ভালোবাসার জন্য দেবদাস হয় লোকে। দেশের জন্য কাউকে দেবদাস হতে দেখেছেন?

শেষ যে মুভিটা মাথার মধ্যে গেঁথে আছে সেটার নাম 'দ্য ইমিটেশন গেম'। বিখ্যাত ম্যাথম্যাটিশিয়ান এলান টিউরিংয়ের জীবনী নিয়ে মুভিটি, যাকে আধুনিক কম্পিউটারের জনকও বলা যায়। কিন্তু তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন তার বিখ্যাত এনিগমা ডিকোড মেশিন আবিষ্কারের জন্য।

বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার এই কম্পিউটার আবিষ্কারের ফলে যুদ্ধটা ৫ বছর আগে শেষ হয়। এবং প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ কম মারা যায়। এই এলান টিউরিং তার ৪২তম জন্মদিনের মাত্র ১২ দিন আগে সায়ানাইড পয়জনে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা হলেও এটা ছিল একটা হত্যা। কারণ ব্যক্তিজীবনে এলান ছিলেন হোমোসেক্সুয়াল। আর তখন গ্রেট ব্রিটেনে হোমোসেক্সুয়ালিটিকে ক্রিমিনাল অফেন্স মানা হতো।

আর এই কারণে ১৯৫২ সালে তার নামে ক্রিমিনাল প্রসিকিউশান শুরু হয়। তাকে দুইটা অপশন দেয়া হয়। দুই বছরের জেল, নয়তো ট্রিটমেন্ট নিতে হবে স্ট্রেইট হতে। স্বাভাবিকভাবেই এলানের জন্য বেস্ট অপশান ছিল ট্রিটমেন্ট নেয়াটাই। কারণ নিজের এনিগমা মেশিন নিয়ে স্বপ্নটা তখন তাঁর বড়। আর এই কারণে তাকে জেলের বাইরে থাকতে হবে। এভাবেই তিলে তিলে যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এলান টিউরিংয়ের কাছে পাবলিক এপোলোজি স্টেটমেন্ট রিলিজ করেন। যেখানে স্বাক্ষর ছিল ব্রিটিশ কুইন এলিজাবেথের।

তো হঠাৎ এলান টিউরিংয়ের কথা কেন? আমার খুব কাছের যারা, তারা জানেন আমি মুভি বানানোর স্বপ্ন দেখি। কমপক্ষে একটা মুভি বানাতে চাই। আর এই 'ইমিটেশন গেম' দেখে মনস্থির করে ফেলেছিলাম তখনই, যদি কখনো সামর্থ্যে কুলোয় আমার প্রথম মুভিটাও হবে বায়োপিক। নাম দিব 'দেবদাস'। কাহিনীটাও বলে দেই। 

আমার মুভির নায়কের জন্ম ১৯২৮ সালে জয়পুরহাটে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। দারিদ্রের কষাঘাতে পিষ্ট হলেও ছেলেটা ছিল প্রচণ্ড মেধাবী। বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে ছেলেটা সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেন। তারপর ১৯৫২ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর কিছুদিন বগুড়া ও কুমিল্লার দুটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তারপর চলে যান মেলবোর্নের লাট্রোব ইউনিভার্সিটিতে গণিতে উচ্চতর পড়াশোনা করতে। ফিরে এসে যোগ দেন করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ১৯৬৭ সালে যোগদান করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

একাকী আত্মমগ্ন এই লোকটার সময় কাটতো অধ্যাপনা, বই পড়া আর ফ্লুইড ডিনামিক্সের উপর নিজের গবেষণার মধ্য দিয়ে। নিভৃতচারী হবার ফলে অনেকে এই লোকটাকে এরোগেন্টও ভাবত। তারপর এলো ১৯৭১। মার্চ মাসের শেষদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে ঘাঁটি গাড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বর্বরতার কেন্দ্র। পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা। এপ্রিলের মাঝামাঝিতেই বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে প্রায় সকলে।

কিন্তু নিভৃতচারী মানুষটা তখনো প্রাণের ক্যাম্পাসে থেকে যান অবরুদ্ধ হয়ে সামরিক বাহিনীর কাছে। সহকর্মীরা তাকে পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে যেতে বললেও তিনি যাননি। তারপর একদিন হাঁপিয়ে উঠেন। মে মাসের ১০ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক বাহিনী অবরুদ্ধ কর্তৃপক্ষের কাছে ইংলিশে একটা চিঠি লিখেন। যার অর্থ দাঁড়ায়- 'এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি মিলিটারী ক্যাম্পে পরিণত হওয়ায় আমি এই ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে চাই। অবরুদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয় যখন মুক্ত হবে, যখন এটি তার স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ফিরে যাবে তখন আবার ফিরে আসবো। দু্র্যোগ আর গণহত্যার এই সময়টি আমি আমার নিজ গ্রামে কাটাতে চাই, অফিশিয়ালি যেটি আমার স্থায়ী ঠিকানা'। 

মজিবর রহমান দেবদাস

চিঠির শেষে তিনি লিখলেন, "আজ থেকে আমি নতুন নামে পরিচিত। আজ থেকে আমার নাম ‘দেবদাস’। এই নামেই আমার সাথে চলবে পরবর্তী যোগাযোগ"। এরপর নিজের নাম সাইন করেন- ডি.দাস। ব্র্যাকেটে লেখেন দেবদাস, পূর্ববর্তী নাম মজিবর রহমান। তার এই দেবদাস নামের পিছনের কারণ ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সনাতন ধর্মালম্বীদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের প্রতিবাদ।

এই চিঠি পেয়েই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে তুলে নিয়ে যায়। শহীদ জোহা হলে মিলিটারী ক্যাপ্টেন তাঁকে জিজ্ঞেস করে, WHAT DO YO MEAN BY GENOCIDE? অধ্যাপকের সামরিক বাহিনীর চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ে উত্তর, THAT WHICH YOU ARE COMMITTING IN THIS STAGE" তারপরের গল্পটা কম বেশি সবাই আন্দাজ করতে পারবেন। তার উপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। তার নাম বদলাতে রাজী করানোর জন্য এমন কোন নির্যাতন ছিল না যা তার উপর করা হয়নি। কিন্তু তিনি তার বক্তব্যে ছিলেন অটল। সবশেষে সেপ্টেম্বরের তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি আসলে দিতে বাধ্য হয়। কারণ বৈশ্বিক চাপে ইয়াহিয়া ৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তার ফলে তাকে আটকে রাখার সামর্থ্য সামরিক বাহিনীর ছিল না। 

ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসেন প্রিয় ক্যাম্পাসে। কাজে যোগ দিতে চাইলেন কিন্তু নিজের দেবদাস নামটা বদলাতে চাইলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও যেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকারের আরেক প্রতিচ্ছবি। দেবদাস বলে কোন শিক্ষক নথিভুক্ত নেই বলে তাকে যোগদানে বাধা দেয়া হল। তিনিও দমে না গিয়ে এফিডেভিড করে আইনসিদ্ধভাবে যোগদান করলেন। এবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার মানসিক স্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন তুললো। অত্যাচারের ষোলকলা পূর্ণ করা যেন!

অনেকটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে ১৯৭৩ সালে তিনি ইস্তফা চিঠি দেন কর্তৃপক্ষের কাছে। অভিমানে সেখানে এটাও লেখা থাকে তাকে যেন ইস্তফা দেয়া হয় আগস্ট ১৯৭১ সাল থেকেই। অবাক করে দিয়ে উপহাসের কর্তৃপক্ষও তা মেনে নেয়। এমনকি তাকে তার বকেয়া বেতনগুলোও দেয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রফেসর ফিরে যান তার জয়পুরহাটের মহিরুল গ্রামে।

একাকী থেকে আর একাকী হয়ে পরেন। কারো সাথে তেমন কথাও বলেন না। শুধু এক নাতনীর সাথে দুয়েকটা কথা বলতেন তাকে দেখাশোনা করত বলে। গ্রামের সবাই বুড়ো দাদু বলে ডাকে তাকে। গ্রামের লোকের ভাষায় যার "বেরেন নষ্ট"। এভাবেই লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে যান প্রফেসর। দীর্ঘদিন পর ১৯৯৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র ও সাংবাদিক এবং বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হাসিবুল আলম প্রধান খুঁজে বের করেন স্যারকে। ১৯৯৮ সালে তাকে নিয়ে আসা হয় তার প্রাণের ক্যাম্পাসে। তখন কিছুদিন থাকেন তার প্রিয় জুবেরী হলে। তার সম্মানে ২ আগস্ট এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে কিছুদিন স্বাভাবিক হয়ে উঠেন। সংবর্ধনা শেষে অনেকটা জোর করেই তাকে ফিরতি গাড়িতে উঠানো হয়। প্রিয় ক্যাম্পাস যে ছাড়তেই চাচ্ছিলেন না। আবারও ফিরে আসেন মহিরুল গ্রামে। আবারো ফিরে আসে ভয়ানক রাতের দুঃসহ স্মৃতিগুলো। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে স্যারও আবার অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেন।

২০১৫ সালে স্যারকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। যদিও সেখানে তার সাথে আর একবার উপহাস করা হয়। তার নাম বলা হয় শুধুই মজিবর রহমান। সেখানেও তিনি বলে যান তার নাম দেবদাস। একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল। যদিও সেই স্বপ্নটাও আজও স্বপ্নে রয়ে গেলেও, মজিবর রহমান দেবদাসের মত মানুষগুলো একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছেন এখনো।

স্যারকে একবার জুবেরী হলে দুজন পাকিস্তানি সৈন্য জিজ্ঞেস করেছিল তাদের মধ্যে কোন হিন্দু শিক্ষক আছে কিনা? স্যার নির্বিকার হয়ে বলেছিলেন, না নেই। তারপর তাকে সেই দুইজন সৈন্য উপাচার্যের কক্ষে নিয়ে যেতে লাগলে স্পষ্ট উর্দুতে ঐ দুজন সৈন্যকে বলেন, "মুহম্মদ নামে একজন মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল মানবজাতির কল্যাণের জন্য কিন্তু মুহম্মদ এর ধর্মকে কলঙ্কিত করছে এখন চোর, গুন্ডা, বদমাশ"। কথাগুলো কি নির্মম সত্য আজও।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা