এই ছবিতে কি শাকিব খানকে রাখা উচিত হলো? যেহেতু সে নিজেই বাস্তবজীবনে খুব বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তাই সে কীভাবে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী, নিজের সাথে মিল নেই এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করল? জিনিসটা কি হিপোক্রেসি হয়ে গেল না?

কোনো মেয়ে কাজ শেষে রাত করে বাড়ি ফিরলেই তার চরিত্র খারাপ? কোনো মেয়ের বিয়ের আগে সেক্সুয়াল এক্সপেরিয়েন্স থাকলেই তাকে যে কেউ রেপ করতে পারবে? কোনো মেয়ের পোশাক কারো কাছে অশালীন মনে হলেই তার সাথে যা-ইচ্ছা-তাই করা যাবে?

এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে অনন্য মামুন পরিচালিত, শাকিব খানের আসন্ন ছবি 'নবাব এলএলবি'-তে। এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই দুটো দল তৈরি হয়ে গেছে। একটা দল শাকিব খানের সাথে অনন্ত জলিলের তুলনা করে বলছে, অনন্ত জলিল যেখানে ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করেছে, সেখানে শাকিব ধর্ষণ ইস্যুতে এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলছে; যে কারণে সে প্রশংসার দাবিদার।

বিপরীত আরেকটা দল বলছে, শাকিব নিজে ইতঃপূর্বে অপুর সাথে, সাম্প্রতিক সময়ে বুবলির সাথে কী করেছে, কিংবা নারীদের বিষয়ে সামগ্রিকভাবে তার কীরকম জঘন্য পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, সেটা কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া যাবে না, এবং সে কারণে তাকে মাথায় তুলে নাচারও কিছু নেই।

প্রথমেই বলে রাখি, অনন্ত জলিলের সাথে শাকিব খানের তুলনা একেবারেই হাস্যকর। অনন্ত জলিল ভিডিওতে যা বলেছিল, তা ছিল তার ব্যক্তিগত অভিমত। সে নিজের মনে যা ধারণ করে, সেটাই সে বলেছিল। তার কথাবার্তা স্ক্রিপ্টেড ছিল না।

কিন্তু শাকিব খান যা বলেছে, তা কি তার নিজের বক্তব্য? মোটেই না। তাকে দিয়ে পরিচালক যা বলিয়েছে, সে শুধু সেটুকুই বলেছে। এতে প্রমাণিত হয় না যে সে মনে মনেও সেগুলোই ভাবে। বরং, আমরা আগে নানা সময়ে শাকিব খানের আসল চেহারাটা দেখেছি। এখনো যে তার মানসিকতা খুব একটা পরিবর্তিত হয়েছে, সেরকম কোনো প্রমাণই কিন্তু আমরা পাইনি।

সিনেমায় পরিচালক যা বলাতে চেয়েছেন, শাকিব খান তাই বলেছেন

অতীতে আমরা শাকিব খানের যে আসল চেহারাটা দেখেছি, সেটা ছিল খুবই ঘৃণ্য, নিন্দনীয়। সেই চেহারায় ছিল টিপিক্যাল 'পুরুষ মানেই সর্বশ্রেষ্ঠ, নারীরা তাদের পায়ের নিচে' জাতীয় ঔদ্ধ্বত্য। ফলে ব্যক্তি শাকিব খানকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনো কারণই নেই। এই একটা সিনেমায় সে যেমন জেন্ডার সংবেদনশীল কথাবার্তা বলেছে, তার বিপরীতে এখন পর্যন্ত তার প্রায় সকল ছবিতেই একাধিক জেন্ডার অসংবেদনশীল ব্যাপারস্যাপার দেখা গেছে। তাই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাপকাঠিতেও তার অসংবেদনশীলতার পাল্লাই ভারি।

এবার আসি 'নবাব এলএলবি' ছবিটাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া উচিত কি না, সে প্রসঙ্গে। অবশ্যই উচিত। কারণ এই ছবিতে যে জিনিসগুলো দেখানো হবে, তা সময়ের দাবি। আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমে, বিশেষত বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে, এ ধরনের জিনিস আগে কখনো দেখা যায়নি। দেরিতে হলেও যে এখন সেটা আমরা দেখতে চলেছি, তা খুবই ইতিবাচক দিক।

কারণ, যেকোনো একটা সময়ে তো মূলধারার গণমাধ্যমে এই বিষয়গুলো নিয়ে কনভার্সেশন শুরু হওয়ার ছিল। এখন যে হচ্ছে, তা-ও আবার মাত্র মাস দুয়েক আগেই যখন দেশ ধর্ষণ ইস্যুতে সরব ছিল, তাই এটার তাৎপর্য আরো বেশি। এবং এই ছবির পথ ধরে ভবিষ্যতে আমাদের চলচ্চিত্রে এ জাতীয় বিষয় আরো বেশি বেশি উপস্থাপিত হবে, সেই আশাও আমরা করতেই পারি।

কিন্তু, এই ছবিতে কি শাকিব খানকে রাখা উচিত হলো? যেহেতু সে নিজেই বাস্তবজীবনে খুব বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তাই সে কীভাবে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী, নিজের সাথে মিল নেই এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করল? জিনিসটা কি হিপোক্রেসি হয়ে গেল না?

অবশ্যই ব্যাপারটা অদ্ভুত, এবং ছবিতে শাকিব খানের বলা কথাগুলোও হিপোক্রেসি।

তারপরও একটা সহজ বিষয় মনে রাখতে হবে, চলচ্চিত্র হলো ডিরেক্টর'স মিডিয়াম। সেখানে পরিচালক যা বলতে চায়, সেটাই প্রদর্শিত হয়। এমনটা কখনোই না যে অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলীরাও একই চিন্তার অনুসারী। তাই শাকিব এখানে হিপোক্রেসি করলেও, সেটাকে খুব বেশি প্রাধান্য না দিয়ে, ছবির মূল বিষয়বস্তু কী বা ছবিটা কী মেসেজ দিতে চাচ্ছে, সেটাকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত।

এবং আরেকটা সিলভার লাইনিং (যদিও অনেকের কাছেই হাস্যকর শোনাবে) হলো : শাকিব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তার ধারেকাছে এখনো কেউ নেই, এবং তার আছে বিশাল ফ্যানবেজ, যাদের অধিকাংশই অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। তারা যখন দেখতে ও শুনতে পাবে যে তাদের প্রিয় নায়ক এমন সব কথা বলছে, যার সাথে তাদের নিজেদের মানসিকতার খুব কম মিলই আছে, তখন একটা বড় ইমপ্যাক্ট তৈরি হবে।

সেই ইমপ্যাক্ট কি শতভাগ ইতিবাচক? না। বরং শাকিব এখানে ধর্ষণ ইস্যুতে যেসব কথা বলবে, তাতে তার ফ্যানবেজের বড় অংশই তার উপর খেপে যাবে। তারা তার কথা গ্রহণ করবে না। বরং কেউ কেউ তার বিরোধীতাও শুরু করবে।

তারপরও, কিছুটা ইতিবাচক ইমপ্যাক্টও তো থাকবেই। হয়তো একশোজনে একজন করে হলেও নতুন করে ভাববে, নিজেদের মানসিকতা পরিবর্তন করবে। এভাবে ধীরে ধীরে হলেও একটা পরিবর্তন হয়তো আসবে। সেটাই বা কম কী?

সব মিলিয়ে তাই দুটো কথাই আবারো বলা যায় :

১/ এই ছবিতে অভিনয় করে শাকিব সাধু পুরুষ হয়ে যায়নি। অনন্ত জলিলের চেয়েও সে মানুষ হিসেবে খুব উঁচুদরের কেউ নয়। অন্তত এখন পর্যন্ত।

২/ কিন্তু তারপরও, 'নবাব এলএলবি' ছবির মাধ্যমে যে ধর্ষণের মতো একটা ইস্যুতে খুব জরুরি কিছু সোশ্যাল মেসেজ দেয়া হবে, এবং অবশেষে এটা নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যমে আলোচনা হবে, সেটা খুবই ভালো লাগার মতো একটা ব্যাপার। আর তাই, এই ছবিটা দেখাই যায়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা