এরপরেও যারা বলবেন যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা খুব নিরাপদে আছেন, তারা আসলে সারা বছর টিনের চশমা পরে থাকেন। আরেকদল বলেন, ভারতেও তো মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে; ভারত অসভ্য হলে আমাদেরও অসভ্য হতে হবে- এটা কোন সংবিধানে লেখা আছে?

ঘটনা এক

লালমনিরহাটে শহিদুন্নবী জুয়েলকে 'কোরআন অবমাননার' অভিযোগে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারার পর তার লাশটা পুড়িয়ে দেয়ার খবর যখন মিডিয়াতে এলো, তখন কমেন্টবক্সে অনেককেই ইনিয়ে বিনিয়ে সাফাই গাইতে দেখেছি যে, মেরে ফেলা ঠিক হয়নি, কিন্ত সে কোরআন শরীফকে অপমান করলো কেন? 

জুয়েলের মৃত্যুর পরে এখন পুলিশি তদন্তে জানা যাচ্ছে, কোরআন অবমাননার যে অভিযোগ উঠেছিল, সেটা পুরোপুরি কাল্পনিক এবং ভিত্তিহীন। গুজব রটিয়ে জনসমাগম ঘটিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জুয়েলকে হত্যা করা হয়েছিল। চিলে কান নেয়ার মতো করে অজস্র মাথামোটা গর্ধব সেই ঘটনাকে জাস্টিফাই করার জন্য অনলাইনে ঝাঁপিয়েও পড়েছিল। এই হচ্ছে চিলে কান নেয়ার গুজব শুনে কান হাত না দিয়ে চিলের পেছনে ছোটার নমুনা।

ঘটনা দুই

দুইদিন আগে কুমিল্লার মুরাদনগরে ফেসবুক পোস্ট এবং কমেন্টের জের ধরে ধর্ম অবমাননা এবং কটুক্তির অভিযোগ উঠলো। মিছিল হলো এলাকায়, তারপর দলবেঁধে হামলা চালানো হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে। চালানো হলো লুটপাট। তখনও বকধার্মিকদের দেখেছি সেই হামলাকে বৈধতা দিতে। অনেকেই কমেন্ট করেছে, 'নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে মুসলিম ধর্ম নিয়ে বাজে মন্তব্য করার সাহস কীভাবে পায় এরা?' 

অথচ ঘটনার দুইদিন পরে এসে আমরা জানতে পারছি, ধর্ম অবমাননা বা কটুক্তির অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। সম্পূর্ণ রাজননৈতিক কারনে এবং লুটপাটের উদ্দেশ্যে গুজব রটিয়ে এই হামলা চালানো হয়েছে। আর ব্যাকটেরিয়ার মস্তিষ্ক নিয়ে ঘোরাফেরা করা হাজার হাজার মানুষ ফেসবুকে সেই হামলাকে বৈধতা দিয়েছে। এই হচ্ছে লোকজনের কমনসেন্সের নমুনা! এসব দেখেশুনে মনে হয়, আইকিউ টেস্ট এবং ভালো পর্যায়ের অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি ছাড়া কেউ ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবে না- এরকম বিধিনিষেধ আরোপ করাটা খুব দরকারী। 

মুরাদনগরে হামলায় বিধ্বস্ত হওয়া ঘরবাড়ি

ঘটনার সূত্রপাত কিশোর দেবনাথ কিষান নামের একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। তিনি মুরাদনগরের কোরবানপুর গ্রামের বাসিন্দা, তবে কাজের কারনে ফ্রান্সে থাকেন এখন। ফ্রান্স বয়কটের হিড়িকের মধ্যেই তিনি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেই স্ট্যাটাসে আক্রমণাত্মক বা উস্কানিমূলক কোন বাক্য ছিল না। কিশোর লিখেছিলেন- “ফরাসি প্রেসিডেন্ট যে সব অমানবিক চিন্তাভাবনাকে শায়েস্তা করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়।” ওই স্ট্যাটাসের সাথে একমত হয়ে সেখানে মন্তব্য করেন তার দূরসম্পর্কের কাকা শংকর দেবনাথ, যিনি নিজেও কোরবানপুর গ্রামের বাসিন্দা। শংকর লিখেছিলেন- ‘স্বাগতম প্রেসিডেন্টের উদ্যোগকে’।

কিশোর দেবনাথের সেই ফেসবুক পোস্টেই নানা ধরণের হুমকি ধামকি দিয়ে নানা মন্তব্য আসতে থাকে, তারই দীর্ঘদিন পরিচিত অনেকের কাছ থেকে। কিশোর দেবনাথ ইসলামের অবমাননা করেছেন, এমন একটা গুজব রটানোর চেষ্টা করে একটা পক্ষ, তারা সফলও হয় পুরোপুরি। কারন এদেশে আর কিছু চলুক না চলুক, ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোটা খুব ভালোভাবেই চলে, ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট জিনিসটা মানুষ খুব খায়। 

সেদিনই স্থানীয় বাজারে এই ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে স্থানীয়রা সেখানে বিক্ষোভ মিছিল করে। ভেবে দেখুন, মানুষজন কতটা অকর্মণ্য হলে ফ্রান্স থেকে কে কি স্ট্যাটাস দিয়েছে সেটা ঠিকমতো না জেনেই মিছিল করতে রাস্তায় নেমে পড়ে! সহিংসতার আশংকায় রাতেই শংকর ও অনিলকে আটক করে পুলিশ। পরদিন রোববার তাদের আদালতে পাঠানো হয়। কিন্ত তাতেও হামলা ঠেকানো যায়নি, কারন যে কোন মূল্যে একটা গণ্ডগোল পাকানোই ছিল কিছু লোকের উদ্দেশ্য, ধর্ম অবমাননা বা কটুক্তির অভিযোগ তো উসিলা মাত্র। 

নানা গুজবে শনিবার থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। শনিবার রাতে কোরবানপুর গ্রামে একদল লোক বিক্ষোভে নামে। ধর্ম অবমাননার ধুয়া তুলে রোববার দুপুরে কোরবানপুর জিএম উচ্চ বিদ্যালয়ে সমাবেশ ও বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়। ব্যাটারিচালিত রিক্সায় মাইকিং করে প্রচার চালানো হয় এই সমাবেশের। রোববার দুপুরের আগেই স্কুলের মাঠে বিভিন্ন এলাকার লোকজন জড়ো হতে শুরু করে। এর নেতৃত্বে ইব্রাহিম, রাজু, বাবলু নামে তিনজনের নাম বলেছেন স্থানীয়রা। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সেখানে গিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করেন যে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদেরকে ইতিমধ্যেই (আগের রাতে) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জনতা যেন অশান্ত না হয় এই আহবানও জানানো হয়। কিন্ত কে শোনে কার কথা! 

পুড়িয়ে দেয়া বাড়িঘর

দুপুর ৩টার দিকে শত শত মানুষ স্লোগান দিতে দিতে শংকর দেবনাথের (যিনি স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেছিলেন) বাড়িতে হামলা চালায়। তারা অন্য এলাকা থেকে এসেছিল। পথে তারা একটি কালী মন্দির ভাংচুর করে। বাজারে স্থাপন করা পূর্ব ধইর ইউনিয়নের প্রয়াত চেয়ারম্যান বেনু ভূষণ শিবের মূরাল ভেঙে ফেলা হয়। তারপর হামলা চালানো হয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বনকুমার শিব ও তার স্বজনদের বাড়িতে। এ দুই বাড়ির প্রায় ১০টির মতো ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক এই জায়গায় এসে পরিস্কার হয়ে যায় যে  হামলাটা পুরোপুরি রাজনৈতিক ছিল, সাম্প্রদায়িক ছিল, এখানে ধর্ম অবমাননা ছিল কেবলই একটা ছুতা।

শংকর দেবনাথ ও চেয়ারম্যানের বাড়ি বাড়ি পোড়ানোর পর হামলাকারীরা যায় ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া ফ্রান্স প্রবাসী কিশোরের বাড়িতে। ভাংচুরের পর আগুন দেওয়া সেখানেও। চলে লুটপাটও। এরপর পাশেই মনসা মন্দির ভাঙা হয়। যারা হামলা চালিয়েছে, তাদেরকে গ্রামের লোকজন চিনতে পারেনি। অপরিচিত লোক। অন্য এলাকা থেকে এসেছে। হামলাকারীরা অপরিচিত হলেও গ্রামের কিছু মানুষ হামলাকারীদের সহায়তা করেছে। হামলাকারীদের যাতে প্রতিরোধ করা না যায় সে কাজও করেছে স্থানীয়রা। এদের মধ্যে একদল হামলা ও লুট করছিল। কেউ ঠেকাতে এলে তাদের বাধা দিচ্ছিল আরেক দল। এসময় দমকলের গাড়ি এসেও তাদের প্রতিরোধের মুখে ঘটনাস্থলে ঢুকতে পারেনি। 

এখানে বড়সড় একটা রাজনৈতিক সমীকরণ আছে। কোরবানপুর নামের গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত এবং ভোটারদের বেশিরভাগও হিন্দু। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেও দুই দফায় এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান হয়েছেন বনকুমার শিব। এটিই তার বাড়িতে হামলার একটি কারণ বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, ফেসবুক স্ট্যাটাস যিনি দিয়েছেন বা যারা কমেন্ট করেছেন, তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান বা তার পরিবারের কেউ নেই। তবুও তাদের বাড়িতে হামলা চালানোটা যে উদ্দেশ্যপূর্ণ, সেটা বোঝার জন্য মনীষী হওয়ার দরকার পড়ে না।

একদম হাওয়া থেকে গুজব রটিয়ে মাইকিং করে গণজমায়েত করে হামলা চালানো হলো, ঘরবাড়ি পোড়ানো হলো, মন্দির ভাঙা হলো, টাকাপয়সা-স্বর্ণালঙ্কার লুটপাট করা হলো। এরপরেও যারা বলবেন যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে আছেন, তারা আসলে সারা বছর টিনের চশমা পরে থাকেন। আরেকদল এসে বলবেন, ভারতে এই হচ্ছে, সেই হচ্ছে, মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে... ভারত অসভ্য হলে আমাদেরও অসভ্য হতে হবে- এটা কোন সংবিধানে লেখা আছে? মাথাটা একটু খাটান দয়া করে, কমনসেন্স বাড়ান, চিলে কান নিয়েছে শুনলে হাতটা কানের জায়গায় নিয়ে দেখুন সেটা ঠিকঠাক আছে কিনা। তার আগেই চিলের পেছনে দৌড়ানো শুরু করলে এভাবেই শহীদুন্নবী জুয়েলরা লাশ হয়ে পড়ে থাকবেন, এভাবেই বাড়িঘর পুড়ে ছারখার হবে বারবার...

ছবি কৃতজ্ঞতা- বিবিসি বাংলা

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা