একই ছাদের নীচে যে মানুষটির সাথে আপনি বেঁচে থাকেন প্রতিদিন, নরম সকালে ঘুম ভাঙ্গলে যার মুখখানি থাকে বেডসাইট এ্যালার্ম ল্যাম্পের থেকেও কাছে, চরম নির্ভরতায় যে জড়িয়ে রাখে আপনাকে-পরিবারকে-সন্তানদেরকে, একদিন শুনলেন, সে আর আপনার নেই। হয়ে গিয়েছে অন্য কারো। কেমন লাগবে?

অনুপম রায়ের মতন 'তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর' বলতে যে পাথরশক্ত হৃদয় লাগে সেটুকু আমাদের থাকে না সবার। মানুষ দুর্বল। ভেতরটা বালির বাঁধ৷ একটু জলোচ্ছ্বাসেই সবকিছু ভেসে যায়। তবু ভেতরটা যা-ই হোক, ওপরটা রাখতে হবে চৈত্রের মাটির মতো খটখটে শুকনো। শীতল ভেজা চোখ দেখানো যাবে না কাউকেই। বুকের মধ্যে ছুরি নিয়েও হাসতে হবে। হয়তো ভালোবাসতেও হবে। এটাই জীবন। এভাবেই জীবন।

একজন মানুষের গল্প বলি। তাঁর নাম এখানে গুরুত্বপূর্ণ না খুব। তাও নামটা বলি, নাম কাওয়াস মানেকশ নানাবতী। ছিলেন ইন্ডিয়ান নেভির কমান্ডার। শিরদাঁড়াটা বরাবরই উঁচু। দেশকে রক্ষার জন্যে সম্মুখসারির যোদ্ধা হওয়ার সৌভাগ্য তো সবার হয় না, তাঁর হয়েছিলো। তিনি তাঁর কাজটিই করতেন মন দিয়ে। আপ্রাণ চেষ্টা করতেন যতটুকু যা পারা যায় করার। প্রত্যেক দেশেই এরকম কিছু নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক মানুষ থাকে, যাদের ভরসায় মানচিত্র নিশ্চিন্তে ঘুমায়। আমাদের নানাবতীও সেরকম।

কোনো একদিকে সবটুকু দিয়ে দিলে অন্যদিকে একটু টানাপোড়েন হয়। এটাই নিয়ম। ঘরে ইংরেজ স্ত্রী সিলভিয়া ও তিন সন্তান। তাদের সেভাবে সময় দেয়া হয়ে ওঠে না। দেশের জন্যে কাজ তো চাট্টিখানি না মোটেও। কাজের ব্যস্ততা থাকেই। কিন্তু স্ত্রী একাকীত্বে ভুগতে থাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে। এরইমধ্যে তার পরিচয় হয় এক ধাপ্পাবাজের সাথে, নাম প্রেম ভগবানদাস আহুজা।

পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, সেখান থেকে প্রণয়, সেখান থেকেই বাকি সবকিছু। হুট করে সিলভিয়া হয়ে যায় প্রেম আহুজার প্রণয়িনী, অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে দুজনেই। নানাবতী তখন কোথায়? কাজ। দেশের জন্যে কাজ।

নানাবতী ও তার স্ত্রী সিলভিয়া

সিলভিয়ার সাথে আহুজার শারিরীক সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়। একদিন সিলভিয়া আহুজাকে জানায়, সে তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে আহুজাকে বিয়ে করতে চায়। আহুজা প্রত্যাখান করে। আস্তে আস্তে সিলভিয়া জানতে পারে আহুজার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। জানতে পারে তার সাথে রয়েছে আরো অজস্র মহিলার সম্পর্ক। প্রেম আহুজার মুখোশ টুপ করেই খসে পড়ে টিকটিকির লেজের মতন। 

পরবর্তীতে প্রেম আহুজার সাথে সম্পর্কের এই কথাগুলো সিলভিয়া নানাবতীকে জানায়। নানাবতী সেদিনই একটা এ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে বাড়ি ফিরেছে। স্ত্রী'র কথায় টলে যায় সে। পায়ের নীচের মাটিও একটু আলগা হয়ে আসে বোধকরি। বিচলিত-ভাব কেটে যায় তাড়াতাড়িই। মনে মনে নিয়ে ফেলেন বিশাল এক সিদ্ধান্ত।  স্ত্রী সন্তানকে ম্যাটিনি শো'তে পাঠিয়ে নিজে যান নেভাল বেসে। নিজের সার্ভিস রিভলবার লোড করেন। লোডেড রিভলবার নিয়ে চলে যান প্রেম আহুজার বাড়িতে। তাকে জিজ্ঞেস করেন, সে সিলভিয়া ও তিন সন্তানের দায়িত্ব নেবে কী না। যদি নেয়, তাহলে সে তাঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে রাজি আছে। 

ঘটনার এই অংশে এসে আমি বরাবরই চমকে উঠি। একটা মানুষ বুকে কতটা পাথর বেঁধে নিজের এত বছরের প্রিয় স্ত্রীকে অন্য পুরুষের হাতে সন্তানসহ তুলে দিতে চাইতে পারে, সেটা ভেবে আমি বরাবরই চমকে উঠি। স্ত্রী'কে কতটুকু ভালোবাসলে, স্ত্রী'র সম্মান বাঁচানোর জন্যে একটা মানুষ তাঁর অনুভূতিগুলোকে অজ্ঞাত ব্যস্ত বাইপাসে ফেলে রেখে আসতে পারে, আমি বুঝে উঠি না। 

যাই হোক, প্রেম আহুজা সিলভিয়ার দায়িত্ব নিতে চায় না। মেরুদণ্ডহীন এই প্রাণীটি বলে- 'আমি যাদের সাথে শুয়েছি, সবাইকেই কি আমার বিয়ে করা লাগবে নাকি?'

এরকম কথা শুনলে আপনি-আমি কী করতাম? যেটা করতাম, সেটাই করেন নানাবতী। নিজের সার্ভিস রিভলবার থেকে তিনটি গুলি করেন প্রেম আহুজাকে। প্রেম আহুজা মারা যায় সঙ্গেসঙ্গেই। এই তিন গুলি পরবর্তীতে শিরোনাম হয়ে সুপার গ্লু'র মতো থেকে যায় ব্লিটজ এর বুকে। লেখা হয়- Three shots that shook the nation. 

থ্রী শটস দ্যাট শুক দ্য ন্যাশন! 

এরপর নানাবতী চলে যান ওয়েস্টার্ণ নেভাল কম্যান্ডে। নিজের অপরাধ স্বীকার করেন। তারা পরামর্শ দেয় নানাবতীকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্যে। নানাবতী পরে ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন৷

স্বাভাবিকভাবেই চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা মিডিয়ার প্রবল এ্যাটেনশন পায়। সবার সিম্প্যাথি পান নানাবতী এবং আবেগপ্রবণ জুরি বোর্ডও তাকে 'দোষী না' বলে স্বীকৃতি দেয়। এখানে বলে রাখা ভালো, জুরি বোর্ডের এই রায়ের কারণে ভারতের বিচারব্যবস্থা খোলনলচে পাল্টে যায় পরবর্তীতে। কীভাবে? সেটাই বলছি।

'কে.এম নানাবতী বনাম স্টেট অব মহারাষ্ট্র' কেসে জুরি বোর্ডের এই যুক্তিবিহীন, আবেগপ্রবণ, প্রশ্নবিদ্ধ 'দোষী না' সিদ্ধান্তের জন্যে  ভারতীয় বিচারবিভাগ থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয় ব্রিটিশদের প্রবর্তিত এ জুরি সিস্টেমকে। পরবর্তীতে ভারতীয় পেনাল কোডের সেকশন- ৩০২ অনুসারে নানাবতীকে অভিযুক্ত করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। 

যদিও পরবর্তীতে জনগনের বিক্ষোভ এবং প্রেম আহুজার বোন মমি আহুজার লিখিত অভিযোগ প্রত্যাহারের ভিত্তিতে নানাবতীকে এই হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে মুক্তি দেয়া হয়। এবং নানাবতী এরপর স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান কানাডায়। সেখানেই মৃত্যুর আগপর্যন্ত থাকেন তিনি। 

যারা এই পুরো লেখাটি পড়ে ফেলেছেন, তারা হয়তো মিলিয়েও ফেলেছেন এই কাহিনীটির সাথে একটি সিনেমার নাম। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। অক্ষয় কুমারের 'রুস্তম' সিনেমাটি এই কাহিনীর ওপরেই  বানানো। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি সিনেমার সাথে জুড়ে রয়েছে এই ঘটনাটি। গুলজারের 'আচানক', আর কে নায়ারের 'ইয়ে রাস্তে হ্যায় পেয়ার কি' সিনেমাগুলোও এই কাহিনীকে উপজীব্য করেই নির্মিত।

নানাবতীর এই ঘটনাটি আমাদের বুঝতে শেখায়, প্রিয় মানুষের সম্মান রক্ষার জন্যে, ভালোবাসা জিইয়ে রাখার জন্যে একটা মানুষ কতটা স্বার্থত্যাগ করতে পারে, কতটা দূরে যেতে পারে, সীমাহীন আবেগ চেপে রেখে কতটাই হতে পারে আবেগহীন। এখানেই কে.এম নানাবতীর চমৎকারিত্ব। ভালোবাসার জয়ও এখানেই। 

-

*প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা