আর ক'জন দম্পতি এই 'আহলে কিতাব' লজিক ব্যবহার করে বিয়ে করতে পেরেছেন? আর ক'জন নিজের ছেলের নাম রেখেছেন 'কৃষ্ণ মুহাম্মদ'? এই যুগে কেউ ওরকম করলে ব্লাসফেমি দিয়ে গলা কাটা হতো, মার একটাও মাটিতে পড়তো না...

হাইকোর্ট, বিয়ে আর কাজী নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে মনে পড়লো, আমাদের ইতিহাসের সবচে' পপুলার কাজী যিনি। উনার বিয়ের ঘটনা। 

তো আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিয়ে করতে যাচ্ছেন শ্রীমতি  আশালতা সেনগুপ্তকে। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল নজরুল আর আশালতার বিয়ের দিন ধার্য হয়। কিন্তু এ তো স্বাভাবিক বিয়ে নয়। ছেলে মুসলমান। আর মেয়ে হিন্দু।

ইতোমধ্যে যুবক নজরুল মসজিদের মুয়াজ্জিন হওয়া থেকে শুরু করে  মোল্লাদের দেয়া কাফের কবি উপাধি পাওয়া- সবকিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করে ফেলেছেন। ওইদিকে পাত্রী আশালতার পরিবার সম্ভ্রান্ত উচ্চবর্ণের হিন্দু। বাবা ত্রিপুরা রাজ পরিবারের সিনিয়র আমলা। পাওয়ারফুল ফ্যামিলি। 

তো অনেক সামাজিক গুঞ্জন ও বাঁধার সৃষ্টি হতে পারে, তাই অনেকটা চুপচাপেই বিয়ে আয়োজন হয়। আশালতার মা গিরিবিলা দেবী ছাড়া এই বিয়েতে কারও মতামত নাই মেয়েপক্ষের। বিয়ের প্রথমেই যে সমস্যা বাঁধে তা হল: কোন ধর্মমতে বিয়ে হবে? ক্লিয়ারলি হিন্দু মতে ভিন্ন ধর্মের কারও সাথে বিয়ে হতে পারে না।. তো এখন বিয়ে হতে পারে এক স্পেশাল সিভিল ম্যারেজ এক্টে অথবা ইসলাম ধর্মমতে।

কিন্তু স্পেশাল সিভিল ম্যারেজ আইন অনুযায়ী বর কনে উভয়কেই  এই লিখিত স্বীকৃতি দিতে হয় যে, তারা নাস্তিক, কোন ধর্ম মানেন না। কবি নজরুল এতে প্রবল আপত্তি জানান। তিনি বলেন, ‘আমি মুসলমান-মুসলমানী রক্ত আমার শিরার শিরায় ধমনীতে ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে, এ আমি অস্বীকার করতে পারব না’।

এবার কাজী অফিসে উপস্থিত অনেকেই প্রস্তাব দিলেন, আশালতাকেই  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে। কবি এতেও আপত্তি তুললেন। রেগে গিয়ে বললেন- ‘কারুর কোন ধর্মমত সম্বন্ধে আমার কোন জোর নেই। ইচ্ছে করে তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করলে, পরেও করতে পারবেন। কিন্তু আজকে আমাকে বিয়ে করার জন্য ওর ধর্ম পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। মানে বিয়ের জন্য আশালতা নিজের হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করুক- নজরুল এটা চান নাই। 

এই বিয়ের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন ছড়াকার খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন। উনি ব্যক্তিগত জীবনে অনেক ধার্মিক ছিলেন। তার 'যুগস্রষ্টা নজরুল' গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “কবির মতামত মেনে নিয়ে আমাদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হল যে,  শুধু আহলে কেতাবিদের সঙ্গে স্ব স্ব ধর্ম বজায় রেখে বিয়ে হওয়া ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ নয়। ইহুদি আর খ্রিস্টানরা আহলে কিতাব। তাদের বিয়ে করা যায়। এখন কথা হচ্ছে হিন্দুগণ ‘আহলে কিতাব’ কিনা?

নজরুল এবার পাল্টা যুক্তি দিলেন- শ্রীকৃষ্ণ কি নবী হইতে পারেন না? এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন। কোরআনে লেখা আছে মাত্র কয়জন। যারা সবাই আরবের। তো এই সকল পয়গম্বর যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। ভারতবর্ষেও পয়গম্বরের আবির্ভাব অসম্ভব নয়। অতএব, এ বিয়ে অন্যায় হবে না”

শেষে নজরুলের 'শ্রী কৃষ্ণ আর আহলে কিতাব' বিষয়ক যুক্তি মেনে, ১০০০ টাকা দেনমোহর ঠিক করে নজরুল-আশালতার বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর কবি নজরুল আশালতাকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করতে দেন নি। এমনকি আশালতার নাম দেন 'প্রমিলা দেবী'। পুরাণের বিপ্লবী নারীর নামে। তার সম্মানার্থে  নিজের বাড়িতে পূজা অর্চনার পৃথক কক্ষ করে দেন। 

কবির বন্ধু মোজাফফর আহমদ আর পল্লীকবি জসীম উদদীনের লেখায় পাওয়া যায়- কত পরমত সহিষ্ণু, আন্তরিকতাপূর্ণ দাম্পত্যজীবন ছিল তাদের। ওই সময়ের বাকী মহারথীদের সবাই যখন দাম্পত্য জীবনে টানাপোড়েনের হিস্ট্রি রেখে গেছেন। সেখানে নজরুল এত বৈপরীত্যের পরও, এত স্ট্রাগলের পরেও ভালো ক্রেডিট দেখিয়েছেন। 

তো আমি মাঝেমধ্যেই টাশকি খাই, দুই-তিন বছর পর প্রায় ১০০ বছর হবে এই বিয়ের। আর ক'জন দম্পতি এই 'আহলে কিতাব' লজিক ব্যবহার করে বিয়ে করতে পেরেছেন? আর ক'জন নিজের ছেলের নাম রেখেছেন 'কৃষ্ণ মুহাম্মদ?' এই যুগে কেউ ওরকম করলে ব্লাসফেমি দিয়ে গলা কাটা হইতো। মাইর একটাও মাটিতে পড়তো না। 

যাই হোক, নজরুলের যে কালোত্তীর্ণ সৃষ্টিযজ্ঞ, মানে কয়েকশো বছরেও এরকম সৃজনশীল কেউ আসবে না, সেই স্পিরিটের নার্চারিং করতে পেরেছিলেন তার স্ত্রী৷ 

আশালতা ওরফে প্রমীলা দেবী যখন প্যারালাইজড হলেন। উনার চিকিৎসার জন্য নজরুল সর্বস্ব উজার করে টাকার খোঁজে বের হতেন।  দীর্ঘ পরিশ্রম শেষে, উনার পাশে বসে বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করতেন। বছর কয়েকের মধ্যে, তিনি নিজেও বাকশক্তিহীন হয়ে গৃহবন্দী হলেন।

তো আরও  একজন মহীয়সী নারী ছিলেন তাদের জীবনে। বিকলাঙ্গ বাকশক্তিহীন নজরুল, উনার প্যারালাইজড স্ত্রী আর এতগুলো বাচ্চাকাচ্চাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন- শ্রী গিরিবালা দেবী। নজরুলের শ্বাশুড়ি।

কবির বন্ধু মোজাফফর আহমদের বয়ানে আমরা জানবো- এই মহীয়সী নারী নিজের ত্রিপুরার প্রাসাদসম বাড়ি ছেড়ে, মেয়ের বাড়িতে খাটুনি দিচ্ছেন। বিছানায় প্যারালাইজড  মেয়ে, আর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মেয়ের জামাইকে- একসাথে ভাত তুলে খাওয়াচ্ছেন। এমন দৃশ্যও দেখা যেত।

যদিও তার কয়েক যুগ পর আমাদের জনপদের স্কুলগুলোর ইন্টারেস্টিং বাংলা টিচাররা থিওরি আবিষ্কার করে আমাদের জানাবেন- রবীন্দ্রনাথের ষড়যন্ত্রে এক এতিম হিন্দু গরীব মেয়ে বিয়ে দিয়ে নজরুলকে পাগল বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। নোবেলটা যাতে রবী ঠাকুরই পান! 

অথচ তখন ক্রসচেক করার সুযোগ ছিল না যে, যে বছর বুড়ো রবীন্দ্রনাথ নোবেল পান, নজরুল আমাদের বয়সের কাছাকাছি এক নিতান্ত কিশোর ছিলেন। 

ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা পড়তে গিয়ে মিলেছিল আরেক ইন্টারেস্টিং তথ্য। 
সারাজীবনের দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম অনুভবের দিন। নজরুল প্রথম যেবার জিহবা আড়ষ্ট হয়ে জ্বর আসছে' অনুভব করছিলেন, তখন তিনি রেডিওতে রেকর্ডিং-এ। আর ইন্টারেস্টিংলি ওই সময়ে রেকর্ড করছিলেন প্রয়াত রবীন্দ্রনাথের স্মরণে লেখা 'রবি-হারা' শোক কবিতাটি। 

এখন যেহেতু গুজবের ডালাপালা  আর অপপ্রচার ভুলে বই পড়ার, ক্রসচেক করার সুযোগ আছে। পড়া যেতে পারে-  কবির বন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনের "যুগস্রষ্টা নজরুল'। কবির আরেক  বন্ধু মোজাফফর আহমদের 'নজরুল স্মৃতিকথা'। কবির  আরেক ক্লোজ ছোটভাই পল্লীকবি জসীম উদদীনের স্মৃতিচারণও পড়া যেতে পারে। 
অন্য লেখকদের বই পড়ার অবসর না পেলেও।

বাংলা সাহিত্যের তো বটে, বাঙালী ইতিহাসে এমন বৈচিত্র্যময়- এমন মেলানকোলিক এক ক্যানভাস মার্কা জীবন আর কার ছিল! কতটুকুই জানলাম আমরা, ওই কাজীর জীবন! মনোটোনাস পাঠ্যবই, ক্লিশে ক্লাসরুম আর ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের লেকচারের বাইরে!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা