রিক্সার গ্যারেজে নামাজ ও আমাদের একরোখা মানসিকতা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ইসলাম সবচেয়ে সহজ ধর্ম, সেটাকে জটিল করে তুলবেন না। মনে রাখবেন, মানুষের জন্যেই ধর্ম এসেছে, ধর্মে রজন্যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি। মানুষই যদি না বাঁচলো, তাহলে ধর্মটা পালন করবে কে?
আমাদের মতো ধান্ধাবাজ এবং সুযোগসন্ধানী জাতি বোধহয় বিশ্বের বুকে আর একটাও নেই। ১৭ই মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, গত মাসের ২৪ তারিখ থেকে সরকারী ছুটি ঘোষণা করে দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষজন ঘরে থাকে, করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়াতে না পারে, লাশের মিছিল লম্বা না হয়। মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডায় প্রার্থনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সোশ্যাল ট্রান্সমিশন যাতে বাড়তে না পারে। অথচ আমরা সেখানে রাস্তাঘাট-হাটবাজারে ভীড় জমাচ্ছি অযথাই, ছুটিটাকে পারিবারিক মিলনমেলা বানিয়ে ফেলছি, বারবার নিষেধ করা স্বত্ত্বেও জামাতে নামাজ পড়ার জন্যে ছুটছি, মসজিদ বন্ধ থাকায় বাসার ছাদে, রিক্সার গ্যারেজে জামাত করছি। তাহলে আর এই লকডাউনের গুরুত্বটা রইলো কোথায়?
করোনার প্রকোপ ঠেকাতে দেরীতে হলেও মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, এরপরেই শুরু হয়ে গেছে তৌহিদি জনতার আস্ফালন। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যে সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়েছে, সেটাকেই ধর্মের ওপর আঘাত হিসেবে দেখছেন এদেশের অনেক মানুষ। এরা বিশ্বাস করে, মসজিদে ভাইরাস ঢুকতে পারে না, এরা বলে, মহামারীতে মারা গেলে নাকি শহীদি মৃত্যু পাওয়া যায়। কিন্ত এই লোকগুলো এটা ভুলে যাচ্ছে যে, ভাইরাস ধর্ম চেনে না, হিন্দু-মুসলমান চেনে না, মসজিদ-মন্দির বোঝে না। পোষক দেহ থেকে আরেক দেহে ছড়ানোটা তার কাজ, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ মানুষের মধ্যে আছে, ভাইরাসের মধ্যে সেটা নেই।
অনেকগুলো ছবি সামনে এসেছে। দল বেঁধে লোকজন নামাজ পড়ছে বাসার গ্যারেজে, বাড়ির ছাদে, এমনকি রিক্সার গ্যারেজে একপাশ খালি করে সেখানে করা হচ্ছে জামাত, অংশ নিচ্ছে দশ-পনেরো জন লোক। আপনারা এটা কেন বুঝতে পারছেন না যে, এই মুহূর্তে সব ধরণের পাবলিক গ্যাদারিং এড়িয়ে চলার জন্যেই সরকার এই কঠোর সিদ্ধান্তগুলো নিতে বাধ্য হয়েছে, পুরো পৃথিবী এই পথেই হাঁটছে। নামাজ পড়তে আপনাদের কেউ নিষেধ করেনি, বাসায় নামাজ পড়ুন, কেন বাইরে আসতে হবে, কেন দশ-বিশজনের সঙ্গে জামাত করতেই হবে? আক্রান্তের সংখ্যাগুলো দেখেছেন? গত চার দিনে ১৮, ৩৫, ৪১, ৫৪- আর আজকে এক লাফে ১১২; এরপরেও কি শঙ্কা জাগে না মনের ভেতরে? একটু সাবধানে থাকতে ইচ্ছে করে না আপনাদের?
আমেরিকার অবস্থা দেখুন, ইতালি-স্পেনকে দেখুন। করোনাকে ওরা সিরিয়াসলি নেয়নি শুরুতে, হেলাফেলা করেছে। লকডাউনের পথে হাঁটেনি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেনি। ফলাফলটাও হাতেনাতে পেয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোতে এখন মৃত্যুর মহাসমাবেশ চলছে, হাসপাতালে রোগীকে জায়গা দিতে পারছে না তারা, একটু বয়োজ্যেষ্ঠ রোগী হলেই তাকে ভর্তি না করিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছে, কারণ যার বাঁচার আশা নেই তার পেছনে সময় নষ্ট করতে রাজী নয় তারা। আপনারা কি চান, একই বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশও হোক?
গোঁয়ার্তুমি করে ধর্ম পালন হয় না, অন্যের সঙ্গে ইগো দেখিয়ে নামাজ পড়লে সেই নামাজ কবুল হবার কথাও নয়। সরকার মসজিদে জামাত করতে নিষেধ করেছে, আমি বাড়িতে বিশজনে মিলে জামাত করে দেখিয়ে দেব, আমার মতো ‘মুমিন বান্দা’কে কেউ ঠেকাতে পারবে না- এগুলো হচ্ছে অর্থহীন আচরণ। বিবেকবান একজন ধার্মিক কখনও এমন আচরণ করবেন না, তিনি সব পরিস্থিতিতে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভরসা রাখবেন। আপনারাও সেটাই করুন, সেধে সেধে ভাইরাসকে ঘরে ডেকে আনার বন্দোবস্ত করার কি দরকার?
অনেকেই বলবেন, এত কিছু ছেড়ে শুধু জামাতে নামাজের পেছনে লাগছি কেন? প্রশ্নটা নিজেকেই করুন। যে অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এই মুহূর্তে দরকার ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হওয়াটা যেমন অপরাধ, অযথা কোথাও ভীড় জমানোটা যেমন অন্যায়, সব কিছু জেনে, শুনে, বুঝেও জামাতে নামাজ পড়ার জন্যে গোঁ ধরে বসে থাকাটাও অনৈতিক। যে লোকটা তামাশা দেখার জন্যে বাইরে বেরুচ্ছে, সে যেমন অন্যায় করছে, যে বা যারা দশ-বিশজন একত্রিত হয়ে নামাজ পড়ছে, তারাও কাজটা ঠিক করছে না মোটেও।
আজ শবে বরাত। ইসলামে এটার অবস্থান কোথায়, এটা পালন করা শরীয়তসম্মত কিনা, নাকি বিদআত- এসব বিতর্কে যাব না। শুধু বলব, ইবাদত যদি করতেই হয়, ঘরে বসে করুন। আল্লাহকে যে কোন জায়গায় বসে ডাকা যায়, সেটার জন্যে মসজিদে যাওয়ার দরকার পড়ে না, জামাতে দাঁড়াতে হয় না। একটু সেন্সিবল আচরণ করুন প্লিজ। ইসলাম সবচেয়ে সহজ ধর্ম, সেটাকে জটিল করে তুলবেন না। মনে রাখবেন, মানুষের জন্যেই ধর্ম এসেছে, ধর্মে রজন্যে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি। মানুষই যদি না বাঁচলো, তাহলে ধর্মটা পালন করবে কে?
আরও পড়ুন-