বেতন কেটে নেয়ার ভয় দেখিয়ে কাউকে নামাজ পড়তে বাধ্য করাটা অপরাধ, নামাজ যে পড়বে সে আল্লাহকে ভয় পেয়ে পড়বে, জান্নাতের আশায় পড়বে। বেতন কাটার ভয়ে নয়।

ইসলামকে বলা হয় শান্তির ধর্ম, কারণ ইসলাম কখনও জোর জবরদস্তিকে সমর্থন করেনি, অন্য ধর্মের মানুষের ওপরে অত্যাচার করে তাকে ইসলামের ছায়ায় আনার ব্যাপারে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা ছিল শুরু থেকেই। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা) স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলেন, ধর্ম নিয়ে যাতে কোন জোরাজুরি করা না হয়। নবীর উম্মতেরা সেই কথা স্মরণে রাখেনি, আর তাই কর্পোরেট অফিসে, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর জোর করে নামাজকে চাপিয়ে দিতে চাইছে একদল ধর্মান্ধ উজবুক। পঁচিশ-ত্রিশ বা চল্লিশ বছর বয়েসী কাউকে যে নামাজের জন্যে জোর করতে হয় না, খোদাভীতি থাকলে যে একজন মানুষ স্বেচ্ছায় নামাজ পড়বে, এটা বোঝার জন্যে মাথায় কয় গ্রাম ঘিলু থাকা প্রয়োজন?

গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবস নামের একটি পোষাক কারখানায় একটা প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়েছে, সেই প্রজ্ঞাপনে বলা আছে- "সকল কর্মকর্তা, কর্মচারীদের জন্য অফিস চলাকালীন প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে যোহর, আসর ও মাগরিবের নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় পাঞ্চ মেশিনে পাঞ্চ করতে হবে। যদি কোন স্টাফ মাসে সাত ওয়াক্ত পাঞ্চ করে নামাজ না পড়েন তবে সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির বেতন হতে একদিনের সমপরিমাণ হাজিরা কর্তন করা হইবে।"

প্রথম কথা হচ্ছে, কোন আইনের বলে মাল্টিফ্যাবস কর্তৃপক্ষ নামাজ পড়ার জন্যে গণহারে সবাইকে (মুসলমান কর্মচারীদের) নামাজ পড়তে বাধ্য করছে? চাকরির চুক্তিপত্রের কোথাও কি উল্লেখ করা ছিল যে, নামায না পড়লে বেতন কাটা হবে অথবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে? এই অধিকারটা তাদেরকে কে দিয়েছে? 

মাল্টিফ্যাবসের সেই বিজ্ঞপ্তি

ত্রিশ-চল্লিশ বছর বয়স্ক একজন মানুষ নিজের ভালো-মন্দ খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারেন, তিনি যদি নামায না পড়েন সেটা তার ইচ্ছা, দায়ভার তার, হাশরের ময়দানে জবাবদিহি তিনি করবেন। এখানে উপযাজক হয়ে মাল্টিফ্যাবস কেন বাড়তি ওকালতি করার চেষ্টা করছে? আমার নামাজ আমি পড়বো কি পড়বো না সেটা আমার সিদ্ধান্ত, আল্লাহকে আমি কি জবাব দেবো সেটার ভার আমার ঘাড়েই থাকুক, সেখানে নাক গলানোর অধিকার তো আমার অফিসের, আমার চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের নেই। তাদের হয়ে আমি কাজ করছি, তারা আমাকে বেতন দিচ্ছে, এখানে পুরোটাই অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ধর্মের সম্পর্ক টানার বুদ্ধিটা মাল্টিফ্যাবসকে কে দিয়েছে?

মজা পেয়েছি মাল্টিফ্যাবসের কৈফিয়ত শুনে। নোটিশের ছবিটা ভাইরাল হবার পরে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, ফ্যাক্টরিটির অপারেশন্স বিষয়ক পরিচালক মেসবাহ ফারুকী প্রথমে দাবী করেছেন, এই নোটিশ নাকি শুধু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য। যদিও এই নোটিশে স্পষ্ট লেখা আছে যে, নিয়মটা 'সকল স্টাফের জন্যে প্রযোজ্য হবে'। 

এরপরে ফারুকী সাহেব চলে গেলেন ধর্মের ব্যাখ্যা দিতে, বললেন- "সবাই আমরা নামাজ পড়ি। আমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারী, আমাদের নামাজ পড়া ফরজ। এখানে মুসলমান যারা আছে তারা সবাই নামাজ পড়ে। কিন্তু তারা নামাজ পড়ে বিক্ষিপ্তভাবে।" প্রশ্ন হচ্ছে, কে বিক্ষিপ্তভাবে নামাজ পড়ে, কে পড়ে না, কে পাঁচ ওয়াক্ত পড়ে, সেটা দেখার দায়িত্ব তো কোম্পানীর নয়। এই অধিকার তাদেরকে কে দিয়েছে- সেই প্রশ্নের জবাব ফারুকী সাহেব দিতে পারলেন না। জবাব থাকলে তো দেবেন! 

এরপরে আরেকটা ফর্মূলার উদ্ভব ঘটালেন তিনি, বললেন, নামাজ পড়ার মাধ্যমে নাকি কর্মীদের মধ্যেকার দূরত্ব কমবে- "আমাদের এখানে বিভিন্ন মতভেদের লোক আছে। এখানে একটা টিম হিসেবে কাজ করতে হয়। এখানে ফ্যাব্রিক ডিপার্টমেন্টের সাথে নিটিং সেক্টরের হয়ত একটা সমস্যা থাকে। একেকজন একেকজনের উপর দোষারোপ সারাদিন চলতেই থাকে। তো আমি এটার সমাধান হিসেবে চিন্তা করলাম তাদের যদি একসাথে বসানো যায়, একসাথে কিছু সময় যদি তারা কাটায়, তাদের মধ্যে দূরত্বটা কমবে।"

নামাজ পড়তে বাধ্য করার অধিকার কি কারো আছে?

পাশাপাশি নামাজে দাঁড়িয়েই যদি সব মতভেদ দূর হয়ে যেতো, তাহলে মুসলমানদের মধ্যে খারাপ মানুষ আর থাকতো না একজনও। যে কাজ চায়ের টেবিলে করা যায়, সেটার জন্যে অহেতুক নামাজকে টেনে আনা হলো, নামাজকে ব্যবহার করা হলো অজুহাত হিসেবে। যাই হোক, এখানেই যদি ফারুকী সাহেব থামতেন, তাও হতো। তিনি এরপরে স্বাস্থ্যগত দিকটাও টেনে আনলেন, যুক্তিতে যখন আর পারা যাচ্ছিলো না, তখন জন্ম হলো কুযুক্তির, বললেন-

"সারাদিন বসে বসে কাজ করায় কোলেস্টেরল বাড়ছে, ডায়াবেটিস বাড়ছে। মসজিদ চারতলায় হওয়াতে কিছুটা ব্যায়ামও হচ্ছে।" 

স্বাস্থ্য নিয়ে এত চিন্তা থাকলে একটা জিমনেশিয়ামই খুলে দিতে পারতো মাল্টিফ্যাবস কর্তৃপক্ষ, নামাজের পেছনে পড়তে হলো কেন? এই ব্যাপারটা হয়তো দেখতে ছোটখাটো মনে হচ্ছে, কিন্ত এটা ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপরে একটা আঘাত। নামাজ পড়তে বলা, আর নামাজ পড়তে বাধ্য করা- দুটো এক জিনিস নয়। ইসলাম সালাতের পথে ডাকতে বলেছে, সালাত পড়ার জন্যে জুলুম করতে বলেনি। বেতন কেটে নেয়ার ভয় দেখিয়ে কাউকে নামাজ পড়তে বাধ্য করাটা অপরাধ, নামাজ যে পড়বে সে আল্লাহকে ভয় পেয়ে পড়বে, জান্নাতের আশায় পড়বে। বেতন কাটার ভয়ে নয়। 

ইসলামে ধর্ম নিয়ে জোর জবরদস্তি করতে নিষেধ করা হয়েছে, সংবিধানেও বলা আছে, ধর্ম কারো উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। কোন আইন দিয়েই এটা বাধ্যবাধকতা দেয়া যায় না। এই চাপিয়ে দেয়ার পেছনে কারা জড়িত, এদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। নইলে এসব ধর্মান্ধদের সংখ্যা বাড়বে ধীরে ধীরে, বিষফোঁড়ার মতোই এরা ঘুরে বেড়াবে আমাদের চারপাশে। আইএস নিয়ন্ত্রিত কোন অঞ্চলের সঙ্গে তখন বাংলাদেশের কোন পার্থক্যই থাকবে না আর...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা