গোয়েবলসের সূত্রই ছিল- “একটা মিথ্যাকে দশবার বলো, একশোবার বলো, সেটা সত্যির মতো শোনাবে।”

‘তিলকে তাল বানানো’ বাগধারাটির কথা আমরা প্রায়ই শুনি, মাঝেমধ্যে নিজের চোখে এর নজিরও দেখা যায়। কিন্ত গণমাধ্যমে তিল থেকে তালের উদ্ভবটা কার হাতে হয়েছিল, সেটা অনেকেই জানেন না। মানুষটাকে ভদ্রলোক বলা যাবে না কোনমতেই; নাম তার জোসেফ গোয়েবলস, ছিলেন হিটলারের প্রচারমন্ত্রী। যা কম্মিনকালেও ঘটার সম্ভাবনা নেই, এমন ঘটনা ঘটেছে রব তুলতে যার জুড়ি ছিল না। শুধু ভাষণ-বক্তৃতায় নয়, খোদ রেডিও-খবরের কাগজে গুজবের বেসাতি ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেয়া আর স্বজাতির মনে সরকারের আনুগত্য সৃষ্টিটাই যার উদ্দেশ্য ছিল, সে মানুষটাই জোসেফ গোয়েবলস। 

খুব বেশিদিন আয়ু পাননি গোয়েবলস, বেঁচেছিলেন মাত্র সাড়ে সাতচল্লিশ বছর; এরমধ্যেই অর্ধেক দুনিয়ার ঘৃণা অর্জন করে নিয়েছিলেন নিজের কীর্তিকলাপে। নাৎসী পার্টিতে যোগ দেয়ার পরে ১৯২৫ সালে হিটলারের সাথে প্রথম দেখা হয় তার, রতনে যেমন রতন চেনে, তেমনি নিকৃষ্ট ব্যক্তিরাও একে অপরকে চিনে নেন খুব সহজেই। হিটলার বুঝে গিয়েছিলেন, তার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গোয়েবলসকে খুব দরকার। পরের বছরই পদোন্নতি পেয়ে গোয়েবলস হয়ে গেলেন নাৎসী পার্টির বার্লিন শাখার প্রধান।

দারুন জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারতেন, প্রতিপক্ষের ভুলত্রুটির সাথে মনগড়া তথ্য উপাত্ত মিশিয়ে তাতিয়ে দিতে পারতেন উপস্থিত শ্রোতাদের। তাই বেশ দ্রুত জনপ্রিয়তাও অর্জন করলনে, ১৯২৮ সালে নির্বাচিত হলেন জার্মান পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় এলেন, তার ডানহাত তখন গোয়েবলস। হিটলার মানুষ চেনেন, তিনি জানেন কাকে কোথায় বসাতে হবে, সেই অনুযায়ী তথ্য ও প্রচারণা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন গোয়েবলস; বলা ভালো, অপপ্রচারনা চালানোর দায়িত্বটাই দেয়া হল তাকে।

হিটলারের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগেই গোয়েবলস মনোনীত হলেন হিটলারের ক্যাবিনেট কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে। এর মধ্যে গণমাধ্যম খাতকে পুরোপুরি কব্জা করে নিলেন ধুরন্ধর এই ব্যক্তি। বিরোধীদলের পক্ষে বা নিরপেক্ষ কথা বলে, এমন পত্রিকাগুলো বন্ধ করা হলো শুরুতে, তাদের প্রচার-প্রকাশনাও সরকারী নজরদারীর আওতায় চলে এলো। জার্মানির রেডিও তাই বলে, যা গোয়েবলসের মুখে উচ্চারিত হয়, খবরের কাগজগুলো তাই ছাপায়, গোয়েবলসের অফিস থেকে যুদ্ধের যেসব খবর সরবরাহ করা হয়।

বলা বাহুল্য, এদের শতকরা ৯৯ ভাগই ছিল মনগড়া। আজ জার্মান সৈন্যরা রোমানিয়া আক্রমণ করেছে, কাল ডেনমার্ক দখল করেছে, পরশু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে বোমাবর্ষণ করেছে জার্মান বোমারু বিমান- এ ধরনের ভিত্তিহীন খবর শুনে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা তো বটেই, পিলে চমকে উঠতো খোদ জার্মান সেনাদেরও! নিজেদের বাহিনীর এমন সক্ষমতার কথা তো তারাও জানতেন না! 

রোজ রাতে ন্যাশনাল রেডিওতে ফুয়েরার হিটলার হাজির হতেন দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত করার জন্যে। হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে রেডিওর সাথে মাইক লাগানো হলো। শুধু জার্মান সরকারী রেডিও স্টেশন টিউন করা যায়, এমন একটা সস্তা রেডিও বাজারে ছাড়া হলো সরকারের ভর্তুকীতে।

গোয়েবলসের সূত্রই ছিল- “একটা মিথ্যাকে দশবার বলো, একশোবার বলো, সেটা সত্যির মতো শোনাবে।” এই কাজে হিটলার-গোয়েবলস জুটি বেশ সফলও হয়েছিলেন শুরুতে, অনেক জার্মান নাগরিকই এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, ইহুদিরা হচ্ছে এই পৃথিবীর জন্যে জঞ্জালস্বরূপ, তাদের খুন করায় কোন পাপ নেই। আর একমাত্র জার্মানদেরই অধিকার আছে পৃথিবীকে শাসন করার, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতি তারাই। 

তবে পাপের পতন তো একদিন হবেই, সেই সূত্র মেনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পতন ঘটলো, পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী ইভা ব্রাউনকে নিয়ে এই জার্মান ফ্যানাটিক আত্মহত্যা করেন ১৯৪৫ সালের ৩০শে এপ্রিল। জোসেফ গোয়েবলসও বুঝতে পারলেন, সময় ফুরিয়ে এসেছে তারও।

ফুয়েরারস’স বাঙ্কারের বাইরে মিত্রবাহিনীর বিমান থেকে একের পর এক নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বোমা, পদাতিক সৈন্যরা ঘিরে রেখেছে বার্লিন, একে একে ঢুকে পড়ছে শহরে। হিটলার আর ইভা ব্রাউনের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে দিলেন গোয়েবলস ও সহকর্মীরা, তারপর নিজেদের পালা। ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন কণ্যা ক্যাথরিন, পয়লা মে ছিল তার জন্মদিন। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে একে একে সবার দেহে মরফিন প্রয়োগ করলেন গোয়েবলস আর সেখানে উপস্থিত একমাত্র চিকিৎসক ডা. স্ট্যাম্পফিজার। একে একে সবাই ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। স্ত্রী ম্যাগদাকে গুলি করে পিস্তল ঠেকালেন নিজের মাথায়। তার কয়েক মূহুর্ত পরেই অবসান ঘটলো ঘটনাবহুল একটি নিকৃষ্টতম জীবনের। 

গোয়েবলস মরেছেন, তবে তার অনুসারীরা জীবিত আছেন, যুগে যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাদের পদচিহ্ন রেখে যাচ্ছেন কাজের মাধ্যমে। পাকিস্তান আমলে সরকার যেমন বাংলা ভাষাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিল, কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেভাবে মুক্তিসেনাদের দেশদ্রোহী ভারতের চর আখ্যা দেয়া হয়েছিল, সেই জার্মান গোয়েবলস পাকিস্তানী রূপে ফিরে এসেছিলেন আবার। কিংবা ২০১৩ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সাজা প্রদান করা হলে জামাত নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বা ফেসবুক পেজ বাঁশেরকেল্লা থেকে যেভাবে সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তাতে তো স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, গোয়েবলসের অনুসারী এই বঙ্গেও কম নেই। গোয়েবলসেরা মরে যান, মরে না তাদের হিংস্র স্বত্বা, মিলিয়ে যায় না তাদের অপপ্রচারের কুৎসিত রূপ।  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা