নেপাল করোনাকে রুখে দিতে পেরেছে, আমরা বসে বসে মাছি মেরেছি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নেপালে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন মাত্র একজন, তিনিও সুস্থ হয়ে গেছেন। অথচ তারা এই মহামারীর বিরুদ্ধে চমৎকার সব ব্যবস্থা নিয়েছে, যেগুলো দেখে আমাদের আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার নেই!
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ‘প্রিকশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’। লাইনটার বাংলা মানে দাঁড়ায়- রোগে ভুগে সুস্থ হবার চেয়ে রোগের আগেই প্রতিরোধ গড়া ভালো। করোনাভাইরাস নিয়ে নেপালের সতর্কতা দেখে পুরনো সেই প্রবাদটাই আরও একবার মনে পড়ে গেল, সেই সঙ্গে একরাশ হতাশা আর আফসোস ঘিরে ধরলো মনকে। যথাসময়ে এই প্রাণঘাতি ভাইরাসটাকে গুরুত্ব দিয়ে যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতো আমাদের সরকার, তাহলে এখন হয়তো লাখ লাখ মানুষকে আতঙ্কে দিন কাটাতে হতো না, আগামী দিনগুলোতে কি হবে সেটা ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হতো না।
নেপালে এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোন রোগী নেই। করোনা টেস্টে একজন পজিটিভ ধরা পড়েছিলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে তিনিও ফিরে গেছেন বাড়িতে। নেপাল নিজেদের পুরোপুরি লকড ডাউন না করলেও, বাইরের দেশ থেকে সেদেশে প্রবেশের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, ইউরোপ, ইরান, মধ্যপ্রাচ্য, জাপান এবং কোরিয়া থেকে কেউ নেপালে ঢুকতে পারবেন না এখন, এমনকি তিনি নেপালের নাগরিক হলেও না। ত্রিভূবন বিমানবন্দরে কঠোর পরীক্ষা-নীরিক্ষার পরেই প্রতিটা মানুষকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে, করা হচ্ছে থার্মাল টেস্ট। অথচ আমাদের বিমানবন্দরের থার্মাল টেস্টের যন্ত্রগুলোর কয়েকটা নাকি নষ্ট হয়েই পড়ে ছিল!
নেপাল সরকার শুরু থেকেই করোনার বিরুদ্ধে এই মিশনে তাদের সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়েছে, যেটা আমরা করতে পারিনি। নেপাল আমাদের মতো বোকামি করেনি, তারা করোনাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে, তাদের সরকার জানতো, আগেভাগে প্রতিরোধ করা না গেলে এই মহামারি বিপদ ডেকে আনবে। আর তাই আজ যখন ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ করোনার ভয়ে কাঁপছে, তখন প্রতিবেশী দেশ হয়েও জিরো ক্যাজুয়ালিটি নিয়ে নেপাল নিজেদের নিরাপদে রেখেছে।
চীন সরকার নেপালের জন্যে উপহার হিসেবে ৫৪টি তাঁবু পাঠিয়েছিল, এই তাঁবুগুলোতে দুজন করে মানুষ থাকতে পারে, একজনের সাথে আরেকজনের নিরাপদ দূরত বজায় রাখার ব্যবস্থা আছে এসব তাঁবুতে। এই তাঁবুগুলো দিয়ে নেপাল সরকার দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিপুরেশ্বরে সেদেশের সেনাবাহিনীর সদর দফতরে মডেল কোয়ারেন্টাইন জোন তৈরি করেছে। মোট ১০৮ জন আক্রান্ত রোগীকে একসঙ্গে এখানে রাখা সম্ভব। সেখানে একাধিক আইসোলেশন রুম, নিয়মিত চেক-আপ রুম ও প্রতি তাঁবুতে একটি করে পানির কল আছে।
কিন্ত শুধু কোয়ারেন্টাইন জোন তৈরী করলেই তো হবে না, চাই যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সেবা দেয়ার মতো প্রশিক্ষিত মানুষও। নেপাল সরকার তাদের সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্যে সেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে, সেখানেও তাদের সাহায্য করেছে চীন। কীভাবে রোগীদের সেবা দিতে হবে, সেবাদানের সময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, এবং কোয়ারেন্টাইন জোন থেকে বের হবার সময় কিভাবে নিজের এবং বাকীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে- সেসবের প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যেই নেয়া হয়ে গেছে তাদের। সুরক্ষা সামগ্রী পরে নেপালের সেনা সদস্যদের মহড়ায় অংশ নেয়ার ছবি এবং খবর প্রকাশিত হয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা সহ আরও নানা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
করোনা মোকাবেলায় নেপালের এই দজ্ঞযজ্ঞ দেখে হতাশ লাগে। আমরাও চাইলে প্রথম দিন থেকেই সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাতে পারতাম, তারা তাদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো। সেটা না করে আমরা বরং অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত নজির স্থাপন করেছি, লাখ লাখ প্রবাসীকে দেশে ঢুকতে দিয়েছি যথাযথ পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়াই। তাদের মাধ্যমে ভাইরাসটা এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের নানা প্রান্তে। আক্রান্তের সংখ্যা এখন বিশ, কিন্ত রোগের জীবাণু শরীরে নিয়ে যে বিশ হাজার মানুষ ভাইরাসের চলন্ত গোডাউন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন না- সেটা কি কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে? তার ওপরে যারা করোনা থেকে আমাদের বাঁচাবেন, সেই ডাক্তারদের রক্ষার কোন চেষ্টাই আমরা করছি না, তাদের কাছে মাস্ক নেই, নিরাপদ পোষাক নেই- শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এগুলো বাস্তব।
পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন কিন্ত বাধ্য হয়েই আমরা সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়েছি, ঢাকার ভেতরে দুটো কোয়ারেন্টাইন জোন খোলা হয়েছে। অথচ এই কাজটা আরও দুই সপ্তাহ আগে করার কথা ছিল। আমাদের পলিসি মেকারেরা যদি আবোল তাবোল কথাবার্তা আর অন্ধ আত্মবিশ্বাস না দেখিয়ে নেপালের মতো কাজে প্রমাণ দিতেন নিজেদের, তাহলে এভারেস্টের দেশের মতো আমরাও নিজেদের নিয়ে গর্ব করার সুযোগ পেতাম।