সময়টা একটু প্রতিকূল। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে গিয়েছে জাপান। তাদের মনোবলও গিয়েছে কমে। এরকম সময়ে সুভাষচন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংকক হয়ে সাইগনে পৌঁছালেন। যাবেন মঞ্চুরিয়া। যাওয়ার পথে জাপানের তাইপেই-র তাইহোকু বিমানবন্দরে কিছুক্ষণ কাটালেন তিনি। খাওয়াদাওয়া করলেন। সবার খোঁজখবর নিলেন। তাঁর এই মিশন টা খুব সিক্রেট। অনেকেই জানেন না। লুকিয়ে-চুরিয়ে করতে হচ্ছে সব। সবকিছু ঠিকঠাকই উতরে যাচ্ছিলো। কিন্তু সমস্যা একটা দেখা দিলো। মাঞ্চুরিয়া যে যাবেন, বিমানবন্দরে বিমান নেই একটাও। শেষমেশ তথ্য-তালাশ করে একটা বোমারু বিমান পাওয়া গেলো। নেতাজিকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। তিনি এই বোমারু বিমানে ওঠারই প্রস্তুতি নিলেন। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাতে এলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের যেসব সেনা, তাদের সাথে কথাবার্তা, করমর্দন সেরে তিনি প্লেনে উঠলেন। বিমানে নেতাজি, তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী এডিসি হাবিবুর রহমান, কাছের কিছু বিশ্বস্ত মানুষ, আর ক্রুসহ মোট মানুষ ১৪ জন।
পাইলটের পেছনের আসনে বসলেন তিনি। যদিও তাকে সামনের আসনে বসতে বলার অনুরোধ করা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি বসেননা। কারণ তাঁর মত লম্বা মানুষের অনুপাতে কো-পাইলটের আসন বেশ ছোট। তিনি তাই পেছনেই থাকেন। তাঁর সীটের আশেপাশে আবিষ্কৃত হয় পেট্রলের বড় বড় ক্যান। সেগুলোকেই অল্প করে সরিয়ে বাকিরা নেতাজীকে ঘিরে মেঝেতে বসেন। বিমানে আর সীট ছিলোনা তাই।
দুপুর দুটো পয়ত্রিশ মিনিটে বোমারু বিমানটি আকাশে ওড়ে।
বিমান তখনও বেশিদূর যায়নি। বিমানবন্দরের মধ্যেই আছে। তখনই বিস্ফোরণ, তীব্র ঝাঁকুনি। খবর আসে, বিমানের একটা প্রোপেলার ভেঙ্গে পড়েছে, যার কারণে বিমানের সামনে ও পেছনে আগুন লেগে গিয়েছে। নেতাজী বিস্মিত হয়ে হাবিবুর রহমানের দিকে তাকান। হাবিবুর রহমান নেতাজীকে বের হতে বলেন বিমানের সামনের অংশের আগুনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এরমধ্যেই নেতাজির সামনে রাখা পেট্রোলের জেরিক্যান থেকে পেট্রল লেগে ভিজে গিয়েছে নেতাজির কোট। আগুন লেগে গিয়েছে শরীরে। দাউদাউ করে জ্বলছে পুরো দেহ।
এরমধ্যেই কোনোভাবে বাইরে বের হয়ে আসেন নেতাজি। মাথায় চার ইঞ্চি ক্ষত, সারা শরীরে আগুন। হাবিবুর রহমান বাইরে এসে তাঁর আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। নেতাজি সহ বাকি আহতদের সেনাবাহিনীর একটা ট্রাকে করে দ্রুতগতিতে তাইহোকু সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সুভাষ বোসকে হাসপাতালে নেওয়ার পর প্রথম যে চিকিৎসক পরীক্ষা করেন তার নাম ডাক্তার তানইয়াশি ইয়োশিমি।
তিনি সুভাষ বোসের অবস্থা দেখে বুঝতে পারেন, তাকে আর বাঁচানো যাবেনা। শরীরের পুড়ে গিয়েছে প্রায় পুরোটা। মাথা, বুক, পিঠ, হাত, পা, এমনকি তার হৃদযন্ত্রও - সব সাংঘাতিকভাবে পুড়ে গিয়েছে। তার চোখগুলোও ফুলে একেবারে পঁচা মাছের পেটের মত হয়ে আছে। নেতাজি দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু চোখ খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। জ্বর ছিল গায়ে, ১০২.২ ডিগ্রি। পালস রেট হয়ে গিয়েছিল প্রতি মিনিটে ১২০। থার্ড ডিগ্রি অগ্নিদগ্ধ হয়ে কেউই বাঁচেনা। তিনিও বাঁচেননি। রাত প্রায় ন'টার সময়ে সুভাষ চন্দ্র বসু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত নেতাজির কোনো ছবি তোলা হয়না। কেন তোলা হলোনা সে প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, জাপানে মৃতদের ছবি তোলার প্রথা নেই। তবে শাহনওয়াজ কমিশনের (বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে ভারতের গঠিত প্রথম সরকারি কমিশন) দেওয়া সাক্ষ্যে কর্নেল হাবিবুর রহমান বলেন, জেনে-শুনেই সুভাষচন্দ্রের ছবি তুলতে দেন নি তিনি। কারণ তার শরীর তখন বেশ ফুলে গিয়েছিল। তিনি চাননি, তার নেতার এরকম বিকৃত ছবি জনসম্মুখে আসুক।
নেতাজির মৃতদেহকে ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়িয়ে পরবর্তীতে কফিনে মোড়া হয়। চেষ্টা করা হয় তাইহোকু থেকে সরানোর। কোনও বিমান না পাওয়ার ফলে তার মৃতদেহ সিঙ্গাপুর বা টোকিওতে নিয়ে যাওয়া যায় না। চারদিন পরে, ২২ আসস্ট নেতাজির বিশ্বস্ত সহচর হাবিবুর রহমান তাইপেতে তাঁর সৎকার সম্পন্ন করেন। তাঁর অস্থি ভস্ম এনে রাখা হয় জাপানের রেনকোজি মন্দিরে। রীতি অনুযায়ী, নেতাজীর প্রত্যেকটা অঙ্গ থেকে একেকটা হাড় এনে কাঠের একটা কৌটাতে রাখা হয়। শ্মশানে এক কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানকে সুভাষ বসুর সোনায় বাঁধানো একটা দাঁতও দেন। ওই দাঁতটা মৃতদেহের সঙ্গে পুড়ে যায় নি। হাবিবুরের হাতে নেতাজির সোনার দাঁত আর কাঠের কৌটায় নেতাজির অঙ্গের হাড়... হাবিবুরকে এভাবে রেখেই এই অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়।
কিন্তু এই বর্ণনা সন্তুষ্ট করতে পারেনি অনেকেই। পরবর্তীতে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। যে কারণে মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়, নেতাজী হয়তো মারা যাননি এই বিমান দূর্ঘটনায়। অনেকগুলো তত্ত্ব উঠে আসে। তারমধ্যে তিনটি তত্ত্ব ছিলো খুব জনপ্রিয়।
প্রথম তত্ত্ব অনুযায়ী, ১৯৪৫ সালে বিমান দুর্ঘটনার পরেই নেতাজীর মৃত্যু হয়েছে। অনেকে এটাও বলেন, জওহরলাল নেহেরু ষড়যন্ত্র করে মেরেছেন তাকে।
দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী, নেতাজিকে এই দুর্ঘটনার পরে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো রাশিয়াতে। সেখানেই নির্যাতন করে পরে তাকে মেরে ফেলা হয়।
এরমধ্যে তৃতীয় তত্ত্বটা একটু ধাক্কা দেয় সবাইকে। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে গুমনামি বাবা বা ভগবানজির আবির্ভাব হয় নেতাজীর অন্তর্ধানের বহু বছর পর। মুখার্জী কমিশন (নেতাজীর অন্তর্ধান নিয়ে তদন্ত করার জন্যে গঠিত তৃতীয় কমিশন) দাবী করেন, এই গুমনামি আর কেউ নন। তিনিই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস। সম্প্রতি সৃজিত মুখার্জী (আরেক মুখার্জী)র সিনেমা 'গুমনামি' বাঙ্গালীকে আবার ধন্দে ফেলে দেয় নেতাজীর প্রয়াণ রহস্য নিয়ে।
এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, নেতাজির মৃত্যুরহস্য উদঘাটনের জন্যে এ পর্যন্ত বেশ ক'টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে শাহনেওয়াজ কমিশন, খোসলা কমিশন ও মুখার্জী কমিশন উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৬ সালে শাহনওয়াজ কমিশন গঠন করা হয়, যে কমিশন রিপোর্ট করে, বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছিল নেতাজির। কিন্তু পরবর্তীতে নেতাজীর মৃত্যুরহস্য নিয়ে কিছু সন্দেহ তৈরী হয় মানুষের মনে। তখন আবার তদন্ত কমিশন গঠিত হয়; খোসলা কমিশন। ১৯৭০ সালে গঠিত এই কমিশন শাহনেওয়াজ কমিটির রিপোর্টের সাথে একমত প্রকাশ করে।
এরপরেও কেন যেন সন্দেহ যাচ্ছিলো না। কিছু প্রশ্নের উত্তর আসছিলোনা। কিছু বিতর্ক উঠছিলো। তখন ১৯৯৯ সালে ভারত সরকার তৃতীয়বারের মতন কমিশন গঠন করে, যার নাম মুখার্জী কমিশন। এই কমিশনের রিপোর্টে উঠে আসে চমকে যাওয়ার মত তথ্য। রিপোর্টে বলা হয়, ১৮ আগস্ট, ১৯৪৫ সালের বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি এবং রেনকোজি মন্দিরে যে অস্থিভস্ম রাখা আছে, তাও নেতাজীর নয়। যে সোনার দাঁত ছিলো হাবিবুর রহমানের কাছে, সেটিও নেতাজির নয় বলে প্রমাণ করেন তারা। এ বিষয়ে মুখার্জী কমিশন বেশ গভীরভাবে রিসার্চ ও ইনভেস্টিগেশন করে। ইনভেস্টিগেশনে জানা যায়, নেতাজীর বিমান দূর্ঘটনা যে তারিখে, তার আগে পরের সপ্তাহখানেকের মধ্যেও কোনো বিমান দুর্ঘটনা হয়নি সেখানে। তাইওয়ান সরকারের পাঠানো একটি চিঠিতে এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হয়। তাছাড়া নেতাজির গাড়িচালকের ভাষ্য থেকে জানা যায়, কথিত বিমান দুর্ঘটনার ৪ মাস পর তিনি নেতাজিকে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই অদৃশ্য হয়ে যান নেতাজি।
এবার তাহলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় চলে আসে সামনে। যদি মুখার্জী কমিশনের রিপোর্ট ও নেতাজির ড্রাইভারের কথা আমরা ঠিক বলে ধরেও নিই, তাহলে প্রশ্ন আসে- নেতাজি মায়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে গিয়েছিলেন কোথায়? এ বিষয়ে উত্তর পাওয়া যায় নেতাজির দুই গবেষক অনুজ ধর এবং চন্দ্রচূড় ঘোষের কাছ থেকে। তাদের পনেরো বছরের গবেষণার ফসল 'Conundrum: Subhas Bose’s life after death' বইতে তারা দাবী করেন, বিমান দুর্ঘটনার পরেও নেতাজি বেঁচে ছিলেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত কর্মী হাবিবুর রহমান তা জানতেন। তারই সহায়তায় নেতাজি পালাতে সক্ষম হন পরে। এবং সুকৌশলে হাবিবুর জনসম্মুখে প্রকাশ করেন নেতাজি মারা গিয়েছেন এবং মৃত নেতাজির ছবি তুলতেও তিনি দেননা কাউকে। পুরো বিষয়টিই তিনি ধামাচাপা দিয়ে যান অত্যন্ত চতুরতার সাথে।
এদিকে সবার কাছে মৃত নেতাজি থাইল্যান্ড, মায়ানমার হয়ে ঘুরে উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে এসে পৌঁছেছেন তখন। দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। তিনি আশ্রয় নিয়েছেন পাহাড়ের কোলে। নাম নিয়েছেন- গুমনামি বাবা। কেউ অবশ্য ডাকতেন ভগবানজি। কেউ ডাকতেন মহাকাল। যদিও বোস পরিবারের বাকিরা এই তত্ত্বটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে দুই গবেষকের দাবী, বোস পরিবারও জানতেন, গুমনামি বাবাই নেতাজি। এবং এই তথ্য যাতে বাইরে না আসে, তাই তাদের হুমকিধামকিও দেয়া হয়েছিলো সময়ে অসময়ে। তাছাড়া নেতাজির অনেক ঘনিষ্ঠ সহচর স্রেফ কৌতূহলের বশে গুমনামি বাবার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তারাও বিভিন্ন সময়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন, গুমনামি বাবার সাথে নেতাজির গলার স্বর ও কথাবার্তার আশ্চর্য মিল।
গুমনামি বাবা কারো সাথেই সরাসরি দেখা করতেন না। তাঁর সাথে দেখা করতে যিনি আসবেন তাকে বসতো হতো পর্দার ওপাশে। এ পাশে বসতেন গুমনামি বাবা। এবং দর্শনার্থীকে মাথা নিচু রেখে কথা বলতে হতো। তবে আস্তে আস্তে কিছু মানুষের সাথে গুমনামি বাবার সখ্যতা বাড়ে। এই কাছের ভক্তদের জন্যে তিনি কথা বলার সময় মাঝখানে পর্দার নিয়মটা বাদ দেন। এই মানুষগুলো গুমনামি বাবার চারপাশে গোল হয়ে বসতো। মাঝখানে কোনো পর্দা থাকতোনা। কিন্তু মাথা নিচু করে রাখতে হতো। গুমনামি বাবার চেহারা দেখা যেতোনা। এভাবেই কথা শুনতো সবাই।
সুরজিৎ দাশগুপ্ত ছিলেন এই কাছের ভক্তদের একজন। একদিন গুমনামি বাবার সাথে দেখা করতে যান তিনি সহ কয়েকজন। গুমনামি বাবার পাশে মাথা নিচু করে বসেছিলেন তারা। হুট করে কী হয়, সুরজিৎ মাথা উঁচু করে তাকিয়ে বসেন গুমনামি বাবার দিকে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, তাঁর সামনে বসে আছে নেতাজি। চেহারায় বয়সের ছাপ। কিন্তু চোখদুটি সেই আগের মতই উজ্জ্বল। সেই দিনের কথাটা তিনি বারবার বলে এসেছেন, নিজের চোখে নেতাজিকে চাক্ষুষ দেখার এই স্মৃতির সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি বিভিন্ন সময়েই। তাছাড়া গুমনামি বাবা সোভিয়েত ইউনিয়ন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র এসব নিয়েও কথা বলতেন নিয়মিত। তবে এটুকুতেই সবটা প্রমাণিত হয়না। পরবর্তীতে আরেকটি কমিশন গঠিত হয়। জাস্টিস সাহাই কমিশন। এই কমিশনও রিপোর্ট করে, ফৈজাবাদের অনেকেই দাবী করেছিলেন, গুমনামি বাবাই নেতাজি।
শুধু তাই না, গুমনামি বাবার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়েও ব্যাপক গবেষণা চালায় ফৈজাবাদের জেলা রাজস্ব বিভাগ। যার ফলাফল ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। সেই ফলাফলেও উঠে আসে গুমনামি বাবার সাথে নেতাজির সম্পর্কের প্রমাণ। গুমনামি বাবার ব্যবহত জিনিসপত্রের মধ্যে পাওয়া যায় নেতাজির দুটি পোস্ট স্ট্যাম্পের ছবি, আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যবহৃত বাইনোকুলার, কিছু চিঠিপত্র যেগুলো সুভাষ বোসের ঘনিষ্ঠ মানুষজনদের কাছ থেকে এসেছে, বিভিন্ন বই, বাংলাদেশের হাতে আঁকা মানচিত্র। এসব থেকে সন্দেহ আরো ঘনীভূতই হতে থাকে। এবং কোনো তথ্যই এখানে উড়িয়ে দেয়ার মতন নয় মোটেও।
২০১৬ সালে আবারও এক নতুন তথ্য উঠে আসে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জি ডি বক্সির লেখা ‘বোস: দ্য ইন্ডিয়ান সাম্যুরাই— নেতাজি অ্যান্ড দ্য আইএনএ মিলিটারি অ্যাসেসমেন্ট’ বইটিতে। এখানে দাবী করা হয়, নেতাজির বিমান দুর্ঘটনাতে মৃত্যু তো হয়ইনি। বরং তিনি নিজেই এই দুর্ঘটনা সাজিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে জাপানের সহায়তায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ কে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা পুরোপুরি করার আগেই তাকে আটক করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ইংরেজ কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে। এরপর ইন্টেরোগেশন করা হয় তাকে। সেই ইন্টেরোগেশনের সময়ে তীব্র শারিরীক নির্যাতন করা হয়েছিলো তাকে। যার ফলশ্রুতিতেই মারা যান তিনি।
তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন কী না, তিনি পরবর্তীতে 'গুমনামি বাবা' হিসেবে স্বাধীন ভারতবর্ষে ফিরে এসেছিলেন কী না অথবা তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের টর্চার সেলে মারা গিয়েছিলেন কী না... সে নিয়ে গবেষণা চলছে। সামনেও চলবে। তবে ভারত সরকার কয়েকশত গোপন নথি প্রকাশ করার পরেও কোনো নথিই তাঁর মৃত্যুর স্বপক্ষে জোরালো সাক্ষ্য দিতে পারেনি আজও। জাপান সরকার নেতাজির মৃত্যু বিষয়ক পাঁচটি গোপন ফাইল প্রকাশ করতে চেয়েছিলো। সেখান থেকে মাত্র দুটি ফাইল প্রকাশ পায়। বাকি তিনটি কেন প্রকাশ করা হলোনা, কাদের ইশারায় জাপান সরকার এখনো আটকে রাখলো এই ফাইল তিনটিকে সে প্রশ্নও অনেকের। তাছাড়া 'মুখার্জী কমিশন' এর এত নিখুঁত গবেষণার পরেও কেন কোনো কারণ না দেখিয়ে তাদের রিপোর্টকে নাকচ করে দেয় তৎকালীন ভারত সরকার, সেটাও বেশ বড়সড় এক প্রশ্নবোধক চিহ্নের জন্ম দিয়ে যায়।
এভাবেই অজস্র প্রশ্নের জন্ম দিয়ে বাঙ্গালীর সুপারম্যান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের অন্তর্ধান রহস্য এখনো তুষারাবৃত হয়ে সমাধিস্থ হয়ে আছে জনমানুষের দৃষ্টিসীমার গন্ডি থেকে আরো গভীরে। এভাবেই নেতাজি আজও হয়ে আছেন রহস্যময়, প্রাসঙ্গিক ও জটিল মিস্ট্রির এক ফেলুদার উপন্যাস!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন