অনুপ্রেরণা দরকার? সময় করে মুভিটি দেখতে বসুন। সিমপ্লি ওয়ান অফ দা বেষ্ট স্পোর্টস্ বেইজড্ মুভি আই হ্যাভ এভার সিন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ‘মাদিবা’ নামে। থেম্বু গোত্রভুক্ত হওয়ায় এ নাম তার। উনিশ শতকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের ত্রানসকেই অঞ্চল শাসন করতো থেম্বু গোত্রপতি মাদিবা। ‘মাদিবা’ নামে ডেকে তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়, এ ভালোবাসা শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ নয়। সেদেশের গণতন্ত্রের জনক হওয়ার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার অনেকে তাকে ডাকেন ‘তাতা’ বলে। এস্কোসা ভাষায় যার অর্থ ‘বাবা’।

জগতে কেউ কেউ জন্মায় যারা পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাসে জানার মধ্যেই নিজের বিচরণ আবদ্ধ করে রাখেন না, বরং নিজেরাই ইতিহাস সৃষ্টি করে যান। এমনই একজন নেলসন ম্যান্ডেলা। জন্মগ্রহন করেন ১৯১৮ সালের ১৮ই জুলাই। ১৯৪৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আফ্রিকানদের ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। দলটি বর্ণবাদ ও বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করে রাখার পক্ষপাতী ছিলো। এ প্রেক্ষাপটে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র সংগঠন উমখন্তো উই সিযওয়ের নেতা হিসেবে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৫ সালের জনগনের সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ সম্মেলনে মুক্তির যে সনদ প্রণয়ন করা হয়, সেটাই ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি; যে ভাবনাটি পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। ১৯৬২ সালে তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে দুই দফায় দির্ঘায়িত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ম্যান্ডেলা সর্বমোট ২৭ বছর কারাবাস করেন। তন্মধ্যে দীর্ঘ ১৮ বছর ছিলেন রবেন দ্বীপে। ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি এ আপোষহীন নেতা কারামুক্ত হন।

১৯৯৪ হতে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত মাত্র পাঁচ বছর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। অথচ আমাদের এশিয়ার ক্ষমতাবান স্বৈরাচারী নেতাদের মতো চাইলে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। কেননা তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি। একদা নাশকতার অভিযোগে যাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছিলো, সেই মানুষটাই ১৯৯৩ সালে ভূষিত হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কারে। শুধু তাই নয়, গত চার দশকে ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার ম্যান্ডেলা পর্যন্ত পৌছানোর গৌরব অর্জন করেছে। ২০১৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর, অর্থাৎ আজকের তারিখে ৯৫ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবার পূর্বে তিনি প্রমাণ করে গিয়েছেন যে এই পৃথিবীটা শুধু সাদা রঙা মানুষের নয়।

একবার কল্পনা করুন তো, বর্ণবাদের প্রতিবাদ করায় একটা মানুষকে ২৭টি বছর কারাবন্দী থাকতে হলো, যার মধ্যে এক দ্বীপেই ছিলেন টানা ১৮ বছর! কি এমন অনুপ্রেরনায় এতটা দীর্ঘ বিভীষিকাময় সময় পার করলেন তিনি? যদি বলি যে ঐ দুঃসময়ে তার অন্যতম সঙ্গী ছিলো এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ! তবে কি বিশ্বাস করবেন? প্রশ্ন জাগতেই পারে, কি এমন ছিল সেই কাগজে? ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ কবি উইলিয়াম আর্নেষ্ট হ্যানলে এর লেখা ইনভিক্টাস কবিতাটি লেখা ছিলো সেই ছেঁড়া কাগজে; A poem that inspired a nation through a prisoner who became their president. 

Nelson Mandela / Invictus Poem Typography

কবিতাটির লাইনগুলি এতটাই তীব্র যে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। আর যদি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভয়েজ আর্টিষ্ট স্বয়ং মর্গান ফ্রিম্যান আবৃত্তি করে শোনান, তবে? সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। কবিতাটিতে এতটাই প্রভাবিত হয়েছি যে এর নিজের মাতৃভাষায় অনুবাদ করবার লোভ সামলাতে পারিনি। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে পড়বার অনুরোধ রইলো।

প্রদোষকালের অস্পষ্টতা যা আমার অস্তিত্বকে আবৃত করে
মেরু থেকে মেরু বর্ণহীন অতলস্পর্শ গহ্বরে
কৃতজ্ঞতা জানাই সে যাহা-কিছুই হোক না কেন সৃষ্টিকর্তা
অদম্য অহং সে তো আমারই আত্মা

 

পরিস্থিতির নিষ্ঠুর খোলসে
সঙ্কুচিত হইনি কখনো কাঁদিনি সশব্দে
ঝুঁকির নিদারূণ প্রহারে
রক্তাক্ত তবু অদমিত মস্তকে

ক্রোধ এবং অশ্রুজল থেকে বহুদূরে
দুর্বোধ্যতার ভয়াবহ আলোছায়াতে
এবং ভীত বছরগুলোতে
সম্মুখীন হয়ে নির্ভীক চিত্তে

নিমিত্ত নয় সঙ্কীর্ণ দুয়ারে
অভিযুক্ত শাস্তির আলিঙ্গনে

আমি মনিব আমার পরিণতির
আমি কর্ণধার আমার আত্মার

Invictus শিরোনামে কবিতা থেকে চলচ্চিত্রে রপান্তরিত হয়ে সিনেমা থিয়েটারে মুক্তি পায় ২০০৯ সালের ১১ই ডিসেম্বর। জন কার্লিনের বিখ্যাত জীবনচরিত উপন্যাস “Playing the Enemy: Nelson Mandela and the Game that Made a Nation” অবলম্বনে ১৩৪ মিনিট দৈর্ঘ্যর চিত্রনাট্য লেখা হয়। চিত্রনাট্য লেখেন এন্থনি পেখ্যাম। উল্লেখ্য যে, সত্য ঘটনার উপরেই নির্মিত হয় বায়োগ্রাফি, ড্রামা, হিস্টোরি, স্পোর্টস্ জনরার এই মুভিটি। আইএমডিবি’তে যার রেটিং ৭.৪, মেটাক্রিটিকে স্কোরও ৭৪, রটেন টমাটোতে ফ্রেশনেস ৭৬%। পরিচালনা করেছেন, লিজেন্ডারি ক্লিন্ট ইষ্টউড। 

অর্থনৈতিক ও জাতিগতভাবে নিজেদেরই মধ্যে বিভক্ত দক্ষিন আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে। তখনো দক্ষিন আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষ এতটাই প্রকোট ছিলো যে খেলাধুলাতেও এর মারাত্মক প্রভাব ছিলো। ম্যান্ডেলা খেয়াল করলেন যে, সেদেশের রাগবি ম্যাচে শ্বেতাঙ্গরা দক্ষিন আফ্রিকার এবং কৃঞ্চাঙ্গরা ইংল্যান্ডের সমর্থন করতো। ম্যান্ডেলা চাইলেন বিশ্বজনীন ভাষা ‘খেলাধুলা’ এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ দূর করে, নিজ দেশকে অনুপ্রেরিত এবং একত্রিত করতে। ঠিক যেভাবে তিনি নিজে কারাবন্দী জীবনে অনুপ্রেরিত হয়েছিলেন। যতটা সহজে বর্ননা করলাম, ম্যান্ডেলার জন্য ততটাই কঠিন ছিলো কাজটি করে দেখানো।

ম্যান্ডেলা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মরগান ফ্রিম্যান

ম্যান্ডেলা চরিত্রে মর্গান ফ্রিম্যান এবং ফ্রান্সোয়া পিয়েনা চরিত্রে অভিনয় করেছেন ম্যাট ড্যামন। ম্যান্ডেলা নিজে বলেছিলেন যে সেল্যুলয়েডে কেউ যদি তাকে যাথাযথভাবে ধারণ করতে পারে তবে সে হচ্ছে একমাত্র মর্গান ফ্রিম্যান। তাই নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতি সম্মান রেখে, মর্গান ফ্রিম্যানকেই সরাসরি মুভিটিতে কাষ্ট করা হয়। সিনেমায় মর্গানের ঐশ্বরিক কন্ঠে ইনফিক্টাসের আবৃত্তি এবং ভিজুয়ালাইজেশন কবিতাটিকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ২টি অস্কার নমিনেশনসহ বিভিন্ন পুরষ্কারে মোট ২১ নমিনেশন এবং ৮টি পুরস্কার লাভ করে মুভিটি। মর্গান ফ্রিম্যান সেরা অভিনতা এবং সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে ম্যাট ড্যামন অস্কারে নমিনেশন পান।

অনুপ্রেরণা দরকার? সময় করে মুভিটি দেখতে বসুন। সিমপ্লি ওয়ান অফ দা বেষ্ট স্পোর্টস্ বেইজড্ মুভি আই হ্যাভ এভার সিন। অতিমাত্রায় দুর্দান্ত! মুভিটির ব্যাকরাউন্ড স্কোরের মতো নির্মাণশৈলীও বেশ ক্যাচি। মর্গান ফ্রিম্যান সম্পর্কে নতুন করে আর বলবার কিছু নেই, মুভিটিতে কথা বলার ধরন থেকে অঙ্গভঙ্গি সবকিছুতেই ম্যান্ডেলাকে চমৎকারভাবে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ম্যাট ড্যামনও সুপার্ব সাপোর্ট দিয়েছেন, এই মানুষটার কথা আলাদা করে না বললেই যেনো নয়; দেখলেই কেমন যেনো এক্সট্রাঅর্ডিনারি মনে হয়। ইট ফিলস্ লাইক হি নৌজ উই আর ব্যাড বাট স্টিল লাভস্ আস এনিওয়ে। দুনিয়াজুড়ে খুউব সুন্দর করে হাসতে জানা মানুষদের মধ্যে একজন এই ম্যাট ড্যামন।

আরেকটি ব্যাপার, মুভিটি যিনি নির্মান করেছেন তার নাম ক্লিন্ট ইষ্টউড। যতটা না ভালো অভিনেতা, কিন্তু পরিচালক হিসেবে তার চেয়েও দুর্দান্ত! যদিও আমেরিকান স্নাইপারের মতো প্রপাগান্ডা উনার কাছে থেকে এক্সপেক্ট করিনি তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি উনার ভুল ধরবার যোগ্যতা আমার আদৌ হয়নি, কোনোদিন হবেও না বোধ হয়।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা