ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে মৃত্যু উপত্যকায় রূপ নিয়েছিল বোম্বে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বোম্বের নাম পাল্টে মুম্বাই হয়েছে, জুহু বীচের ধারে আলোর ঝলকানি বেড়েছে আরো। কিন্তু সেই ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে নিহত হওয়া শ’তিনেক নীরিহ মানুষ কখনও জানতে পারেনি কেন তারা মারা গেল, কী ছিল তাদের অপরাধ!
বারোই মার্চ ১৯৯৩, ক্যালেন্ডারের পাতায় সেদিন শুক্রবার, আর পাঁচটা দিনের মতোই। কর্মচাঞ্চল্যে ঠাসা ভারতের বাণিজ্যনগরী বোম্বে (মুম্বাই), লোকে অফিস করছে, ব্যবসায়ীরা দোকান খুলে বসেছেন, রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ছে, হাট-বাজারে জনসমাগম বেশ। শান্ত, নিস্তরঙ্গ একটা পরিবেশ জুহু বীচের ধারে, শুধু ঢেউগুলো বারবার হানা দিয়ে যাচ্ছে তীরে।
দূরে জাহাজের কাঠামোগুলো আবছা নজরে পড়ে, বেশ খানিকটা আগেই আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে সকাল, জেগে উঠেছে বোম্বেও। ব্যস্ততা বাড়ছে তার, সেই সঙ্গে মনে উদ্বেগ আর ভয় বাড়ছে অল্প ক'টা মানুষের। তাদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শহরের বারোটা জায়গায় শক্তিশালী বোমা ফিট করে রেখে আসার, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই শহরটাকে মৃত্যু উপত্যকা বানিয়ে দেয়ার ভার পড়েছে তাদের ওপর। আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই যমদূত এসে দাঁড়াবে ফিল্মসিটি বোম্বেতে, শ'তিনেক নিরপরাধ মানুষ কখনও জানতে পারবে না কেন তারা মারা গেল!
দুপুর একটা বেজে ত্রিশ মিনিট, খানিক পরেই লাঞ্চের বিরতি। বোম্বের স্টক এক্সচেঞ্জে মানুষজন গিজগিজ করছে, ওদের কেউ জানে না, কয়েক মূহুর্ত পরেই লাশ হয়ে যাবে এদের মধ্যে থেকে পঞ্চাশজন। বিল্ডিঙের বেজমেন্টে রাখা গাড়িতে ছিল বোমাটা, বিস্ফোরণ ঘটালো সে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে। আটাশ তলা বিল্ডিঙের দেয়াল ধ্বসে পড়লো, জানালার কাঁচ ছিটকে বেরুলো বাইরে। চারপাশে মানুষের মৃতদেহ আর খণ্ড খণ্ড অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তাজা রক্তের স্রোত নামছে সিঁড়ি বেয়ে, জমছে ভবনের গোড়ায়। দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন, প্রাণের মায়ায় ছুটছে মানুষ, কেউ চাপা পড়ে যাচ্ছে সেই ছুটন্ত মিছিলের নীচে। সবাই হতবুদ্ধি, কী ঘটছে বুঝে ওঠার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হলো জনা পঞ্চাশেক মানুষকে, যাবার আগে নিজেদের অপরাধটুকে জানার সুযোগ পেলেন না তাঁরা!
বোম্বের মণ্ডবীতে কর্পোরেশন ব্যাংকের শাখা। কোটি টাকার লেনদেন হয় এখানে, বিলিওনিয়ার থেকে শুরু করে ছাপোষা চাকুরীজীবিরও আনাগোনা, সেখানেই দুপুর দুইটায় ঘটলো বিস্ফোরণ। এবারেরটাও গাড়িবোমা! লোকে হন্যে হয়ে ছুটতে লাগলো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, খানিক আগেও যারা বেঁচে ছিল, সেই মানুষগুলোর লাশ পায়ে মাড়িয়ে। জীবনের চেয়ে দামী তো আর কিছু নেই! পরের দেড়ঘন্টায় বোম্বে পরিণত হলো ধ্বংসের নগরীতে, কিংবা ছোটখাটো একটা মৃত্যু উপত্যকায়।
একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো বাণিজ্যনগরী, থমকে গেল সময়। ফিশারম্যানস কলোনী, জাভেরী বাজার, প্লাজা সিনেমা, সেঞ্চুরী বাজার, এয়ার ইন্ডিয়া বিল্ডিং, হোটেল সি রক, পাসপোর্ট অফিস আর শহরের খানিক বাইরে থাকা সাহার এয়ারপোর্টে হলো হামলা, কোথাও গাড়িবোমা, কোথাও বা স্কুটারে করে নিয়ে আসা হয়েছিল মৃত্যুদূতগুলোকে। হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে স্যুটকেসে ভরে বোমা রেখে এসেছিল ঘাতকেরা, সাহার এয়ারপোর্টে বোমা ঢোকানোর উপায় না পেয়ে গ্রেনেড হামলা চালালো জঙ্গীরা।
সেই অভিশপ্ত বারোই মার্চে বারোটি স্থানে চালানো হয় বোমা হামলা, বোম্বের পথেঘাটে তখন তাজা রক্তের বন্যা, মানুষের আহাজারিতে কান পাতা দায়। বিশ্বের বুকে সেটাই প্রথম সিরিয়াল বোম্ব ব্লাস্টের ঘটনা, প্রাণ দিয়ে যে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিল বোম্বের মানুষ!
মূখ্যমন্ত্রীর অফিসের চারতলা, নিজের কামরায় বসে আছেন শারদ পাওয়ার। এতটা বিচলিত তাকে কখনও দেখা যায়নি। একটার পর একটা ফোন আসছে, কোথাও কোন ভালো খবর নেই। পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে কেবল, নিয়ন্ত্রণের বাইরে তো চলে গিয়েছে সেই কখন! মিডিয়া হামলে পড়েছে অফিসের সামনে, ব্যারিকেড দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তাদের। জরুরী লাইনে সর্বক্ষণ যোগাযোগ হচ্ছে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে, কিন্ত বোম্বে পুলিশ পারছে না পরিস্থিতি সামাল দিতে, এমন অভিজ্ঞতা তো ভারতে এই প্রথম!
কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন? সাতপাঁচ ভাবতে থাকেন শারদ। জানালার সামনে এসে দাঁড়ান তিনি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় থেকেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তার মুখে। পলিটিক্যাল ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে গেল কিনা সেটা ভেবেও মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে তার, ফোনে একটাও সুখবর নেই, অধঃস্তনদের ওপর ক্ষেপে ওঠেন শারদ, ধমক দেন যাকে তাকে! হতচ্ছাড়া ফোনটা বাজতেই থাকে, শারদ তুলে নেন। ওপাশ থেকে তাকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও কথা বলতে চান। কপাল কুঁচকে লাইন দিতে বলেন তিনি। আড়াইশোর বেশী মানুষের রক্তে রঞ্জিত হলো বোম্বে, সরকারী হিসেবে সংখ্যাটা ২৫৭ হলেও, বেসরকারী তথ্যমতে তিনশো ছাড়িয়েছিল নিহতের অঙ্ক।
প্রায় দেড় হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন এই বোমা হামলায়, এদের অনেককেই বরণ করে নিতে হয়েছে পঙ্গুত্ব। বাকী রাজ্যগুলোতে জারী করা হলো রেড এলার্ট, বাতাসের বেগে ছড়াতে শুরু করলো নানা রকমের গুজব, মানুষের ভয় গেল আরো বেড়ে। আরব সাগরের শান্ত ঢেউয়ের তোড়ে মিশে গেল নিহতদের বোবাকান্না আর আহতদের আর্তনাদ। মানুষগুলো জানলো না, কোন পাপের শাস্তি ভোগ করতে হলো তাদের!
এর তিনদিন আগের কথা, ৯ই মার্চ গুল মোহাম্মদ শেখ নামের এক ছিচকে অপরাধী ধরা পড়েছিল বোম্বে পুলিশের হাতে, গুল্লু নামেই আন্ডারগ্রাউন্ডে পরিচয় ছিল তার। এই গুল্লু ছিল টাইগার মেমনের পাঠানো উনিশ জঙ্গীর একজন, যাদের উপর দায়িত্ব ছিল বোম্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বোমা ফিট করে দিয়ে আসা। কে এই টাইগার মেমন?
বোম্বের অপরাধ জগতের ত্রাস, আন্ডারওয়ার্ল্ডের অঘোষিত ঈশ্বর দাউদ ইব্রাহিমের খুব কাছের লোক ছিল টাইগার মেমন। আগের বছরই গুজরাটে বাবরি মসজিদ নিয়ে দাঙ্গা হয়েছে, সেই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিল বহু মুসলমান। সেটার প্রতিশোধ নেয়ার নামেই এই ঘৃণ্য হামলা! অথচ বোম্বেতে যারা নিহত হয়েছে, যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, তাদের সাথে গুজরাটে মারা যাওয়া মুসলমানদের কোন শত্রুতা ছিল না। হিংসার ঘৃণ্য বীজ ছড়িয়ে দিতেই এই রাস্তা বেছে নিয়েছিল দাউদ আর তার সঙ্গীরা। আর এই অপারেশনের পুরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল টাইগার মেমনকে, তার সঙ্গী এবং অস্ত্র ও অর্থের যোগানদাতা হিসেবে কাজ করেছিল অপরাধ জগতের আরেক হোতা আবু সালেম।
উনিশ জন বাছাই করা লোককে ভারত থেকে দুবাই নিয়ে যায় টাইগার মেমন, দুবাই হয়ে পাকিস্তানে পৌঁছে দলটা। টাইগার মেমন সম্ভবত তারিখ নিয়ে খেলতে পছন্দ করতো, কিংবা পুরোটাই কাকতালীয় ব্যাপার। বোম্বের বারোটি জায়গায় বোমা হামলা হয় মার্চের বারো তারিখে, আর উনিশজনের এই দলটা ট্রেনিং নিতে পাকিস্তান পৌঁছে ফেব্রুয়ারীর উনিশ তারিখে! সেখানে তাদের শেখানো হয় কীভাবে অস্ত্র চালাতে হয়, গুলি লোড করা, বোমা বানানো, সবচেয়ে কম পরিমাণ আরডিএক্স থেকে সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতিসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরী করা- সবকিছুরই হাতেখড়ি দেয়া হয় তাদের।
এই দলেরই অন্যতম সমন্বয়ক ছিল গুল মোহাম্মদ শেখ ওরফে গুল্লু। পুরো পরিকল্পনার খুঁটিনাটি সব তথ্য যেত দুবাইতে অবস্থানরত দাউদ ইব্রাহিমের কাছে, প্রয়োজনমত প্ল্যানে কাটছাঁট করতো সে। মার্চের চার তারিখে ভারতে ঢুকে পড়ে গুল্লু, কিন্ত ভাগ্য খারাপ তার, পাঁচদিন পরেই বেহেরামপাড়া বস্তিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার হয় সে। বোম্বের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শিবজয়ন্তীতে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল দাউদ আর তার সহযোগীদের, সেই উৎসব হবার কথা ছিল এপ্রিল মাসে। কিন্ত গুল্লু ধরা পড়ায় প্ল্যান বানচাল হবার ভয়ে এগিয়ে আনা হলো সময়, দুবাই থেকে পাওয়া টাইগার মেমনের আদেশ অনুসরণ করে তিনদিনের মধ্যে বোমা তৈরী করে ফেললো দলের বাকীরা।
আর এরপর? বোম্বের রাস্তায় রক্তের হোলিখেলা, মৃত্যুর মহোৎসব! হতবুদ্ধি ভাব কাটিয়ে বোম্বে পুলিশ অ্যাকশান নামে দ্রুত, সূত্র খুঁজে জানা গেল এই ঘটনার সঙ্গে গুল্লুর সংযোগ থাকার কথা। সে সহজেই স্বীকার করলো কারা কারা জড়িত এই বোমা হামলার সঙ্গে, পেছনে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছে কে কে। টাইগার মেমনের নাম উঠে এল এভাবেই, বোম্বে পুলিশের খাতায় দুশ্চিন্তা হিসেবে নাম লেখা ছিল আগেই, দাউদ ইব্রাহিম এবার হয়ে গেলেন পুরো ভারতের জন্যেই হুমকীর নাম।
স্পেশাল কোর্ট বসিয়ে (টাডা কোর্ট) বিচার করা হলো গ্রেফতারকৃত অপরাধীদের। মূল হোতাদের একজন আবু সালেম পালিয়ে গিয়েছিল পর্তুগাল, তাকে সেখান থেকে ধরে আনা হলো। টাইগার মেমনের ভাই ইয়াকুব মেমন ধরা পড়লো ভারতেই।
২০১৫ সালে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি হয়েছে নাগপুরের জেলে, ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে আরো দুই অপরাধীকে, আবু সালেমকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে আজীবনের। তবে দাউদ বা টাইগার মেমন- ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন মূল দুই হোতা, কখনও পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে তারা, কখনও আবার দুবাইয়ে!
সন্ত্রাস কিংবা জঙ্গীবাদ কোন দেশ মানে না, ধর্ম মানে না, সীমান্তের কাঁটাতারের বেষ্টনীকে গোনায় ধরে না। তার কাজ একটাই, মানব জনপদকে রক্তে রঞ্জিত করে বিশৃঙখলা সৃষ্টি করা। বোম্বের বুকে সেই ব্ল্যাক ফ্রাইডেতেও একই ঘটনা ঘটেছিল, প্রাণ দিয়ে জঙ্গীবাদের ভয়াবহতার কথা লিখে গিয়েছিলেন প্রায় তিনশো মানুষ। সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন অনেকে।
বোম্বের নাম পাল্টে মুম্বাই হয়েছে, জুহু বীচের ধারে আলোর ঝলকানি বেড়েছে আরো। কিন্ত সন্ত্রাসের আনাগোনা বন্ধ হয়নি পুরোপুরি। ২০০৮ সালেই হোটেল তাজসহ মুম্বাইয়ের নানা এলাকা আক্রান্ত হয়েছিল জঙ্গীদের দ্বারা, সেসব থাকছে আমাদের 'মুম্বাই হামলা' সিরিজের পরবর্তী পর্বে। আজ এ পর্যন্তই। (দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)
তথ্যসূত্র- উইকেপিডিয়া, নিউজ১৮, ইন্ডিয়া টুডে
আরও পড়ুন-