একজন বই বিক্রেতা হয়েও কেন মোস্তফা চাচা পাঠকদের কাছে এত জনপ্রিয়? কেন তার দোকান বিক্রির খবরে ফেসবুকের বইকেন্দ্রিক গ্রুপগুলোতে কষ্টের চাষবাস হচ্ছে? কেন তার ঢাকা ছাড়ার সংবাদ শুনে বইপোকারা হাহুতাশ করছে?

কারো কাছে তিনি ছিলেন মোস্তফা চাচা, কারো কাছে মোস্তফা মামা, বয়স্করা ডাকতেন মোস্তফা ভাই নামে। সব বয়সী পাঠকের কাছে তিনি ছিলেন সমান আপন। বইয়ের সন্ধানে কেউ তার কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছে, এমন নজির নেই। দুর্লভ কোন বই সাথে সাথে না পেলেও, গোলাম মোস্তফা নামের মানুষটা ক্রেতাকে কথা দিয়েছেন, অমুক তারিখে আসেন, ম্যানেজ করে দিচ্ছি। ঠিকই তিনি ম্যানেজ করেছে, কোত্থেকে, কিভাবে- সেই রহস্য মোস্তফা চাচা ছাড়া আর কেউ জানতেন না। পুরনো বইয়ের সন্ধানে নীলক্ষেত চষে বেড়ানো বইপাগলদের কাছে মোস্তফা চাচা ছিলেন রবিনহুড, কিংবা সুপারম্যানের মতো কোন চরিত্র! 

সেই মোস্তফা চাচা বইয়ের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এই ছোট্ট লাইনটা যে কতটা দুঃখগাঁথায় জর্জরিত, সেটা যারা মোস্তফা চাচাকে চেনেন না, তারা অনুধাবন করতে পারবেন না ঠিকঠাক। আমি নিজেও তাকে ভালোভাবে চিনতাম না, তার সঙ্গে কোন ধরণের হৃদ্যতাও ছিল না। ফেসবুকের পোস্ট দেখেই নীলক্ষেতের অলিগলি ঘুরে খুঁজে বের করেছিলাম তার দোকানটা, বইও কিনেছি, কিন্ত দোকানে ভীড় বেশি থাকায় তার সঙ্গে কথা হয়নি সেভাবে। ফেসবুকে যখন দেখলাম তিনি বইসহ গোটা দোকানটা বিক্রি করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন- মনে হচ্ছিল বিশাল একটা প্রলয় বুঝি ঘটে গেছে আচমকা! 

মোস্তফা চাচাকে যারা চেনেন না, তাদের জন্য ছোট্ট করে তার পরিচয়টা দিয়ে রাখি আগে। মোস্তফা চাচা বই বিক্রি করতেন, নীলক্ষেতের ইসলামিয়া মার্কেটের তেরো নম্বর গেটে ছিল তার দোকান। পটুয়াখালিতে জন্ম নেয়া এই ভদ্রলোক গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি অর্থাভাবে। বইয়ের নেশাটা ছোটবেলা থেকেই তার সঙ্গী, স্কুলে থাকতেই এলাকার পাঠাগারের সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিলেন, ভাড়ায় বই এনেও পড়তেন! 

নিজের দোকানে মোস্তফা চাচা

আশির দশকের শুরুতে ঢাকায় এলেন, নেমে পড়তে হলো জীবন সংগ্রামে। এর আগে রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করেছেন, লঞ্চে কেরাণী হিসেবেও কাজ করেছেন। সেগুলো ছেড়েছুড়ে ঢাকায় এসে বই নিয়েই কাজ শুরু করলেন, নীলক্ষেতের ফুটপাতে বিক্রি করতেন পুরনো বই। একসময় ফুটপাত থেকে দোকানপাট উঠিয়ে দেওয়া হলো। যার দোকানে কাজ করতেন তিনিও ব্যবসাটা ছেড়ে দিতে চাইলেন। দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মালিকের বইপত্র সব কিনে নিলেন গোলাম মোস্তফা। সেটা প্রায় দুই যুগ আগেকার কথা। দোকান নিলেন ইসলামিয়া মার্কেটে, ১০০ বর্গফুটের মতো জায়গা। সেটাই পরে ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত আয়ের বইপ্রেমীদের জন্য স্বর্গোদ্যান হয়ে উঠেছে, পরিণত হয়েছে নিয়মিত গন্তব্যস্থলে। 

মূলত পুরনো বইয়ের কারণেই বিখ্যাত ছিল গোলাম মোস্তফার এই 'মোস্তফা বইঘর'। ভদ্রলোক নিজে একজন বইপোকা, অবসরে তিনি শুধু পড়েন, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ- কিচ্ছু বাদ দেন না। মোস্তফা চাচাকে শুধু একজন বই বিক্রেতা বললে ভুল হবে আসলে, তিনি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ছিলেন। আত্মীয়-স্বজনরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল পাঠ্যবই আর নোট-গাইড বিক্রি করতে, এগুলোর চাহিদা বেশি, লাভও বেশি। মোস্তফা চাচা সবার মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, 'গোলাম মোস্তফা নোট-গাইড বেচে না, বেচবোও না!' এখানেই আর দশজনের সঙ্গে মোস্তফা চাচার পার্থক্য, সাহিত্যের প্রতি তার যে অনুরাগ, যে আকর্ষণ, সেটার সঙ্গে তিনি অন্য কিছুকে মেলাতে চাননি, টাকা-পয়সাকেও না।

নীলক্ষেতে হাজার হাজার দোকান আছে, কম করে হলেও কয়েকশো দোকানে গল্প-উপন্যাস আর কবিতার বই বিক্রি হয়। এমন নয় যে মোস্তফা চাচা একাই পুরনো বই বিক্রি করতেন। তাহলে কেন নিয়মিত পাঠকদের কাছে তিনি এত জনপ্রিয়? কেন তার দোকান বিক্রির খবরে ফেসবুকের বইকেন্দ্রিক গ্রুপগুলোতে কষ্টের চাষবাস হচ্ছে? কেন তার ঢাকা ছাড়ার সংবাদ শুনে বইপোকারা হাহুতাশ করছে? এই রহস্য ভেদ করতে হলে মোস্তফা চাচাকে কাছ থেকে জানতে হবে, শুনতে হবে তার অন্যরকম একটা গল্প- 'দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ গোলাম মোস্তফা!'

মোস্তফা চাচার দোকানে গিয়ে শুধু বইয়ের নাম বললেই হতো, কার লেখা, বইটা কেমন, কত সালে বেরিয়েছিল, এই বই নিয়ে পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, কোন পলিটিক্যাল ইস্যু ছিল কিনা, নিষিদ্ধ হয়েছিল কিনা- সময় থাকলে এরকম অনেক গল্পই করতেন মোস্তফা চাচা। বইয়ের ব্যাপারে তাকে জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বললে ভুল হবে না একটুও। কোন বই নিজের কাছে না থাকলে কোথায় পাওয়া যাবে সেটাও বলে দিতেন। মোস্তফা চাচাকে আলাদা করেছিল আরেকটা জিনিস- তার বিশাল সংগ্রহের ভাণ্ডার। এমন এমন সব বই তার কালেকশনে ছিল, যেগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গোটা নীলক্ষেতের কোথাও পাওয়া যাবে না! 

তেরো নম্বর গেটের এই দোকানে আর পাওয়া যাবে না মোস্তফা চাচাকে

আরেকটা জায়গায় মোস্তফা চাচা আলাদা ছিলেন। নীলক্ষেতের দোকানদারদের সাথে পাঠকদের সম্পর্কটা হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতার, মোস্তফা চাচার সাথে পাঠকদের সম্পর্কটা ছিল আত্মার। কারণ তিনি নিজেই একজন পাঠক ছিলেন, যেন তেন টাইপের না, সর্বভুক পাঠক যাকে বলা চলে। পরিচিত কোন কাস্টোমার হয়তো এসেছে, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে দেখে মোস্তফা চাচা নিজের হাতে পলিথিন দিয়ে তাকে একটা টুপি বানিয়ে দিয়েছেন, বইগুলোও এমনভাবে বেঁধে দিয়েছেন যাতে পানি ঢুকতে না পারে প্যাকেটে- এই হৃদ্যতা আর কারো কাছে পাওয়া সম্ভব না। 

এত কথা বলা হলো, মোস্তফা চাচা কেন বইয়ের দোকানটা বিক্রি করছেন সেটাই জানানো হলো না। করোনার কারণে বইয়ের ব্যবসায় মোটামুটি ধ্বস নেমেছে, টানা কয়েক মাস তো সবকিছু বন্ধই ছিল। খোলার পরেও নীলক্ষেতে বই কেনার লোক নেই বললেই চলে। ব্যবসা থেকে আয়ের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায়, দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন- এগুলো নিজের পকেট থেকে আর চালাতে পারছিলেন না মোস্তফা চাচা। বই বিক্রি করে আর কয় টাকাই বা আয় করতেন তিনি? সঞ্চয় ভেঙে কয়েক মাস চলেছেন, আর চলার মতো অবস্থা নেই। এখন পটুয়াখালীতে নিজের এলাকায় ছোটখাটো কোন ব্যবসা করবেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো কখনও ফিরবেন ঢাকায়। আসলেই কি ফিরবেন? আমরা জানিনা। 

মোস্তফা চাচার কারণে অজস্র পাঠক তৈরী হয়েছে, সাদা পাতা আর কালো অক্ষরের মাঝখানে রঙিন একটা দুনিয়ার সন্ধান তিনি দিয়েছিলেন অজস্র বইপড়ুয়াকে। নীলক্ষেত ইসলামিয়া মার্কেটের তেরো নম্বর গেট দিয়ে ঢুকলে মোস্তফা বইঘরে তাকে আর পাওয়া যাবে না- এটা মেনে নেয়া বইপ্রেমীদের জন্যে যথেষ্ট বেদনার। করোনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে আহাজারি করা রোগী আর স্বজনদের ছবিতে ভরে থাকা নিউজফিডের ফাঁক গলে আমাদের মন তবু পড়ে থাকে মোস্তফা বইঘরের সামনের ছোট্ট জায়গাটায়, হাতে কিছু টাকা জমলেই যেখানে আমরা স্বপ্ন আর আনন্দের খোঁজে ছুটে যেতাম, যে জায়গাটা আমাদের নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা ছিল, যেখান থেকে ফুসফুসের নয়, বরং মনের খোরাক মেটানোর জন্য অক্সিজেন পাওয়া যেতো।

মোস্তফা চাচার মুখে 'আবার আইসেন' কথাটা আর কখনও শোনা হবে না হয়তো, কিংবা নতুন কাস্টোমারের সঙ্গে 'আড়াইশো কইছি আড়াইশোই দাম, দুইশো ঊনপঞ্চাশও রাখা যাইব না' টাইপের ডায়লগগুলো শোনা যাবে না আর। ভরা শ্রাবণে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলে কেউ বইয়ের সাথে যত্ন করে পলিথিন দিয়ে একটা টুপিও বানিয়ে দেবে না। আমাদের হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা চলে গেছেন শহর ছেড়ে, এই শহরে আমাদেরও মন টিকছে না আর...

ছবি কৃতজ্ঞতা- অরিন হোসাইন

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা