আরব সাগরে ডুবে যাওয়া সূর্য, নরওয়ের আকাশের অরোরা, আফ্রিকার দূর্গম বনজঙ্গল, পৃথিবীর স্বর্গ কাশ্মীর কিংবা এভারেস্টে প্রিয় মানুষটার হাতে হাতটা রেখে হারিয়ে যাওয়া যায়, এর চেয়ে বড় সুখ আর কী হতে পারে! আপনার প্রিয় শখ আর প্রিয় মানুষের সাথে একসাথে প্রতি সেকেন্ড বেঁচে থাকা যায়, এর চেয়ে বড় সুখ আর কী হতে পারে!

সময়কাল: জুলাইয়ের একদিন। 

ঘটনাস্থল: হাসন রাজার এলাকা, টাঙ্গুয়ার হাওর, সুনামগঞ্জ। 

আবহাওয়া: খারাপ না। শুধু আবহাওয়া অফিসের পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা উপহার দেয়া হয়েছে। বিপদ সংকেত বার্তা। মাঝে মধ্যেই ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। হাওর অঞ্চলের সৌন্দর্য দেখার মোটামুটি উত্তম সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিস্ট সোসাইটি তাই মরমি সাধক হাসন রাজার হাওর অঞ্চলের দিকে ঘুরার আয়োজন করলো। 

“আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে” 

সব মিলিয়ে চমৎকার আয়োজন।

শ্রাবণ মাসের এইসব দিনে হাওর যেন তার সবটুকু রুপ মেলে ধরে। হাওরের স্বচ্ছ জলের চাদরে মোড়া গোটা অঞ্চল। প্রকৃতি তার বৃষ্টি-সংগীত পরিবেশন করছে। প্রকৃতির আয়োজন দেখে স্থলের মানুষ এনামুল হাসান ওরফে হাটাবাবা মারাত্মক মুগ্ধ হচ্ছেন। নৌকার পাটাতনে তিনি বসে আছেন। বৃষ্টির ছিটা এসে পড়ছে তার মুখে। কিছুক্ষণ পর পর তিনি গামছা দিয়ে মুখ মুছছেন। মুখটা মুছেই গামছা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী স্টাইলে গলায় ঝুলিয়ে রাখছেন। হাটাবাবা ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যথাসময়ে সেই গল্প পাঠককে জানানো হবে। 

"ঘাম মুছে গলায় গামছা ঝুলায় রাখসে! এই খাটাস বেটাটা কে?" 

এনামুল হাসানের গামছা ঝুলিয়ে রাখার ব্যাপারটাতে মোটামুটি বিরক্ত হচ্ছেন এই ট্যুরের আরেক সদস্য। নুসরাত বাবর ন্যান্সি। যদিও এর আগে এই ছেলেটিকে তিনি দেখেননি। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ছেলেটির ভেজা গামছা গলায় ঝুলিয়ে রাখাটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না ন্যান্সির। হাসানও মনে মনে চিন্তা করছে, এই মেয়েগুলোর কি আর কোনো কাজ নেই? সারাক্ষণ শুধু সেলফি আর সেলফি! যদিও ন্যান্সির ফোন তখন চার্জবিহীন মরা হয়ে পড়ে আছে ব্যাগের মধ্যে। সেলফি তুলছে ন্যান্সির বান্ধবীরা। এই পরস্পরবিরোধী বিপরীতমুখী অনর্থক চিন্তা-ভাবনাগুলো হয়তো ভুলেই যাওয়ার কথা ছিলো।

কারণ, এরপর আবার তাদের কখনো দেখা হবে এমন সম্ভাবনা ছিলো খুবই ক্ষীন। তবুও একদিন দেখা হয়ে যায়। পরের ট্যুরটি হবে দিয়াবাড়িতে। ন্যান্সি গিয়েছিলেন টিএসসিতে। সেখানকার সিঁড়িতেই দ্বিতীয় বারের মতো দেখা হলো হাসান-ন্যান্সির। হাসান জিজ্ঞেস করলেন, "আপনারা এখানে কেন?" হয়তো প্রশ্নটার মধ্যে আন্তরিকতার চেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুরটাই ছিল বেশি। তাই ন্যান্সি আবারো বিরক্ত হলেন। দ্বিতীয়বারের দেখায়, দ্বিতীয়বারের মতো বিরক্ত। তারপর ২০১৬ মার্চের দিকের কথা। ন্যান্সির মা খুব অসুস্থ। রক্তের প্রয়োজন।

ফেসবুকে রক্ত চেয়ে স্ট্যাটাস দিলেন। হাসান সেখানে কমেন্ট করলেন, "আমি তো এক্সপেডিশনে,আপনার আম্মার রক্ত লাগলে বলবেন,আমি হলে না যেয়ে হাসপাতালে চলে আসবো।" এবার যদিও যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল, কিন্তু রক্ত ম্যানেজ হয়ে যাওয়ায় হাসানকে আর আসতে হয়নি। ফেসবুকে টুকটাক কথা হতো তাদের। যেমন- হাসান বলতো, আপনি ফেসবুকে এত খাবারের ছবি দিবেন না তো। দিবো একবারে ব্লক কিংবা আনফলো করে। হা হা হা। এরপর ন্যান্সি যখন সাজেক, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ট্যুরে গেলেন, তখন হাসান বললো, এরকম নেটওয়ার্কবিহীন জায়গা গিয়ে পড়ে আছেন কেনো? নেটওয়ার্কের মধ্যে না আসলে ঠিকমতো জ্বালাতন করা যাচ্ছে না! 

ন্যান্সি ও হাসান দম্পতির অ্যাডভেঞ্চারসমূহ 

এভাবে সম্পর্কটা সহজ হতে শুরু করেছে। রোজার মাস। হাসান পুরোপুরি ডুবে আছেন মাস্টার্সের থিসিস নিয়ে। হলে থাকেন। খুবই ব্যস্ততার মধ্যে দিন গুজরান করছেন। রোজার একদিন ন্যান্সির বুয়েটে ইফতার পার্টি ছিলো। এ উপলক্ষ্যে তিনি সবার জন্য ফালুদা আর পায়েশ রান্না করলেন। তার মনে হলো, আজ তো হাসান ভাইয়ের থিসিসের ডিফেন্স। তার জন্যেও একটু ফালুদা আর পায়েশ নিয়ে যাই। 

সেদিনও তুমুল বৃষ্টি। হাসানকে বারবার ফোন দিচ্ছেন কিন্তু সে একবার ফোন ধরে বলে দেখা করতে পারবে না। কাকভেজা হয়ে হাতে টিফিনবক্স নিয়ে নিরুপায় হয়ে ন্যান্সি বলেই দিলেন, "হাসান ভাই আমি তো আপনার জন্য কিছু খাবার এনেছিলাম, হলে দিয়ে যাই? আপনি দেখা না করলেও সমস্যা নাই, কাউকে পাঠিয়ে দেন, হাতে হাতে দিয়ে দিব।" ইফতারির পর হাসান নিজেই আসলেন টিএসসিতে। খাওয়া শেষে সেখান থেকে চানখানপুলের দিকে চা খাওয়ার জন্যে গেলেন তারা।

দেখতে দেখতে ন্যান্সির জন্মদিন আসলো। জন্মদিনে হাসান দেখা করতে এলেন না। হাসান পর দিন থেকে অবিরত মেসেজ, কল করছিলেন। কিন্তু এবার ন্যান্সি বলে দিলেন কোনো কথা হবে না। এটাই সাফ কথা। পরে হাসান বুঝিয়ে বললেন। এক্সপিডিশনের জীবন, পড়ালেখা, মায়ের কথা। মন প্রাণ খুলেই হাসান বুঝালেন কেন আসলে দেখা করা যায় না চাইলেই। এরপর তারা উত্তরবঙ্গ সফরে গেলেন। এই ট্যুরে বোঝাপড়া আগের চেয়ে ভালো হলো। তবে সম্পর্কটা সবচেয়ে ইউটার্ন নেয় বান্দরবান ট্যুরে গিয়ে।

ন্যান্সির প্রথম ট্রেকিং ট্যুর। হাসানের জন্য ট্রেকিং অবশ্য ডালভাত। কারণ, তার আরেকনাম হাটা বাবা। আচ্ছা হাটাবাবার ব্যাখ্যাটা এই সুযোগে দিয়ে দেয়া যায়। একদম ছোটবেলায় হাসানের বোন মারা যায়। টিকার সাইড এফেক্টে। তাই হাসানকে আর টিকা দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহবোধ করেননি তার মা। হাসানের পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন তার পায়ে ইট বেঁধে রাখা হয়েছিলো। ডাক্তার বলেছিলেন, "এই ছেলে কোনোদিন পায়ে ঠিকভাবে দাঁড়াতেই পারবে না!" কিন্তু হাসান দুর্বলতাকেই বানিয়েছেন তার সবচাইতে বড় শক্তি। ২০১০ সাল থেকেই হাসান সলো এক্সপিডিশন শুরু করেন।

সেবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন। কিন্তু গাড়িতে না, ট্রেনে না, উড়োজাহাজে না; তিনি যাবেন সম্পূর্ণ পায়ে হেঁটে। ছয় দিনে। কিন্তু দ্বিতীয় দিনেই পায়ের মধ্যে পানি জমে যায়। পায়ের টারসাল স্থানবিচ্যুত হয়। অবর্ণনীয় ব্যথায় অঙ্গার হচ্ছিলেন ভেতরে ভেতরে। কুমিল্লার মেডিকেল থেকে বললো, দুই সপ্তাহ বিশ্রাম নিন। কিন্তু হাসান পরদিনই আবার এক্সপিডিশন শুরু করেন। আবারও ব্যথা শুরু হয়। ভাবলেন এভাবে তো সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকায় ফিরে যাবেন। কী মনে করে আবার চিন্তা করলেন অন্তত ফেনী পর্যন্ত কষ্ট করে যাওয়া যাক।

খোঁড়াতে খোঁড়াতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ওখানে একটা গ্রামে পৌছে যান। গ্রামের নাম বসন্তপুর। তিনি বলেন, "মেঘাচ্ছন্ন একটা দিন, সারি-সারি ফসলের মাঠ আর ঐপাশে ভারতের সীমান্ত। ঐ পড়ন্ত বিকেলে সেই গ্রামের দৃশ্য দেখে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাই যে আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল স্বর্গ এরচেয়ে সুন্দর হওয়া সম্ভব না। এবং ঐ সময় টা আমার জন্য টনিকের মতো কাজ করেছিল। আমার পায়ের ব্যথা ভুলে আমি সীমান্তের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড জোরে হাটা শুরু করি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।" যার কখনো ঠিকভাবে হাঁটবার কথা নয় সেই হাসান এখন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এক্সপিডিশনে বের হয়ে যান।

তার কথা একটাই, "Never lose hope, Never Stop Expedition." বান্দরবান ট্যুরের গল্পে ফেরত আসি। হাসান-ন্যান্সিসহ মোট এগারোজন গিয়েছিলেন ট্যুরে। উদ্দেশ্য কেওক্রাডং জয় করবেন। ন্যান্সির প্রথম ট্রেকিং ট্যুর ছিলো সেটি। মাইগ্রেনের ব্যাথা, বমি সব মিলিয়ে অসুস্থই হয়ে পড়লেন তিনি। রুমা বাজার থেকে বগালেক হয়ে চিংড়ির ঝর্না পর্যন্ত গিয়েছিলেন কষ্ট করে। এরপর আর পারলেন না। সবাই চলে গেল কেওক্রাডংয়ের পথে। শুধু ন্যান্সির পাশে থেকে গেলেন এনামুল হাসান। ন্যান্সি ভেতরে ভেতরে দারুণ আন্দোলিত হলেন। তার একটি প্রবাদ বাক্যের কথা মনে পড়লো। “কাউকে চিনতে চাও, তবে তার সাথে সফরে যাও!” 

তার জন্যেই একমাত্র কেওক্রাডংয়ের এত কাছে এসেও থেমে গেল ছেলেটা। ন্যান্সি হয়তো সেদিনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, এই ট্রাভেলমেটকেই সোলমেট করবেন। কেওক্রাডং- এ এনামুল হাসান এবং নুসরাত বাবর ন্যান্সি আবারও এসেছিলেন। এবার আর কোনো সমস্যা হয়নি। বৌদ্ধ পূর্ণিমার রাত। আকাশে ফানুশ উড়ছে। পৃথিবী ভর্তি চাঁদের আলো। এমন একটি রাতে যখন হাসান–ন্যান্সি কেওক্রাডং পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন তারা বিবাহিত।

হাসানকে কেউ যখন বিয়ের কথা বলতো সে বলতো, 'যেই মেয়ে আমার সাথে এক্সপেডিশনে যাবে, জোঁক কামড়ালে আমার পা থেকে জোঁক ছাড়িয়ে দিবে, এমন কাউকেই বিয়ে করবো।' ন্যান্সি যখন বিয়ের কথা ভাবতো, সেও চিন্তা করতো একজন ট্রাভেলফ্রিকের কথা। যে কালেভদ্রে একদিন পিকনিক করা টাইপ ট্রাভেলার হবে না, যে সত্যিকারের ট্রাভেলার হবে। যে সাথে থাকলে মন খুলে ঘুরা যাবে গোটা পৃথিবী। তাদের দুইজনের ইচ্ছেই পূরণ হয়েছে। ২০১৭ সালে বৈশাখের প্রথম দিনে তাদের বিয়ে হয়। 

সেই প্রথমবার হাওরের ট্যুর, তারপর দিয়াবাড়ির ট্যুরের ছবি অনেক দিন পর ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা গেলো, তাদের দুইজনের সিট ছিলো পাশাপাশি। অথচ তখন তাদের মধ্যে বিরাজমান ছিলো অনর্থক বৈরিতা। কে জানতো, এরপর তারা যে জনমের জন্যে পাশাপাশি থাকবে, এই টিকেট প্রকৃতি তখনই বুকিং দিয়ে রেখেছিল! ট্রাভেল+সংসার নিয়ে একটা অদ্ভুত ড্রিমের কথা বললেন ন্যান্সি। 

“একটা কাভার্ড ভ্যানের মতো থাকবে। সেটার মধ্যেই হবে আমাদের ছোট্টখাট্টো সংসার। আর ওই ভ্যানটা নিয়ে আমরা সব জায়গায় ট্রাভেল করবো ইনশাআল্লাহ্‌। আজ না হয় কাল, একদিন না একদিন এই স্বপ্ন সত্যি হবেই।” আচ্ছা সুখ কি দূরের কোনো অলীক বস্তু? অন্য গ্রহের কোনো অধরা অনুভূতি? নাকি সুখ হচ্ছে আগামী দশ বছরের ব্যস্ত শিডিউল? কিংবা সাফল্য সাফল্য সাফল্য বলে তার পেছনে ছুটে চলার মানেই সুখ? সুখ মানেই কি অপেক্ষা? নাকি সুখ মানে শুধুই ভবিষ্যৎ-এর কোনো প্রাপ্তি যার দেখা এই বর্তমানে নেই?

আরব সাগরে ডুবে যাওয়া সূর্য, নরওয়ের আকাশের অরোরা, আফ্রিকার দূর্গম বনজঙ্গল, পৃথিবীর স্বর্গ কাশ্মীর কিংবা এভারেস্টে প্রিয় মানুষটার হাতে হাতটা রেখে হারিয়ে যাওয়া যায়, এর চেয়ে বড় সুখ আর কী হতে পারে! আপনার প্রিয় শখ আর প্রিয় মানুষের সাথে একসাথে প্রতি সেকেন্ড বেঁচে থাকা যায়, এর চেয়ে বড় সুখ আর কী হতে পারে!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা