২৬/১১ এর মুম্বাইয়ের রক্তস্রোতের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/6/25/XWKuxjWce3h6RsYxVQSXTQ7IaRUtjHqztPaby6q0.jpeg)
আরব সাগরের বুকে ছোট একটা মাছধরা ট্রলার, ডিজেলের ইঞ্জিনে চলে। একটা লাঠির মাথায় ভারতীয় পতাকা টাঙানো। ট্রলারে মাছ নেই, আছে জনাদশেক তরুণ। ইঞ্জিনরুমে বসে থাকা কাপ্তানের মাথা ফেটে গেছে, রক্তাক্ত শরীরে হুইল ধরে আছে সে। নৌকাটাকে মুম্বাই বন্দরের কাছাকাছি নিরিবিলি কোন জায়গায় তীরে ভেড়ানোর আদেশ দেয়া হয়েছে তাকে।
সকালে ঈশ্বরের নাম করে মাছ ধরতেই বেরিয়েছিল দলের বাকীদের নিয়ে। কিন্ত কোত্থেকে ভূতের মতো উদয় হলো একটা ছোট জাহাজ, প্রথম দেখায় বোঝা যায়নি কিছুই। কিন্ত ট্রলারের গায়ে জাহাজ ঠেকিয়ে ওরা যা শুরু করলো, সেটি দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি কেউ।
সেসব কথা আর মনে করতে চায় না কাপ্তান। তার দলের বাকীরা এতক্ষণে হাঙরের খাবার হয়ে গেছে সাগরের বুকে, সবাইকে খুন করে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে আরব সাগরের লোনাজলে। লোকটা জানে, তাকেও রেহাই দেবে না এরা। তবুও প্রাণের তাগিদে কাজটা করে চলেছে, যদি শেষ মূহুর্তে ওদের মনে একটু দয়া হয়!
নভেম্বর শেষ হয়ে আসছে, সাল ২০০৮, ছাব্বিশ তারিখের সন্ধ্যেটা যেন খানিক দীর্ঘ। কোটি মানুষের বসবাস এই মেগাসিটিতে, একপাশ জুড়ে আভিজাত্যের অহংকার, অন্যপাশে ক্ষুধার্তের চিৎকার। অদ্ভুত এক নগরী বটে মুম্বাই। নয়টা বাজলে এখানে রাত নামে না, সন্ধ্যের শুরু হয় কেবল। আলো ঝলমলে শহরজুড়ে ব্যস্ততার ঢেউ এখনও কমেনি। জুহু বীচের ধারে শীতল বাতাস, কুয়াশায় ঢাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোর ভূতুড়ে আলোয় ভারতের এই বাণিজ্যনগরীকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে!
তাজমহল প্যালেস হোটেলের গ্যারেজে গাড়ির ভীড় বাড়ছে, প্রতি রাতেই বেশ কয়েকটা পার্টির আয়োজন হয় এখানে। ধারাবী'র ঘরে ঘরে টেলিভিশনের আওয়াজ, মেগাসিরিয়াল শুরু হবার সময় এটা, গৃহিনীদের সারাদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটে এই সময়টায়। অল্প কয়েকজন মানুষ ছাড়া আর কেউ জানে না, মৃত্যুর অশুভ ছায়া নামছে মুম্বাইয়ের আকাশ জুড়ে। রাত বাড়ছে ফিল্মসিটিতে, জহির রায়হানের ভাষায় সেই 'হাজার বছরের পুরোনো রাত'।
হাজার নয়, একশোও নয়, দশজন, মাত্র দশজন আততায়ী ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরজুড়ে। যার যার আক্রমণের জায়গা আগেই নির্দিষ্ট করে রাখা আছে। কমবেশী সবারই পিঠে বড়সড় ব্যাকপ্যাক, কারোটায় আরডিএক্স বোমা, কারোটায় সাবমেশিনগান, এ.কে-47, কোমরে গুঁজে রাখা আছে পিস্তল। সবাই যে সবাইকে খুব ভালো করে চেনে এমনটাও নয়, নিজেদের কাছে তাদের একটাই পরিচয়- জিহাদী!
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/6/25/rdAjITXXYB4gfikIBc0xZ4AMQFDMBO7NyFh3Q13g.jpeg)
ছত্রপতি শিবাজী রেলওয়ে টার্মিনাল- মুম্বাই তো বটেই, পুরো ভারতেরই সবচেয়ে ব্যাস্ত রেলস্টেশন এটি। ঘড়ির কাঁটায় তখন সাড়ে ন'টা, দুই ঘাতক ইসমাইল খান আর আজমল কাসাব প্রবেশ করলো প্যাসেঞ্জার'স হলে। এরপর একটানা গুলির আওয়াজ, নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে গুলির ডগায় পড়লো মানুষ, যারা কর্মক্লান্ত দিন শেষে ঘরে ফেরার ট্রেনের জন্যে বসে ছিলেন।
বাড়িতে তাদের অপেক্ষায় বসে ছিলেন স্বজনেরা, সেই অপেক্ষার পালা ফুরোয়নি আর কখনও। চারদিকে তখন আহাজারি, ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে অস্ত্র হাতে পায়চারি করছে দুই জঙ্গী, এদিকে সেদিকে আড়াল খুঁজে প্রাণের তাগিদে পালাচ্ছে মানুষ। ছোট শিশুর মুখ চেপে ধরে দৌড়ুচ্ছে কোন তরুণী মা। টার্মিনালের এনাউন্সার বিষ্ণু দত্তরাম ততক্ষণে জঙ্গী আক্রমণের কথা জানিয়ে সবাইকে পালানোর ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন স্পিকারে। কিন্ত অনেকগুলো মানুষের জন্যে বড্ড দেরী হয়ে গেছে তখন, ৫৮টা লাশ পড়ে আছে টার্মিনালের এখানে সেখানে, আহত হয়ে কাতরাচ্ছে যারা, তাদের সংখ্যাও শতাধিক!
আলাদা আলাদা জায়গা থেকে দুটো ট্যাক্সি ভাড়া করেছিল কয়েক যুবক। তাদের চলনে বলনে তাড়াহুড়ো, চোখেমুখে কেমন একটা নেশাগ্রস্থ ভাব। সঙ্গে ব্যাগ কয়েকটা, স্যুটকেসও আছে। দুজন একটা ট্যাক্সি নিয়ে নামলো দক্ষিণ মুম্বাইয়ের কোলাবা কজওয়েতে, আরেকটা ট্যাক্সিতে করে দুজন নামলো তাজ হোটেলের সামনে। ভাড়া দিয়ে খুচরা টাকাটা আর ফেরত নিলো না কোনপক্ষই। ট্যাক্সি এগিয়ে গেল ওদের ছেড়ে, একটায় আবার যাত্রীও উঠলো। ড্রাইভারেরা জানে না, মৃত্যুর দূত বসে আছে ঘাড়ে।
বোমা দুটোয় টাইমার সেট করা ছিল, প্রথমটা বিস্ফোরিত হলো আনুমানিক সাড়ে দশটার সামান্য আগে। পার্ক করা গাড়িটার ভেতরেই ছিল চালক, সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল সে, আহত হলো আশেপাশে থাকা জনা পনেরো মানুষ। দ্বিতীয় বোমাটা ব্লাস্ট হলো ভিলা পার্লেতে, ড্রাইভারের সঙ্গী একজন প্যাসেঞ্জার ছিল সেই ট্যাক্সিতে। মারা গেল দুজনেই।
ঘড়িতে সময় তখন দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। দক্ষিণ মুম্বাইয়ের কোলাবায় বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট লিওপোল্ড ক্যাফে, লোকজন এখানকার কফি খেতেই সন্ধ্যের পর ঢু মারে সচরাচর। কফিটা দারুণ, আর তাই বিদেশীদের ভীড়ও লেগে থাকে সারাক্ষণ। শোয়েব আর নাজির ট্যাক্সি ছেড়ে এগিয়ে গেল রেস্টুরেন্টের দিকে। কোলাহল আর হই-হুল্লোড়েও আওয়াজ চাপা পড়ে গেল ব্রাশফায়ারের আর্তনাদের নীচে। গুলির খোসাগুলো জমতে থাকলো দুজনের পায়ের কাছে, আর বুলেটগুলো আশ্রয় খুঁজে নিলো অসহায় কিছু মানুষের দেহে। ছাব্বিশে নভেম্বরের সেই অদ্ভুত রাতটায় ঘোলাটে চাঁদের আলোয় পড়ে রইলো প্রায় দশজন মানুষের মৃতদেহ, আহতদের সংখ্যা অগুনিত। মিনিট দশেকের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে খুনী দুজন বিনা বাধায় চলে গেল সেখান থেকে, এবার ওদের গন্তব্য তাজ হোটেল।
এর আগে হামলা হয়েছে নরিম্যান হাউজে, ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনাকেন্দ্র ছিল সেখানে। জিম্মি করা হয়েছিল অনেককে। দিল্লি থেকে এনএসজি কমান্ডোরা এসে দুই দিন অপারেশন চালিয়ে মুক্ত করেন তাদের, জঙ্গীদের গুলিতে নিহত হন কমান্ডো গজেন্দর সিং বিশত। তবে তারা আসার আগেই গ্যাব্রিয়েল হল্টজবার্গ আর তার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সহ আরো চারজন জিম্মিকে নৃশংসভাবে খুন করে এই পাষণ্ডরা। নভেম্বরের আটাশ তারিখে বারোটি পরিবারের ষাটজন মানুষকে কমাণ্ডোরা উদ্ধার করে এখান থেকে।
হোটেল তাজ প্যালেসের আলোগুলো আগের মতোই উজ্জ্বলভাবে জ্বলছে, বাতাসে রক্তের গন্ধ তখনও ভেসে আসেনি সেখানে। বিশাল ভবন, বিদেশী নাগরিকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে পাঁচতারা এই হোটেলটি। নানা আকারের কয়েকশো কক্ষ আছে, রেস্টুরেন্টটাও খুব বিখ্যাত এখানকার। আছে বলরুম, সেমিনার রুম, কনভেনশন সেন্টার। প্রতি রাতেই ভীড় লেগে থাকে একটা না একটা কিছু নিয়ে। সেখানে হলো আক্রমণ, থমকে গেল সময়, চায়ের পেয়ালার টুংটাং আর মদের গ্লাসে মৃদু টক্করের বদলে চারদেয়ালের ভেতরটা ভরে গেল একটানা গুলির শব্দে, বাতাসে পোড়া কার্তুজের গন্ধ।
পরের ষাট ঘণ্টা সেখানে কী ঘটেছে তার সাক্ষী হোটেলের লবির বিশাল ঝাড়বাতি, ভাঙা টেবিল চেয়ার আর জানালার কাঁচ, সেইসঙ্গে ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া অনেকগুলো মানুষ। তাজমহলের লাগোয়া ওবেরয় ট্রাইডেন্ট হোটেল, দুই হোটেলের মধ্যে সংযোগও ছিল। দুই ভবন মিলিয়ে রুমসংখ্যা প্রায় আটশোর মতো, জিম্মিদের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল হাজার। এদের মধ্যে ছিলেন অজস্র বিদেশী, খুঁজে খুঁজে প্রথমে তাদের মধ্যে যাদের পাওয়া গেল, বিনা বিচারে হত্যা করলো জঙ্গীরা। গুলি খেয়ে কোন মা হয়তো পড়ে গেছেন, কেঁদে উঠেছে কোলের ছোট্ট শিশুটা; তার কপালে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে কান্নাটা চিরতরে থামিয়ে দিয়েছিল ঘাতকেরা। এমনই ছিল ওদের নৃশংসতার নমুনা! হোটেল দু'টোর বিভিন্ন জায়গায় ফিট করা হয়েছিল শক্তিশালী এক্সপ্লোসিভ, একের পর এক বিস্ফোরণে বারবার কেঁপে উঠছিল তাজ প্যালেস আর ওবেরয় ট্রাইডেন্ট।
আগুণ দেখে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নেমে পড়লো কাজে, হোটেলের বাইরের অংশ আর ছাদ থেকে মই দিয়ে প্রায় শ-খানেক জিম্মিকে তারাই উদ্ধার করে। ওদের কাছেই জানা গেল ভেতরের অবস্থাটা। অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো সম্মিলিত আক্রমণ, ঘটনার ভয়াবহতায় আঁতকে উঠলো পুরো মুম্বাই, জারী করা হলো রেড এলার্ট। দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে সুদূর আমেরিকার হোয়াইটহাউস- সব জায়গা থেকে তীক্ষ্ণ নজরদারী রাখা হলো ঘটনার ওপর। মুম্বাইবাসীর কাটানো নির্ঘুম এক রাতের শুরুটা হলো এভাবেই। ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে কামা হাসপাতালের দিকে এগুতে লাগলো দুই ঘাতক ইসমাইল আর কাসাব। দুজনের ছোঁড়া বুলেটে ইতিমধ্যে ঝরে গেছে ষাটের বেশী নিরীহ প্রাণ।
![](https://media.egiyecholo.com/contents/posts/images/2020/6/25/1SJkDbTR86UtfQpvEKmcDJBNa344Eaa5NgYIegEG.jpeg)
রাস্তায় একটা পুলিশের জীপ দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে সেটাতে হামলা চালিয়েছিল দুই জঙ্গী। নীরিহ মানুষের মতো খুব কাছাকাছি গিয়ে এ.কে-47 বের করে ব্রাশফায়ার, কাজটা সারতে সময় লাগেনি একদমই। যাত্রাপথে একটা থানা পড়লো, সেখানেও হামলা চালালো তারা। থানার বীর পুলিশেরা লাইট অফ করে গেট লাগিয়ে ভেতরে বসে রইলো। মুম্বাইয়ের মতো শহরের একটা অংশে শুধু হাতে অস্ত্র নিয়েই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ফেলেছে এই দুই খুনী, এমনটা সিনেমাতেও কম দেখা যায়!
কামা হাসপাতালের সামনে গিয়ে হতাশ হলো ওরা, গেট ভেতর থেকে লাগানো। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বুদ্ধি করে হাসপাতালের কর্মচারীরা আগেই গেট লাগিয়ে রেখেছিল, আর রোগীদের একটা কামরায় তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। মুম্বাই পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিস্ট স্কোয়াডের একটা দল ওদের দুজনকে অনুসরণ করে পৌঁছে গিয়েছিল হাসপাতাল পর্যন্ত, কিন্ত টের পেয়ে দুজন লুকিয়ে পড়ে পার্কিঙে থাকা গাড়ির আড়ালে। গুলি করে ওদের বের করে আনতে চেয়েছিল দলনেতা হেমন্ত কারকারে, কিন্ত উল্টো তাঁর দলই ফাঁদে পড়লো।
জঙ্গীদের অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে ধারণা ছিল না তাদের, ব্রাশফায়ারের তোপে উড়ে গেল পুলিশি আক্রমণ, সঙ্গে সঙ্গেই নিহত হলেন অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াডের পাঁচ সদস্য। এরপর পুলিশের জীপ নিয়েই ছুটলো দুই জঙ্গী, পথিমধ্যে গাড়ি পাল্টালো তারা, এমন অবস্থায়ও মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করার জন্যে ওরা বাহবা পেতেই পারতো, যদি ওদের কাজটা মানবতার জন্যে হতো। অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াডের পুলিশ কনস্টেবল অরুণ জাদব বেঁচে গিয়েছিলেন আহত অবস্থায়, জিপেও উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। কাসাব আর ইসমাইল যখন পুলিশের জীপ ছেড়ে অন্য গাড়ি নিলো, তখন রেডিওতে সহকর্মীদের জানিয়ে দিয়েছিলেন ওদের যাত্রাপথ।
পুলিশের রোডব্লকে আটকা পড়লো দুই জঙ্গীর গাড়ি। সেখানেই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলো ইসমাইল খান, কিন্ত নিজের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে কাসাব পালিয়ে চলে যাচ্ছিলো ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেটা সম্ভব হলো না তুকারাম ওম্বেলে নামের এক অসীমসাহসী পুলিশ অফিসারের জন্যে। চুয়ান্ন বছর বয়স্ক এই মানুষটা জীবনের মায়া না করে জাপটে ধরে রেখেছিলেন আজমল কাসাবকে। কাসাবের বন্দুকের গুলি তুকারামের হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল, তাতেও কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না তাঁর। শুধু তাঁর এমন দুঃসাহসের জন্যেই জীবন্ত ধরা পড়েছিল কাসাব।
ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই নড়েচড়ে বসে মুম্বাই আর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন, দিল্লি থেকে পাঠানো হয় ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের প্রশিক্ষিত কমাণ্ডোদের। কিন্ত তারাও সুবিধা করতে পারছিল না খুব একটা। তাজ প্যালেস আর ওবেরয় ট্রাইডেন্টসের অবস্থানটাই এমন ছিল যে, হুট করে অপারেশন চালাতে গেলে হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী বাড়তে পারতো। ভেতরে কী হচ্ছে, ক'জন বেঁচে আছে জানা যাচ্ছিল না কিছুই। তাছাড়া ভিক্টিমদের সঙ্গে জঙ্গীরাও গা ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে, ভয় ছিল এমনটাও।
ছাব্বিশ-সাতাশ-আটাশ নভেম্বর, টানা ষাট ঘন্টারও বেশী সময় ধরে একটানা আগুণ জ্বলেছে এই দুই হোটেলে, বিশেষ করে তাজ প্যালেসে। ২৯ নভেম্বর সকাল আটটায় মূল অপারেশন চালায় কমাণ্ডরা, হেলিকপ্টারে করে ছাদে নেমে বিস্ফোরকের সাহায্যে গর্ত করে হোটেলে প্রবেশ করে তারা, তিন জঙ্গী নিহত হয় তাদের হাতে, যারা গত ষাট ঘন্টায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল এই দুটো ভবনে। চাপ চাপ রক্তের স্রোত আর লাশের স্তুপ পেরিয়ে ওবেরয় ট্রাইডেন্টস থেকে আড়াইশো আর তাজ প্যালেস থেকে তিনশোর বেশি জিম্মিকে উদ্ধার করেন তারা।
সব মিলিয়ে মুম্বাই হামলায় মৃতের সংখ্যা দেড়শোর বেশী, আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল হাজার। আটক হওয়া কাসাবের স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন 'লস্কর ই তৈয়েবা' চালিয়েছিল এই ন্যাক্কারজনক হামলা। ওদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে পাঠানো হয়েছিল করাচী বন্দর থেকে। সেই অস্ত্রের যোগান এসেছিল করাচী আর থাট্টার লস্কর ই তৈয়েবার ক্যাম্প থেকে। মুজাফফরবাদের গহীন পাহাড়ী জঙ্গলে এই জঙ্গীদের দেয়া হয়েছিল প্রশিক্ষণ, প্রায় চব্বিশ থেকে ছাব্বিশজন ছিল প্রাথমিক দলে। ব্রেইনওয়াশ করে ভারতবিরোধীতা আর বিকৃত ইসলামিজম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল এদের মস্তিষ্কে, জান্নাতের লোভ দেখিয়ে ভয়ঙ্কর একটা সাইকোলজিকাল গেম খেলা হয়েছিল এদের নিয়ে। নির্বাচিত দশজনকে আবার মানশেরা নামের একটা জায়গায় লস্করের গোপন আস্তানায় আলাদা ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল।
অস্ত্র আর বোমা চালনায় অসম্ভব পারদর্শী হয়ে উঠেছিল একেকজন, যেকোন স্পেশাল কমাণ্ডোর চেয়ে শক্তি বা ক্ষীপ্রতায় এরা কম ছিল না কোন অংশে। পাকিস্তানও এই ঘটনায় লস্করের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে, সেখানে গ্রেফতারও করা হয় অনেককে। ভারতে গ্রেফতার হয় ৩৭ জন, এদের মধ্যে দুজন সেনা কর্মকর্তাও ছিল! আমেরিকা থেকেও গ্রেফতার হয় দুই সন্দেহভাজন। এদের মধ্যে ডেভিড হ্যাডলি ওরফে দাউদ সাঈদ গিলানী হামলার আগে বেশ ক'বার ভারতে এসেছিল এবং হামলাকারীদের সঙ্গে জিপিএসে তথ্যের আদানপ্রদান করেছিল বলে প্রমাণ হয়।
ভারতের অভিযোগ ছিল এই জঙ্গীদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র সরবরাহের পেছনে আইএসআই এবং পাকিস্তার আর্মির হাত আছে, সেই দাবী পাকিস্তান উড়িয়ে দিয়েছিল। তবে লস্করের মদতদাতা হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নাম বিশ্ব গণমাধ্যমে অজস্রবার নানা প্রসঙ্গে উঠে এসেছে। ২০১১ সালে আমেরিকা লস্করের তিন জঙ্গীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে, এরা হলো সাজিদ মীর, আবু কাহাফা এবং মেজর ইকবাল। এই তিনজনই মুম্বাই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে ধরা হয়।
খুনী আজমল কাসাবের ফাঁসি হয়েছে ২০১২ সালে। জুহু বীচ এখন শান্ত, মুম্বাইয়ের বুক থেকে সেই রক্তের স্রোত মুছে গেছে, অদৃশ্য হয়ে গেছে দাগ; তাজ হোটেল এখন আগের চেয়েও ঝকঝকে। কিন্ত ক্ষতগুলো এখনও পোড়ায়, নিহতদের অনুপস্থিতি কাঁদায় তাদের পরিবারকে। আলো ঝলমল একটা নগরীকে যারা মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল, শত শত মানুষকে যারা বিনা অপরাধে নৃশংস মৃত্যুর পথে ধাবিত করেছিল, তাদের জন্যে আমাদের পক্ষ থেকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেয়ার নেই। যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই বর্বর হামলায়, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে 'এগিয়ে চলো' পরিবার। দেশ জাতি ধর্ম স্থান কাল পাত্র যাই হোক না কেন, সভ্য মানুষ হিসেবে আমরা শুধু জানি, আমরা সন্ত্রাসের বিপক্ষে।
আরও পড়ুন-