ক্রিকেটভক্তরা তাকে ভালোবেসে ডাকে ক্যাপ্টেন কুল। কখনো ব্যাট হাতে ম্যাচ ফিনিশিং করে, কখনো বা উইকেটের পিছনে গ্লাভস হাত, আর কখনো বা স্রেফ নিজের ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্কের জোরে। এরকমই কিছু স্মরণীয় “ধোনি ম্যাজিক” মুহুর্ত স্মৃতির পাতা থেকে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক...

ক্রিকেটকে বলা হয় অনিশ্চিত খেলা। ম্যাচ যে কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউ বলতে পারে না। বহুবার এমন হয়েছে, নিশ্চিত জেতা ম্যাচ অমুক দল হেরে এসেছে বা সম্পূর্ণ হারা ম্যাচ অবিশ্বাস্যভাবে জিতে গেছে তমুক দল। একটা  ক্রিকেট ম্যাচে বিশেষ কিছু মুহুর্তই পুরো ম্যাচের গতিপথ বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তো এই উত্তেজনা আরও বেশি। ম্যাচ সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগে যেন কোন শেষ কথাই সেখানে খাটে না। সেখানে দুই দলই নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে জয় ছিনিয়ে আনতে।

মাঠে শুধু ব্যাটে-বলেই লড়াই হয় না, বরং অনবরত চলে বুদ্ধির লড়াই। অধিনায়কেরা স্ট্রাটেজি দিয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে চায়। প্রায় সময়েই দেখা যায়, ম্যাচের ক্রুসিয়াল পয়েন্টে তাদের সিদ্ধান্তেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। কিন্তু মাঠে লড়াই করা দুই দলের একটির অধিনায়ক যদি হয় এমএসধোনি, তাহলে মনে হবে কোন এক জাদুবলে তিনি ম্যাচের পর ম্যাচ তার দলকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের করে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছেন।

ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার গ্যারি লিনেকার যেমন জার্মানির কামব্যাক নিয়ে বলতেন, ফুটবল এমন একটা খেলা যেখানে ২২জন প্লেয়ার ১২০ মিনিট ধরে একটা বল নিয়ে লড়াই করে, শেষে জার্মানি জিতে। তিনি যদি ক্রিকেটার হতেন, তাহলে হয়তো তার উক্তি হতো- ক্রিকেট এমন একটা খেলা যেখানে ২২ জন প্লেয়ার ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং করে, শেষে ধোনির দল জিতে।

ক্যাপ্টেন ধোনির এরকম অনেক ম্যাচ রয়েছে, যেখানে তার একটা সিদ্ধান্ত শুধু ম্যাচের না, পুরো টুর্নামেন্টের চিত্রই বদলে দিয়েছে। বছরের পর বছর কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি ঠান্ডা মাথায় যেভাবে ম্যাচের ঘুরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য রাখেন। এজন্যই ক্রিকেটভক্তরা তাকে ভালোবেসে ডাকে ক্যাপ্টেন কুল। কখনো ব্যাট হাতে ম্যাচ ফিনিশিং করে, কখনো বা উইকেটের পিছনে গ্লাভস হাত, আর কখনো বা স্রেফ নিজের ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্কের জোরে। এরকমই কিছু স্মরণীয় “ধোনি ম্যাজিক” মুহুর্ত স্মৃতির পাতা থেকে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক-

২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপের গ্রুপ রাউন্ড (বাংলাদেশ-ভারত)

২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপের গ্রুপ রাউন্ড (বাংলাদেশ-ভারত)

ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে ধোনির ভারত মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশের। টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে হলে, এই ম্যাচে জয়ের কোন বিকল্প ছিল না তাদের। কিন্তু সেইদিন মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ খেলছিল উজ্জীবিত ক্রিকেট। কোহলি-রোহিত-ধোনিদের খোলসবন্দি করে ভারতকে তারা আটকিয়ে ফেলে ১৪৬ রানে। জবাবে তামিম-সাব্বির-সাকিবদের সুবাদে দ্রুত রান তুলতে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু ধোনির দুইটি বুদ্ধিদীপ্ত স্ট্যাম্পিং এ তামিম ও সাব্বির ফিরে গেলে ম্যাচে ফেরত আসে ভারত।

কিন্তু সৌম্য, মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহর পালটা আক্রমণে বাংলাদেশ পাচ্ছিল নিশ্চিত জয়ের সুবাস। এমনকি শেষ মুহুর্তে সমীকরণ ছিল বাংলাদেশের দরকার ৩ বলে মাত্র ২ রান। ক্রিজে রয়েছেন দুই সেট ব্যাটসম্যান। কিন্তু পরের দুই বলে দুইজনেই বিগ শট এটেম্পট করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরলে সমীকরণ এসে দাঁড়ায় ১ বলে ২ রান।

তখনই ক্যাপ্টেন ধোনি দৌড়ে এসে বোলারকে নির্দেশনা দিয়ে নিজের ডান হাতের কিপিং গ্লাভস খুলে উইকেটের পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। এরপরের কথা সবারই জানা। ব্যাটসম্যান ব্যাটে বল লাগাতে না পেরে দৌড়ে এক রান নেয়ার চেষ্টা করেন। ধোনি উইকেটের পিছন থেকে বল থ্রো করে রান আউট করার রিস্ক নিতে চাননি। তাই তিনি নিজেই গুলির বেগে ছুটে এসে ভেঙ্গে দেন স্ট্যাম্প। নিশ্চিত হারা ম্যাচ বের করে আনেন ক্যাপ্টেন ও উইকেটকিপার ধোনি।

২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপের বোল আউট (ভারত-পাকিস্তান)

২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপের বোল আউট (ভারত-পাকিস্তান)

ইতিহাসের প্রথমবারের মতন টি২০ বিশ্বকাপের গ্রুপ রাউন্ডে পাকিস্তানের সাথে ভারতের ম্যাচ হয়েছিল টাই। নতুন নিয়মানুসারে, নির্ধারিত খেলা শেষে অনুষ্ঠিত হবে টাইব্রেকার- বোল আউট। অর্থাৎ বোলারদের বল করে ব্যাটসবিহীন স্ট্যাম্পে লাগাতে হবে। এটিই ছিল ইতিহাসের প্রথম বোল আউট। সেখানে ভারত ৩-০ তে জয়লাভ করে।

পাকিস্তানি বোলারদের প্রথম তিনজনের কেউই বল স্ট্যাম্পে লাগাতে পারেনি, কিন্তু ভারতের তিনজনেই লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম হয়। এর পিছনেও ছিল ধোনির ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। তিনি বুঝেছিলেন, বোল আউটে নিশানাভেদ করতে একজন স্পিন বোলার বেশি কার্যকরি। এজন্য তিনি শেবাগ, উত্থাপ্পার মতন নিখাদ ব্যাটসম্যানদের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন যেন তারা বল স্পিন না করে আরামসে লক্ষ্যভেদ করতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান অধিনায়ক হয়তো এদিকটা ভেবে দেখেন নি। ফলাফল- ভারতের জয়।

২০১৩ এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল (ভারত-ইংল্যান্ড)

২০১৩ এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল (ভারত-ইংল্যান্ড)

ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বৃষ্টিবিঘ্নিত ৫০ ওভারের ম্যাচের দৈর্ঘ্য এসে দাঁড়ায় ২০ ওভারে। সেখানে প্রথমে ব্যাটিং এ নেমে ইংল্যান্ডকে ১৩০ রানের টার্গেট দেয় ভারত। রান তাড়া করতে নেমে পঞ্চম উইকেটে মরগান ও বোপারার ৬৪ রানের জুটিতে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় তারা। ম্যাচের সমীকরণ দাঁড়ায় ১৮ বলে দরকার মাত্র ২৮ রান। যা এই টি২০ এর যুগে তেমন কিছুই না।

এমনাবস্থায় ধোনি তার মূল অস্ত্র অশ্বিনকে বল না এনে, বল তুলে দেন সেই ম্যাচের খরুচে বোলার ইশান্ত শর্মাকে। ডট বল দিয়ে ওভার শুরু করলেও পরের বলে ছয় তুলে নেন মরগান। এতে নার্ভাস হয়ে পরের দুইটি বলে টানা দুইটি ওয়াইড দিয়ে বসেন ইশান্ত। কিন্তু ধোনি তাকে নিরাশ হতে মানা করে নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে বলেন।

এরপর? পরের দুই বলে মরগান ও বোপারার উইকেট তুলে নেন ইশান্ত। দুই বলের ব্যবধানে দুই সেট ব্যাটসম্যান হারানোর ধাক্কা ইংল্যান্ড আর সামলাতে পারে নি। ফলাফল? ইতিহাসের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে তিনটি আই.সি.সি ট্রফি জয়ের রেকর্ড গড়লেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।

২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল (ভারত-পাকিস্তান)

২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল (ভারত-পাকিস্তান)

একই বিশ্বকাপে আবার মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রথমবারের মতন কোন বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি এই দুই দল। যথারীতি প্রতি মুহুর্তে বদলেছে ম্যাচের রং। কখনো ভারত এগিয়ে, কখনো বা পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করে ভারত সংগ্রহ করে ১৫৭ রান। রান তাড়া করতে নেমে পাকিস্তান বিপাকে পড়লেও মিসবাহ উল হকের শেষ সময়ের ঝড়ে ম্যাচে ফেরত আসে তারা। সমীকরণ নেমে আসে শেষ ওভারে পাকিস্তানের দরকার ১৩ রান, ভারতের দরকার ১ উইকেট। কিন্তু স্ট্রাইকে রয়েছেন মিসবাহ নিজে।

তিনি শেষ ওভারে মিসবাহর সামনে স্পিন আনতে চান নি। তাই, ক্যাপ্টেন ধোনি অভিজ্ঞ হরভজন সিংকে বল না দিয়ে শেষ ওভার করতে দেন অনভিজ্ঞ মিডিয়াম পেসার জোগিন্দর শর্মাকে। তাকে নির্দেশ দেন ওয়াইড ইয়র্কার এটেম্পট করতে। শুরুতে সফল হলেও হাত ফস্কে আসা এক ফুলটসকে ছক্কা মেরে বল গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেন মিসবাহ। জোগিন্দরকে পরামর্শ দিতে দৌড়ে আসেন ধোনি। আশ্বস্ত মনে হল বোলারকে। পরের বলেই মিসবাহ অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল স্কুপ করতে গিয়ে শ্রীশান্তের হাতে ক্যাচ তুলে দেন। ফলাফল? সর্বপ্রথম টি-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা উঠলো ধোনির হাতে।

২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল (ভারত-শ্রীলংকা)

২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনাল (ভারত-শ্রীলংকা)

দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও শ্রীলংকা। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ধারাবাহিক দুইটি দলের এই লড়াইয়ে প্রথমে ব্যাট করে মাহেলা জয়াবর্ধনের অপরাজিত সেঞ্চুরিতে শ্রীলংকা সংগ্রহ করে ২৭৪ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শূন্য রানেই প্যাভেলিয়নে ফেরেন বীরেন্দর শেবাগ, দলীয় ৩১ রানে ফেরেন লিটল মাস্টার টেন্ডুলকারও। দুই উইকেট তুলে নিয়ে মালিঙ্গা ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। পরবর্তীতে দলীয় ১১৪ রানে কোহলিও সাজঘরে ফিরলে ম্যাচ ভারতের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

এ সময়েই সবাইকে অবাক করে টুর্নামেন্টসেরা যুবরাজের স্থানে নিজে আসেন ব্যাটিং এ। অথচ, ধোনি পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। কিন্তু ট্যাকটিকাল কারণে তিনি আগে ক্রিজে নামেন। ফলাফল? মালিঙ্গা-মুরালিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে খেলেন ৭৯ বলে অপরাজিত ৯১ রানের এক স্মরণীয় ইনিংস। তার মধ্যে কুলাসেকারার বলে লং অনে ছক্কা মেরে বিশ্বকাপ ফাইনালের সমাপ্তি টানা তো এখনো সবার চোখে লেগে আছে।

*

প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা