সুশান্তের মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা, নেপোটিজম ও দর্শকের দায়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

যেকোন ব্যবসায়ীই রিস্ক ফ্রি বিনিয়োগ চাইবেন। তবে তা নিয়ে গালাগাল করার ঘটনা এমন যে রাতের বেলা বেশ্যাপল্লীতে যাওয়া পুরুষেরাই দিনের বেলায় সেই একই বারবণিতাদের 'মাগি' বলে গালাগালি করে।
সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যার পরে বলিউড দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল দাবি তুললো বলিউডে কেবলই নেপোটিজম চলে। করন জোহর, সালমান খানরা নেপোটিজমের পতাকাবাহী। ওরা বলিউড পরিবারের বাইরের লোকজনের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের নেতৃত্ব দিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কঙ্গনা রানাউত।
তা ভারতীয় জনতাও তখন প্রতিবাদী হয়ে উঠে দাবি তুললেন "বয়কট করণ জোহর!" "বয়কট সালমান খান!" বলিউডের হাওয়া যেহেতু বাংলাদেশেরও পালেও লাগে, তাই আমাদের জনতাও ওদের কন্ঠে কণ্ঠ মিলালো।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটেই কিছু কথা বলতে চাই, যাতে এই ঘটনার মতই আরও যা কিছু ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটে, সেটা নিয়ে আমরা একটু ভাবি।
সবার আগে প্রশ্ন করবো জনতাকে, যারা দর্শক, যারা প্রতি শুক্রবারে সিদ্ধান্ত নেন কে তারকা হবে আর কে ঝরে যাবে। এই জনতাই সুশান্ত সিংয়ের মৃত্যুর ঘটনায় আহ্লাদিত হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর পর ওর মুক্তি পাওয়া সিনেমা 'দিল বেচারা'কে আইএমডিবি রেটিংয়ে দশে দশে দিতে দিতে এমন অবস্থায় নিয়েছে যে তা সর্বকালের সর্বসেরা রেটিং পাওয়া সিনেমার তালিকায় শীর্ষে উঠে গিয়েছিল। পুরোটাই আবেগ। সিনেমাটা দেখি নাই, যারাই দেখেছেন, বলেছেন বিলো এভারেজ। অথচ সুশান্তের মাস্টারপিস সিনেমা, 'সোনচিড়িয়া' যখন মুক্তি পেল, তখন এই দর্শকদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি ভাল সিনেমা ফ্লপ করার পরে একজন অভিনেতা কতটা বিষণ্ণ হন, সেটা যদি এই অতি আবেগী দর্শকরা বুঝতো! 'ফটোগ্রাফ' ফ্লপ করার পরে যেমন নাওয়াজ বলেছিলেন, এই দেশে ভাল সিনেমার দর্শক নেই।
ছেলেটা মারা যাবার আগে তোমরাই তাঁকে বিষণ্ণ করেছো, এখন মরার পরে আল্লাদ দেখাতে এসেছো!
ঘটনা আমাদের দেশেও ঘটে। বেঁচে থাকতে শিল্পীদের খোঁজ খবর কেউ নেন না। দুস্থের তালিকায় নাম লেখাতে হয়, চিকিৎসার জন্য হাত পেতে সাহায্য চাইতে হয়, তখনও কেউ ফিরে চায় না। অথচ যেই না তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন, অমনি তিনি জাতীয় সম্পদ বনে যান। জনে জনে তখন শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। চলে পুষ্পস্তবক অর্পণ! থটস এন্ড প্রেয়ার্স! রেস্ট ইন পিস্! এইটা কি হিপোক্রেসি নয়? মরার পরে আপনার থটস এন্ড প্রেয়ার্স দিয়ে তিনি কী করবেন? ভালবাসা দেখাতে হয়, মৃত্যুর আগে দেখালে সমস্যা কী? তাঁদের পরিশ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করেন, ভিক্ষাতো তাঁরাও চাননি।

এখন আসা যাক আসল ঘটনায়। 'সব দোষ নেপোটিজমের। করন জোহর খারাপ, সালমান খান খারাপ, কঙ্গনা হিরো'... এখন কিছু বিষয় খেয়াল করা যাক। সালমান দিয়েই শুরু করি। সালমান কাদের নিয়ে সিনেমা বানায়? নিজের বন্ধুর ছেলে, আত্মীয়ের মেয়ে, আত্মীয়ের বন্ধু ইত্যাদি, ঠিকতো? সালমান নিজে না থাকলে সেই সিনেমা কেমন ব্যবসা করে? একটা সালমান খান ফিল্মসের প্রযোজিত সিনেমার নাম বলুন যেটি বক্স অফিসে ঝড় তুলেছে, এবং সেখানে সালমান খান নিজে ছিল না। যতদূর মনে পড়ে একটিও না! মানে সালমান নিজের পয়সা ডুবাতেই ওদের দিয়ে সিনেমা বানান। তিনি নিজের কাছের পরিচিতদের সুযোগ দেন। টিভি কমেডি কিং কপিল শর্মা যখন ডিপ্রেশনে চলে যান, মোটামোটি সবাই তাকে ত্যাগ করে, তখন এই সালমান খানই তাকে আরেকটি সুযোগ দেন। চলমান দ্য কপিল শর্মা শোর দ্বিতীয় সিজনের প্রযোজক সালমান খান।
তেমনই দেখবেন তাদের অন্যান্য সিনেমাগুলো, যেমন Jai Ho কাস্টিং ভর্তি সব বাতিল মালে। এককালে বলিউডে কিছু করেছে, এখন সবাই পরিত্যাগ করেছে। সবাইকে সালমান সুযোগ দিয়েছেন। এবং সবাই মিলেই ধরা খেয়েছেন। ববি দেওল সহ আরও কিছু বাতিল মালকে রেস্ থ্রীতে সুযোগ দিয়ে ধরা খেয়েছে। তাই 'সালমান কারোর ক্যারিয়ার বানিয়ে দেয়' কথাটি কাগজে কলমে মিলে না। সেটা করতে পারলে আরবাজ-সোহেল খানরা আজকে মহাতারকা হতেন। পয়সা ডুবানো ছাড়া তাদের বলিউডে কোন অবদান নেই।
বলিউড, হলিউড, ঢালিউড, টলিউড যেকোন উডেই আপনাকে রাজত্ব করতে হলে নিজের প্রতিভা ও ক্ষমতায় রাজত্ব করতে হবে। সালমান-শাহরুখ-আমির কেউই আপনাকে বানিয়ে দিতে পারবে না। যদি তাই হতো তাহলে বলিউডের সবচেয়ে বড় সুপারস্টারের নাম হতো উদয় চোপড়া। কারণ ওর বাপ ইয়াশ চোপড়া, এবং ভাই আদিত্য চোপড়া। করন জোহর ওদের পারিবারিক বন্ধু। আস্ত বলিউড ওদের হাতের মুঠোয়। যে কোনো নায়িকা ওদের প্রোডাকশনে কাজ করতে মুখিয়ে থাকে। যে কোনো নায়ক ওদের সিনেমায় চান্স পেলে ধন্য হয়ে যায়।
বা ধরুন বলিউডের শেষ কথা অমিতাভ বচ্চনের পুত্র অভিষেক বচ্চনকে? সিনেমায় কিছু করতে পারেনি বেচারা, ওয়েব সিরিজেও সুপার ফ্লপ। অথচ কিছুটা হলেও প্রতিভাতো তাঁরও ছিল, নাকি? বাপ মায়ের অর্ধেক অর্ধেক জীন পেয়েইতো তার সৃষ্টি। এত প্রতিভা গেল কই? হ্যাঁ, কিছু স্টার কিডের যেমন সুযোগ পাওয়ার যোগ্যতাই নেই। যেমন 'পোকার ফেস' অর্জুন কাপুর। বনি কাপুরের ছেলে আর অনিল কাপুরের ভাতিজা, এই পরিচয়েই বেচারা কিছু সিনেমায় চান্স পেয়েছে। আর ওর চেহারা ও অভিনয়ের সাথে মানানসই চরিত্র 'ইশাকজাদে'তে যা কিছু ভাল কাজ করেছে। তারপরে সে কই? যাই করেছে, সব বোগাস। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, কবির সিং চরিত্রে নাকি ওকে নেয়ার কথা ছিল! কী সর্বনাশা চিন্তাভাবনা! মানে কেউ দশ বোতল দেশি মদ খেলেও এমন কল্পনা করতে পারে কিনা সন্দেহ। যাই হোক, অবশেষে সুবুদ্ধির উদয় হওয়ায় ওরা শহীদ কাপুরকে নিয়ে সিনেমা বানায়।
ওর চাচাতো বোন সোনাম কাপুরও আরেকজন। চেহারাটা একটু কিউট, নাহলে 'রানঝানা' এবং 'নির্জা' ছাড়া আর কোন সিনেমায় সে কিছু করে দেখিয়েছে? একের পর এক সুযোগ হাতছাড়া করেছে সে। অনিল কাপুরের মেয়ে না হলে হয়তো বহু আগেই সে বাতিল হয়ে যেত।
তবে টাইগার শ্রফকে নিয়ে লোকজনের নাক সিটকানো দেখে অবাক হই। ওর পর্যায়ের ডান্সার, ফিট বডি বিল্ডার এবং অ্যাকশন হিরো এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কেউ আছে? এক চরিত্রের মধ্যে লোকজন মাইকেল জ্যাকসন এবং জ্যাকি চ্যানকে পান। এখন টম হ্যাংকসও লাগবে? সবাই কি হৃত্বিক রোশন? অভিনয়ে টাইগার দশে শূন্য, ঠিক আছে, কিন্তু সে কি অভিনয়ভিত্তিক সিনেমা করে? তাঁর কাজই হচ্ছে পিটিয়ে ভিলেন মারা, সেই কাজে সে দক্ষ। সিলভেস্টার স্ট্যালোন, আর্নল্ড শোয়ের্জনেগার, ভ্যানডেমরা জিন্দেগী কাটিয়ে দিয়েছেন হলিউডের মতন প্রতিযোগিতার ইন্ডাস্ট্রিতে। ওকে নিয়ে কেন টানাটানি?
আরও অনেক তারকাপুত্র কন্যা আছে। যারা বাপ মায়ের পরিচয়ে টিকে আছে। আবার দর্শকদেরও দায় আছে। সোনাক্ষি সিনহা, শ্রদ্ধা কাপুরদের কারা টিকিয়ে রেখেছে? দর্শকরা। কিন্তু সেই সূত্রটাই অভিষেক বচ্চন বা এশা/ববি দেওল, টুইংকেল খান্না, সোয়াহ আলী খান প্রমুখদের ক্ষেত্রে খাটে না। ওদের প্রত্যেকের বাবা মায়েরা অন্য যেকোন স্টার কিডের বাবা মায়ের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তাহলে নেপোটিজমের ফায়দা তাঁরা তুলতে পারলেন না কেন?
এখানে একটি বিষয় সবাই ভুলে যান, এখন সেই যুগ নেই যে একজন উত্তম কুমার বা একজন সুচিত্রা সেনের নামেই সিনেমা চলে। একটি সিনেমাকে টানতে একটি ভাল স্ক্রিপ্ট থাকতে হয়। ভাল ডিরেকশনের প্রয়োজন হয়। ভাল সংগীতের প্রয়োজন হয়। ক্যামেরাম্যান ভাল না হলে দৃশ্যায়ন ঠিক মতন হয় না। স্টার কিডের অবদান কেবল ভাল অভিনয় করা। একটি বিশাল কর্মযজ্ঞের সে কেবল একটি উপাদান।
করন জোহরের বিষয়ে কথা বলার আগে আপনাকে বলবো তাঁর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে। চল্লিশ পঞ্চাশ কোটি টাকা বাজেটে একেকটি সিনেমা তৈরী হবে। প্রথম শর্তই হচ্ছে সেই সিনেমা দেখতে যেন দর্শক আসে। দর্শক কার সিনেমা দেখতে যাবে? যখন শুনবে "শ্রীদেবীর কন্যার প্রথম সিনেমা মুক্তি পেতে যাচ্ছে" সেটি? নাকি "একটি অপরিচিত নায়ক নায়িকাকে নিয়ে স্বল্প বাজেটে একটি আর্ট ফিল্ম তৈরী হয়েছে" সেটি? দর্শক হিসেবে আপনি নিজে কোনটি দেখবেন? টিকেটের দাম পাঁচশো টাকা। পরিবারকে নিয়ে উইকেন্ডে সিনেমা দেখতে যাবেন। দুই তিন হাজার টাকা আরামসে খসে যাবে। চাইবেন শিওর শট ভাল সিনেমা দেখতে, যাতে পয়সা উসুল হয়। আপনি কি তখন শ্রীদেবীর মেয়ের উপর বাজি ধরবেন, নাকি জনৈকা মৃণালিনী দেবীর কন্যার উপর? তাহলে করন জোহর কার উপর বাজেট খাটাবে? আপনি হলে কার উপর ইনভেস্ট করতেন? অন্যের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে নিজের দায়িত্বটা পালন করা উচিৎ নয় কি? করন জোহর সেটাই করছেন যা পাবলিক চাইছে। "যেমন পাবলিক, তেমনই তার নেতা"র মতন, "তেমনই তার সিনেমাও।" নেপোটিজমের জন্য হাহাকার করছে ঠিকই, কিন্তু নিজেই ইন্ধন দিচ্ছে। এটাও কি হিপোক্রেসি নয়?
করন নিজের পরিশ্রমের টাকা বাঁচাবার জন্য তাই করছে বা করে যা যেকোন সফল ব্যবসায়ী করে থাকে। নিন্দনীয়? সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। যেকোন ব্যবসায়ীই রিস্ক ফ্রি বিনিয়োগ চাইবেন। তবে তা নিয়ে গালাগাল করার ঘটনা এমন যে রাতের বেলা বেশ্যাপল্লীতে যাওয়া পুরুষেরাই দিনের বেলায় সেই একই বারবণিতাদের 'মাগি' বলে গালাগালি করে।
প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কঙ্গনা রানৌতের প্রথম দিকের কথাবার্তা শুনতে ভাল লাগতো। তখন সে নিজে ভিকটিম ছিল। বুলিড হতো। কিন্তু এখন যখন তাঁর ক্ষমতা এসেছে, এখন সে কী অশ্ব ডিম্ব প্রসব করেছে? সে নিজেও কি বুলি করছে না? তাপসী পান্নুর মতন অভিনেত্রীকে 'বি-গ্রেড' অভিনেত্রী ডাকছে। যাকে তাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিচ্ছে। সুশান্তের মৃত্যুর ঘটনাকে পুঁজি করে যেভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করে সেন্টার অফ এটেনশন হলো - এর পরে কীভাবে ওর প্রতি সহানুভূতি কাজ করবে?

কঙ্গনা নিজে কয়জন নতুনকে সুযোগ দিয়েছে? যারাই চিৎকার চ্যাঁচামেচি করছেন সালমান খান, করন জোহররা নতুনদের নিয়ে কাজ করে না, সুযোগ দেয় না, ইত্যাদি ইত্যাদি, তাঁরা নিজেরা কয়জনকে প্ল্যাটফর্ম তৈরী করে দেন? যারা সুযোগ দেন, নতুনদের নিয়েই কাজ করতে পছন্দ করেন, (রামগোপাল ভার্মা, অনুরাগ কাশ্যপ প্রমুখ) তাঁরা কি এই ব্যাপারে কিছু বলেছেন? রামুর ইদানিং বেশ কয়েক বছর ধরেই মাথার ঠিক নাই, এটেনশন পেতে নানান উদ্ভট মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু অনুরাগ কাশ্যপের বক্তব্য খুবই ইন্টারেস্টিং। তাঁর কথা হচ্ছে, নতুনরা চায়ই ইয়াশরাজ ফিল্মসের ব্যানারে মুক্তি পেতে, নতুনরা চায়ই ধর্মা প্রোডাকশনস থেকে তাঁর সিনেমা মুক্তি পাক, তাই তাঁদের অফিসের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়ায়।
এদিকে অনুরাগের মতন ডিরেক্টররা, যাদের বাজেট সবসময়েই কম থাকে, বেশিরভাগ সিনেমাই 'ক্রিটিক্যালি এক্লেইমড ও কমার্শিয়ালি ফ্লপ' হয়ে থাকে, তাঁদের অফিসে কেউ আসে না। সুশান্ত সিং রাজপুতকেই অনুরাগ তিনবার এপ্রোচ করে পায়নি, তারপরে আর যায়নি। তারও তো মান সম্মান আছে ভাই। বলিউডের সবচেয়ে প্রতিভাবান ডিরেক্টরদের একজন সে। আজকে সবাই কান্নাকাটি করছেন সুশান্তকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া হয়নি বলে, সুশান্ত নিজে কি সুযোগগুলো নিয়েছেন যেগুলো তাকে দেয়া হয়েছিল? সুশান্ততো তাও অনেক নাম কামিয়েছেন, বলছি আরও অন্যান্য উঠতি/পড়তি অভিনেতার কথা। তারা কি সেই সুযোগগুলো গ্রহণ করেন যেগুলো তাদের দেয়া হয়?
বলিউড শ্রেষ্ঠ অভিনেতা নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর উদাহরণই দেই। শুরু করেছিলেন রামগোপাল ভার্মার সিনেমার এক্সট্রা শিল্পী হিসেবে। একটা ওয়েটারের ভূমিকায় অভিনয়। নায়ক নায়িকা রেস্টুরেন্টে গেছেন, তিনি এসেছেন অর্ডার নিতে। এইটুকুই রোল। নিরানব্বই সালের ঘটনা সেটি। স্ট্রাগল চলেছে একযুগেরও বেশি সময় ধরে। ধনিয়াপাতা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন পেটের ধান্দায়। আপনি নতুন, পরিশ্রম করতে চাইবেন না, অথচ চাইবেন শুরুতেই আপনাকে ইয়াশ চোপড়া প্রোডাকশনের সিনেমা তুলে দেয়া হবে, যার ডিরেক্টর হবেন রাজকুমার হিরানি, যার পরিবেশক হবেন করন জোহর, যার কাহিনী লিখবেন সেলিম-জাভেদ। এইটা কি অন্যায় আবদার নয়?
বলিউডের উদাহরণ দিলাম, যাতে সবাই বুঝতে পারেন। এখন একটু ভিন্ন ক্ষেত্রের কথা বলি? মিলিয়ে নিন।
ধরেন, আপনার বাবা একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। ছোট্ট একটি দোকান থেকে যাত্রা শুরু করে একটি বিশাল কর্পোরেশন তৈরী করেছেন। এখন সেখানে চাকরির জন্য দরখাস্ত আসছে। আপনিও এপ্লাই করেছেন, এবং আরও হাজার খানেক যুবক এপ্লাই করেছে। আপনি সবার চেয়ে যোগ্যতম না হলেও, একদমই অশিক্ষিতও নন। আপনার ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি আছে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হওয়ায় আপনি একটু কম পরিশ্রমী, কিন্তু এছাড়া আপনার আর কোন সমস্যা নাই। এখন কি তবে অন্যান্য যুবক যুবতী আন্দোলন শুরু করবে যে ওদের বাদ দিয়ে কেন আপনাকে আপনারই পিতার/চাচার কোম্পানিতে চাকরি দেয়া হলো? আপনার বাপ চাচার টাকা। তাঁদের প্রতিষ্ঠান। ডুবলে বাঁচলে নিজের লোকেদের উপর ভরসা করেই করা ভাল।
রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখেন। গণতান্ত্রিক দেশে পরিবারতন্ত্র চলছে। সমস্যা আছে? না। শেখ হাসিনার জায়গায় অন্য কাউকে আওয়ামীলীগের প্রধান বানালে সাধারনের কাছে এই দলের এত গ্রহণযোগ্যতা থাকতো? না। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-পাকিস্তান; আমরা নেপোটিজমমুক্ত সমাজের জন্য প্রস্তুত নই। তাই আমাদের হঠাৎ এর বিরুদ্ধে এত বিকট গর্জন করাটা চোখে লাগে। সহজ কথায় আমরা সবাই নেপোটিজম করি। স্বীকার করি না, অথবা বুঝি না।
আরেকটা ব্যাপার। প্রায়ই দেখবেন আপনার কাছে লোকজন বা আত্মীয়স্বজন আবদার করেন তাঁর জন্য চাকরির সুপারিশ করতে। বিদেশে চাকরির 'সুপারিশ' ভিন্নভাবে কাজ করে। রেফারেন্স বলে সেটাকে। রেফারেন্সের জোরে খুব বেশি হলে ইন্টারভিউ পর্যন্ত যাওয়া যায়। কিন্তু ইন্টারভিউ, এবং তার পরবর্তী সবকিছুর দায়-দায়িত্ব প্রার্থীর নিজের। এখন কেউ যদি বলেন তিনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি নন, সরাসরি নিয়োগ পেতে ইচ্ছুক। কিংবা কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই এন্ট্রি লেভেল টপকে আপনি মিড লেভেল বা আপার মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টের চাকরি চান। তাহলে কীভাবে চলবে? আপনি সামান্য একটা ইন্টারভিউ দেয়ার পরিশ্রম করতে ইচ্চুক নন, আপনাকে কোন ভরসায় সুপারিশ করা হবে যে আপনি পরিশ্রমী? বসিয়ে বসিয়ে কে কর্মচারী পালতে চায়? কেন পালবে? আপনার বাড়িতে কাজের লোককে আপনি বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ান? ধরেন নেপোটিজমের জোরে (সুপারিশ/রেফারেন্স ইত্যাদি যে মাধ্যমেই হোক) আপনাকে একটি ভাল চাকরিতে ঢোকানো গেছে, এখন সেটা ধরে রাখা কি আপনার দায়িত্ব নয়? সেখানে ফাঁকিবাজি করলে আপনাকে বের করে দিবে, নাকি না?
আবারও ফেরত যাই সিনেমায়। অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, ইরফান খান, রাজকুমার রাউ, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী, গোবিন্দ, অক্ষয় কুমার কারোরই কোন ফিল্মি ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। তাঁরা এখানে পৌঁছেছেন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। অমানুষিক পরিশ্রম করে। এত কষ্টের বিনিময়ে তাঁদের যে প্ল্যাটফর্ম তৈরী হয়েছে, সেটার উপর ভর করে যদি তাঁদের বাচ্চারা দাঁড়াবার চেষ্টা করে, এতে হায় হায় করার কিছু নেই। একজন তারকা সন্তানের 'অপরাধ' এইটা হতে পারে না যে সে এক তারকা দম্পতির পরিবারে জন্মেছে।
রণবীর কাপুর, আলিয়া ভাটরা নিজেদের যোগ্যতাতেই তাঁদের অবস্থানে এসেছে। হ্যাঁ, তাঁদের ও সাধারণ মানুষের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে প্রথম ছবি পেতে তাঁদের কম পরিশ্রম করতে হয়। এবং প্রথম ছবি মুক্তির আগেই দ্বিতীয় ছবি সাইন করা হয়ে যায়। হিট ফ্লপ ম্যাটার করে না। কিন্তু তৃতীয় ছবি পেতে হলে তাঁকে অবশ্যই প্রথম দুই সিনেমার সাফল্যের উপর নির্ভর করতে হবে। লাগাতার ফ্লপ সিনেমা দিয়ে গেলে সবাইকেই হারিয়ে যেতে হয়। শাহরুখ খানকেই দেখুন, টানা তিন চারটা সিনেমা ফ্লপ করায় এক কালের বাদশাহর নায়ক হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ হতে চলেছে। যেখানে নিজেদের ক্যারিয়ারই দোদুল্যমান, সেখানে অন্যের ক্যারিয়ার ভাঙাগড়ার ক্ষমতা আছে?
মোট কথা, কেউ কারোর ক্যারিয়ার বানাতে বা ধ্বংস করতে পারেনা। নিজের হাতেই সব। সাথে থাকা লাগে উপরওয়ালার রহমত, যেটাকে লোকে বলে ভাগ্য। দুইটা এক হলে তখনই ক্যারিয়ার ক্লিক করে। নাহলে কিছুই হয় না।
কেউ বলতে পারেন বিবেক ওবরয়ের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছেন সালমান খান। আপনারা তার সংবাদ সম্মেলনটা দেখেছিলেন? সেখানে সে শুধু সালমান খানই না, তখনকার টপ নায়িকা রানী মুখার্জি ও প্রীতি জিনতাদের নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিল। আরেক টপ নায়িকা ঐশ্বিরিয়ার সাথেও ছ্যাকা খেয়েছিল। এত কিছুর পরে কে ওর সাথে সিনেমা করতে চাইবে?
শুরু করেছিলাম বলিউড নেপোটিজম নিয়ে, মাঝে অন্য লাইনে গিয়ে আবারও ফিরে এলাম। আর কথা প্যাচানোর কিছু নেই। আশা করি বাকিটা নিজেরাই বুঝে নিবেন। ধন্যবাদ।
* লেখাটি ক্যানভাস ফেসবুক গ্রুপে প্রথম প্রকাশিত
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে